শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পরিস্থিতি কবে হবে?

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-20 07:27:50

করোনা আতঙ্ক সুনামির মত ভাসিয়ে নিচ্ছে পুরো বিশ্ব। করোনার ঢেউ একের পর এক দেশকে গ্রাস করছে। চীনের ঢেউ এখন লেগেছে ইউরোপে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন দেশ নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ থেকে আসার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। গোটা ইতালিই লকডাউন হয়ে গেছে। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে তার যোগাযোগ বন্ধ করে দিচ্ছে, বাতিল বা স্থগিত করে দিয়েছে সব ট্যুরিস্ট ভিসা। বাংলাদেশও ইউরোপের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে, বাতিল করা হয়েছে অন অ্যারাইভাল ভিসা। এভাবে একের পর এক দেশ নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশে করোনা আসার আগে থেকেই বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা হয়েছে। সেই নজরদারির মধ্যেই ইতালি থেকে আসা দুজন বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। তারা নিজেরা তো আক্রান্ত ছিলেনই, বাড়ি গিয়ে একজন তার স্ত্রীকেও আক্রান্ত করেছেন। তবে তিনজনকেই চিকিৎসা শেষে করোনামুক্ত করতে পেরেছে সরকার। আর কেউ যাতে করোনা আক্রান্ত না হন বা সন্দেহভাজন কেউ যাতে ভাইরাস ছড়াতে না পারেন, সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রাথমিক ব্যবস্থাটা অবশ্যই বিমানবন্দরে। বিদেশ থেকে আসা সবাইকেই হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আর আক্রান্ত দেশ থেকে এলে তাদেরকে সরকারি উদ্যোগে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর আগে চীন থেকে আসা লোকদের আশকোনার হজক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিল।

শনিবার সকালে ইতালি থেকে আসা ১৪২ জনকে হজক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিল। শনিবার সন্ধ্যায় ইতালি থেকে আসা আরো ৫৯ জনকে রাখা হয়েছে গাজীপুরের মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে। তবে অসন্তোষ আর বিক্ষোভের মুখে সকালে আসা ১৪২ জনকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে হোম কোয়ারেন্টাইনের জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে।

কোয়ারেন্টাইন বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে ব্যাপক ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হচ্ছে। প্রথম কথা হল, এখন যে পরিস্থিতি কেউ যাতে করোনাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বহন করে নিতে না পারেন, সে জন্য বিশ্বজুড়ে সবাইকেই নিজ নিজ অবস্থানে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ যাতে ভ্রমণ না করেন। যেমন কেউ যদি ইতালিতে থাকেন, তাহলে সেখানেই থাকুন। প্রয়োজনে সেখানেই চিকিৎসা নিন। সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা অবশ্যই বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। আপনি যদি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, আপনার স্বজনদের ভালোবাসেন, তাহলে আপনার উচিত হবে ইতালিতেই থাকা। ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে আসার কোনো দরকার নেই। আর এসেই যদি পড়েন, তাহলে বিমানবন্দরে স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শ মেনে চলুন। তাদের প্রটোকল ফলো করুন। সত্য-মিথ্যা জানি না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম, বিমানবন্দরে ৫০০ টাকা দিলেই নাকি 'করোনামুক্ত' সার্টিফিকেট মেলে। নইলে কোয়ারেন্টাইনের ভয় দেখানো হয়।

প্রথম কথা হলো, আপনি কোনোভাবেই পয়সা দিয়ে 'করোনামুক্ত' সার্টিফিকেট সংগ্রহের চেষ্টা করবেন না। বরং যদি আপনার মনে হয়, আপনাকে যথাযথ পরীক্ষা করা হয়নি আপনি নিজে গিয়ে তাদের বলুন, আপনাকে যেন ভালো করে পরীক্ষা করা হয়। যদি হোম কোয়ারেন্টাইনের পরামর্শ দেয়, তাহলে ভালো করে জেনে নিন, বাড়ি গিয়ে আপনাকে কি করতে হবে। আর যদি সরকার কোয়ারেন্টাইন করতে চায়, নিঃসংকোচে তাদের পরামর্শ মেনে চলুন।

