রোহিঙ্গা ও লোতশাম্পা শরণার্থীদের মিল-অমিল ও ভবিষ্যৎ করণীয়

, যুক্তিতর্ক

মো. জাকির হোসেন | 2023-09-01 23:35:54

দীর্ঘস্থায়ী শরণার্থী সৃষ্টি ও প্রত্যাবাসনে গড়িমসিসহ বেশ কিছু বিষয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে ভুটান থেকে তাড়িয়ে দেয়া নেপালে আশ্রয় নেয়া লোতশাম্পা শরণার্থীদের মিল রয়েছে। জিডিপি নয়, জিএনপি-তে(গ্রোস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) বিশ্বাসী সাংগ্রি-লা অর্থাৎ মোট জাতীয় সুখের দেশ ভুটান নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে তার মোট জনসংখ্যার এক-ষষ্ঠমাংশ লোককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে।

মিয়ানমারের নাগরিকত্ব শুদ্ধি অভিযান স্টাইলে ভুটানও জতিগত শুদ্ধি অভিযান ‘এক জাতি, এক জনগণ’(ওয়ান নেশন, ওয়ান পিপল) নীতি হাতে নেয়। এর ফলে দেশটিতে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাসরত নেপালি ভাষাভাষী মানুষ যারা লোতশাম্পা নামে পরিচিত তারা ভয়ংকর পরিচয় সংকটের মুখে পড়ে, যেমনটি পরিচয় সংকটের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। মিয়ানমারে বসতিস্থাপনকারী রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষদের মতো লোতশাম্পাদের পূর্বপুরুষরাও কয়েক শতাব্দী আগে ভুটানের দক্ষিণাংশের নিম্নভূমিতে এসে বসতি স্থাপন করেছিলো। মিয়ানমারের জান্তা যেমন নাগরিক আইন সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়, তেমনি  ভুটানেও নাগরিকত্ব আইনের সংস্কার দ্বারা লোতশাম্পাদের নাগরিক হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। নাগরিক নয় বলে রোহিঙ্গাদের মতো লোতশাম্পাদেরও রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধাগুলোতে কোনো অধিকার নেই।

জাতিগত শুদ্ধিতার নামে নিপিড়নমূলক অভিযান শুরুর পরই লোতশাম্পারা সীমান্ত অতিক্রম করে চলে এসেছিল ভারতে। সেখানেও তাদের ঠাঁই মিলেনি। ভারতের সীমান্তরক্ষীরা তাদের ঠেলে দিয়েছিল নেপালে। ২৪ বছর ধরে লোতশাম্পারা শরণার্থী হয়ে নেপালের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করেছে। এ ২৪ বছরে ভুটান সরকারের নানা পর্যায়ের প্রতিনিধিরা নেপাল সফর করে লোতশাম্পাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য বার বার আশ্বাস দিলেও একজন শরণার্থীকেও ভুটান ফেরত নেয় নি। ২৪ বছর ধরে নানা টালবাহানার পর ভুটান সরকার শরণার্থী সমস্যা আরও দীর্ঘায়িত করার কৌশল হিসাবে যখন নেপালকে জানায় যে, জনগণের প্রতিনিধিরা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে তখন এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে শরণার্থীদের ফেরার আশা তলানীতে ঠেকেছে। অবশেষে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আন্তরিক প্রচেষ্টা শুরু করেন লোতশাম্পা শরণার্থীদের তৃতীয় কোন দেশে পুনর্বাসনের জন্য।

পরিসংখ্যান অনুযায়ি বিশ্বব্যাপী, শরণার্থীদের শতকরা এক ভাগেরও কম তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন হয়। এইদিক থেকে নেপালের লোতশাম্পা উদ্বাস্তুদের জন্য তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন কর্মসূচী খুবই ব্যতিক্রম। জাতিসংঘ কার্যালয়ের হিসাব মতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় এক লক্ষ ১১ হাজার লোতশাম্পা শরণার্থী যুক্তরাষ্ট্র,  অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পেয়েছে। তৃতীয় কোন দেশে পুনর্বাসনের পরও নেপালে ৮,৫০০ লোতশাম্পা শরণার্থী রয়েছে। ঝাপা জেলার ক্যাম্পে বসবাসরত এ আট হাজার ৫০০ শরণার্থীর জন্য কোন বিকল্প খুঁজে বের করতে পারেনি নেপাল সরকার ও ইউএনএইচসিআর। নেপালে থেকে যাওয়া শরণার্থীদের অনেকেই ভুটানে ফিরে যেতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র কেন, ভুটান বাদে পৃথিবীর কোথাও যেতে রাজি নন তারা। তাদের স্বপ্ন একটাই, মাতৃভূমিতে ফেরা। তারা বিশ্বাস করে তাদের জীবদ্দশাতেই এ সমস্যার সমাধান হবে এবং তাদেরকে ফেরানোর জন্য ভুটান তার সীমান্ত খুলে দেবে। ওখানকার সাথে তাদের নাড়ির সম্পর্ক। মনে করে, ওটিই তাদের দেশ; কায়মনে প্রার্থনা করে, মৃত্যুটা যেনো ভুটানে গিয়েই হয়। আবার অনেকে নেপালেই থেকে যেতে আগ্রহী। নেপালের সাথে ভুটানি শরণার্থীদের সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় বেশ মিল আছে।

ঝাপা ক্যাম্পের লোতশাম্পা শরণার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেপালি নাগরিকদের বিয়ে করেছে।  ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তাদের মতে ভুটানেই উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চললেও এটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা অবশিষ্টদের নেপালি সমাজে আত্নীকরণের কথা বলছে আকারে-ইঙ্গিতে। ইউএনএইচসিআর বলছে, তারা (ভুটানি শরণার্থীরা) সুশিক্ষিত, কঠোর পরিশ্রমী এবং নেপালি সমাজে পুরোপুরি অবদান রাখাতে প্রস্তুত।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ৯১-৯২ সালে যেসব রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে তারা লোতশাম্পাদের চেয়েও দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

রোহিঙ্গা ও লোতশাম্পা শরণার্থীদের মাঝে অনেক মিল থাকলেও লোতশাম্পা সমস্যা যেভাবে সমাধান হয়েছে রোহিঙ্গাদের সমস্যা সেভাবে সমাধানের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। লোতশাম্পা শরণার্থীদের সিংহভাগকে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসিত করা হলেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। একমাত্র কানাডা ছাড়া আর কোন রাষ্ট্রই রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের প্রধান অন্তরায় হলো তারা মুসলমান। আমেরিকার নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্য তছনছ হওয়ার আগে যে মানুষগুলোর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার ন্যূনতম নিশ্চয়তা ছিলো, সে মানুষগুলো সব হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অজানা আশংকায় মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় সমুদ্র পেরিয়ে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে শরণার্থীর মর্যাদা চেয়ে এক সীমান্ত থেকে আরেক সীমান্তে ভিক্ষুকের মতো যে হাত পাতলো তাদের প্রতি কেমন আচরণ করা হয়েছে সে কথা তো আমাদের অজানা নয়।

তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের সম্ভাবনা যদি খুঁজতেই হয় তাহলে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র সহযোগিতায় মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে। তবে সে সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। ভূমির দুষ্প্রাপ্যতা, মাত্রাতিরিক্ত  জনঘনত্ব, সম্পদের স্বল্পতা, কর্মসংস্থানের সংকট ছাড়াও রাজনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত ও নিরাপত্তাজনিত কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আত্নীকরণের সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব।

নিরাপদ ও টেকসই স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান। মিয়ানমারে স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে ও টেকসই সমাধান খুঁজে পেতে হলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, বাসস্থান ও জীবিকার ব্যবস্থা এবং জবরদস্তিমূলক কেড়ে নেওয়া সম্পদ-ভূমি ফেরতদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তবে সে সম্ভাবনার সামান্যতমও এখনও দৃশ্যমান নয়।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে গত ২৩ নভেম্বর একটি অ্যারেঞ্জমেন্ট সম্পাদিত হয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন ও এর কার্যপ্রণালী ঠিক করা হয় এবং সর্বশেষ ১৬ জানুয়ারি মাঠপর্যায়ের চুক্তি ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়। এর অর্থ হলো, প্রত্যাবাসনসংক্রান্ত সব ধরনের আইনগত প্রক্রিয়া শেষ। প্রায় সাত মাস আগে প্রত্যাবসনের সর্বশেষ আইনগত ধাপ মাঠপর্যায়ের চুক্তি সই হলেও এর পর আর কোন অগ্রগতি নেই। চুক্তি অনুযায়ি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ৮ হাজার শরণার্থীর তালিকা দেওয়া হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। তার মধ্যে মাত্র ৫০০ জনের পরিচয় যাচাই করে নিশ্চিত হওয়ার কথা জানিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।