কোয়ারেন্টাইন কোনো শাস্তি নয়, এটি আপনার এবং আপনার পরিবার ও স্বজনদের ঝুঁকিমুক্ত রাখতেই করা হচ্ছে। ১৪ দিন খুব বেশি সময় নয়। বিদেশ থেকে ফিরে নিজের স্বার্থেই স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইনে থাকুন। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীর করোনা শনাক্ত হওয়ার পর স্ত্রীর সঙ্গে তিনি নিজেও কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, টম হ্যাঙ্কসের মত তারকারা কোয়ারেন্টাইনে আছেন। পুরো রিয়াল মাদ্রিদ টিম কোয়ারেন্টাইনে। তাই কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই।

তবে যেখানে কোয়ারেন্টাইন রাখা হবে সেখানকার পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। আপনি চাইলেই মানুষকে জোর করে আটকে রাখতে পারেন না। করোনা বিনা নোটিশে আসা কোনো দুর্যোগ নয়। বাংলাদেশ প্রস্তুতির জন্য প্রায় আড়াই মাস সময় পেয়েছে। এতদিনে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন একটা কোয়ারেন্টাইন এলাকা আমরা কেন তৈরি করিনি। এর আগে চীন থেকে আসা নাগরিকদের হজক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইন করার পরও এখানকার পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু আমরা কিছুই করিনি। এখানে ভালো টয়লেট সুবিধা নেই। পরিবেশ এতটাই অস্বাস্থ্যকর, মশার এমনই অত্যাচার যে করোনা থেকে বাঁচলেও ডেঙ্গু বা চিকনগুনিয়া থেকে বাঁচা মুশকিল। ১৪ দিন খুব বেশি সময় নয় আবার বিচ্ছিন্ন থাকার জন্য কমও নয়।

মনে রাখতে হবে, যারা বিদেশ থেকে ফিরছেন, তাদের বেশিরভাগই সম্পন্ন পরিবারের মানুষ। তারা কেউ অপরাধী নয়। আমি পাঁচ তারকা সুবিধা দাবি করছি না। কিন্তু লম্বা জার্নি আর আতঙ্ককে সঙ্গে করে আসা মানুষগুলোকে যেন জোর করে অমানবিক কোনো পরিবেশে ঠেলে না দেই। সবচেয়ে ভালো হতো আপনি যদি এই সময়ে দেশে না ফিরতেন। ফিরেই যখন গেছেন, তখন কোনোভাবেই কোয়ারেন্টাইনে থাকবো না, এমন মনোভাব পোষণ করবেন না।

একটা কথা মনে রাখতে হবে, করোনা আক্রান্ত হলেও সেটা কিন্তু আপনার অপরাধ নয়। নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখবেন, কিন্তু করোনার আশঙ্কা লুকিয়ে রাখবেন না। করোনা রোগীদের আমরা এড়িয়ে চলবো। তবে সেটা ভালোবেসে, ঘৃণা থেকে নয়। বিদেশ থেকে কেউ ফিরে এলে আপনার যত প্রিয়ই হোক, তার কাছে যাবেন না। অন্তত ১৪ দিন দূরে থাকুন। হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলুন। যা করা হচ্ছে, সবাই কিন্তু আপনার ভালোর জন্য। সন্দেহভাজন হলে কাউকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে আর করোনা শনাক্ত হলে তাকে আইসোলেশনে রাখা হবে। আমরা সবাই যেন সরকারকে সহায়তা করি।

একবার ছড়িয়ে গেলে কিন্তু বাংলাদেশের মত ঘনবসতির দেশে করোনার বিস্তার ঠেকানো কঠিন নয় শুধু, প্রায় অসম্ভব হবে। চীন রাতারাতি হাসপাতাল বানিয়েও করোনা ঝড় সামলাতে পারেনি। ইউরোপ-আমেরিকাও কিন্তু নিজেদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়েও পারছে না। সেখানে বাংলাদেশের আত্মসন্তুষ্টির কোনো জায়গা নেই।