প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পাদনের পর সাত মাস পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার ফেরত নেয়নি। তদুপরি, প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পাদনের পরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করেছে মিয়ানমার।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের পর থেকে মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয় নি। এমন কি ২০১৪ সালে মিয়ানমার সরকার ২,৪১৫ জনকে রাখাইনের বাসিন্দা বলে ফিরতে ‘অনাপত্তি সনদ’ দিলেও আজ অবধি তাদেরও ফেরত নেয় নি।

জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা মিয়ানমার সফর করে বার বার এ বার্তাই দিচ্ছেন যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের কোন পরিবেশ মিয়ানমারে এখনও তৈরি হয়নি। কেউ কেউ এও বলেছেন যে, শরণার্থীদের রাখাইনে নিজ বাড়িতে ফেরানোর কোনো ধরনের প্রস্তুতি তারা সেখানে দেখেননি বা শুনেননি।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক উপ মহাসচিব উরসুলা মুলার স্পষ্ট করেই বলেছেন, “সেখানকার পরিস্থিতি কোনোভাবেই ফেরার উপযোগী নয়।” মিয়ানমারের বাস্তব অবস্থার উধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, “আমি পরিস্থিতি নিয়ে সত্যিই উদ্বিগ্ন।”

এদিকে খবরে প্রকাশ রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা আবাদি জমি ইজারা দিচ্ছে মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমারের ইরাবতী পত্রিকা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা ৭০ হাজার একর জমির মধ্যে ১০ হাজার একর জমি ইতোমধ্যেই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে লিজ দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। তারা জানাচ্ছে বাকিগুলোও লিজ দেয়া হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টার ন্যাশনাল রোহিঙ্গাদের ফেলে যাওয়া গ্রামের উপগ্রহ চিত্র তুলে ধরে এ তথ্য দিয়েছে যে, সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে এখন তাদেরই ফেলে যাওয়া গ্রামে নানা স্থাপনা করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার প্রতারণার পাশাপাশি ‘চোর-পুলিশ’ খেলায় মেতেছে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হলে মিয়ানমারকে তোয়াজ-তোষামোদ করার পরিবর্তে একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার লজ্জা মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে।

ইতহাস সাক্ষ্য দেয়, অতীতে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লংঘনকারী রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কঠোর অবরোধ আরোপের পাশাপাশি জাতিসংঘ কাঠামোর মধ্যে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও এ্যাডহক ট্রাইব্যুনালে অপরাধীদের বিচার করে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রকে শায়েস্তা করেছে। আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করেছে। এমনকি কখনও কখনও আঞ্চলিক সামরিক জোটকে ব্যবহার করে শান্তিচুক্তি গ্রহণ করতে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রকে বাধ্য করার উদাহরণও রয়েছে।

সার্বদের বাধ্য করতে ১৯৯৫ সালে স্রেবরেনিৎসায় বসনীয় সার্বদের ওপর ও কসোভোয় জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানোর কারণে ১৯৯৯ সালে সার্বিয়ায় ন্যাটো বিমান হামলা চালিয়েছিলো।

মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো মিয়ানমারকে কে বাধ্য করবে এবং কীভাবে বাধ্য করা যাবে?

জাতিসংঘের বিবেচনায় এ গ্রহের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠি হলো রোহিঙ্গারা। যে জাতিসংঘ বলছে রোহিঙ্গারা এ পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠি, সে জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিভিন্ন পর্ষদের উর্ধতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর মগের বংশধরদের হত্যা, ধর্ষণসহ নানা বর্বরতার গল্প শুনেছেন, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের শরীরে নৃশংসতার চিহ্ন থেকে ব্যথিত হয়েছেন, ক্রন্দন করেছেন, নিরাপত্তা পরিষদে প্রকাশ্য ও রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। এমনকি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পাশাপশি জাতিসংঘ-মিয়