করোনার বিপদটা হল, এটা দ্রুত ছড়ায়, মানুষ থেকে মানুষে। তাই হ্যান্ডশেক বা জড়িয়ে ধরার মত প্রথাগত সম্ভাষণ প্রক্রিয়ায় বদল এসেছে। অনেকেই এখন দূর থেকে সম্ভাষণ করছেন। তবে অনেকে দেশে সম্ভাষণ করার মত লোকই নেই রাস্তায়। সবাই নিজ দায়িত্বে নিজেদের বন্দী করে ফেলেছেন। অনেক দেশে সরকার ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। অনেক অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অনেক অফিস চলছে অনলাইনে, ভার্চুয়ালি। জনসমাগম প্রায় বন্ধ। অনেক দেশে হোটেল, রেস্তোরা, পার্ক, সিনেমা হল, সুইমিং পুল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ক্রীড়া অনুষ্ঠান বা ম্যাচ স্থগিত করা হয়েছে। একের পর এক বাতিল হচ্ছে ফ্লাইট।

বাংলাদেশে যেদিন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে, সেদিন রাতেই মুজিববর্ষের পূর্বনির্ধারিত আন্তর্জাতিক আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে। পরে একে একে স্থগিত করা হয়েছে, মুজিববর্ষ উপলক্ষে পরিকল্পিত এ আর রহমানের কনসার্ট এবং টি-২০ ম্যাচ। এমনকি ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানও সীমিত করা হয়েছে। একে একে অনেক অনুষ্ঠানে পরিবর্তন এসেছে। জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে রাখার সব চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হল, বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন যত লোক আসে, অনেক দেশের জনসংখ্যাও তত নয়। তাছাড়া আমাদের গণপরিবহনও যথেষ্ট নিরাপদ নয়। সেক্ষেত্রে প্রথম কাজ হল অপ্রয়োজনে বাইরে না যাওয়া।

বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের পর থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি উঠছে। তবে সেদিন এক লেখায় আমি লিখেছিলাম, যেহেতু জানি না, করোনার আতঙ্ক কয়দিন থাকবে। তাই আপাতত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ না করলেও চলবে। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলে গেছে। করোনা তেমন ছড়াতে না পারলেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে প্রবলভাবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ না হলেও উপস্থিতি অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। আর এটা ঠিক করোনা ছড়ানোর ধরনটা যেমন তাতে স্কুল-কলেজ হতে পারে সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকসমাগম হয়। নানা শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নানা জায়গা থেকে একত্রিত হয়। তাদের একজন কেউ আক্রান্ত হলে দ্রুতই তা ছড়িয়ে যেতে পারে।

ইতালি ফেরত মামার আদর নিয়ে কোনো শিশু স্কুলে গেছে কিনা আমরা তো জানি না। তাছাড়া কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলগুলোও করোনা বিস্তারের প্রধান ক্ষেত্র হতে পারে। তাই সময়ের দাবি এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা।

বিশ্বের অনেক দেশেই ইতিমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাই বাংলাদেশে নয় কেন? প্রয়োজনে আগামী রোজায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়া যেতে পারে।

তাছাড়া বাংলাদেশে এখন ডিজিটাল। অনেক কিছুই হয় ভিডিও কনফারেন্সে। চাইলে সরকার বিটিভি বা সংসদ টিভি ব্যবহার করে জরুরি পাঠদান চালিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া ছুটির আগে লম্বা হোমওয়ার্কও দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু মাথার ওপর এত বড় আতঙ্ক নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, উচিতও নয়।

অভিভাবকরা যেখানে বন্ধ চাচ্ছেন, সরকার সেখানে চালু রাখছে কেন? অনেকে বলতে পারেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলে আতঙ্ক আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হল, ইতিমধ্যেই আতঙ্ক যা ছড়ানোর ছড়িয়ে গেছে। এখন জরুরি হল করোনা যাতে ছড়াতে না পারে তা নিশ্চিত করা।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। আমি তার সঙ্গে একমত। কিন্তু তেমন পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, সে কারণেই তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। কারণ আমাদের সন্তানদের নিয়ে আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না। শিক্ষার চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। সরকার যেখানে মুজিববর্ষের মত বড় কর্মসূচি স্থগিত করতে পেরেছে, সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ নিয়ে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর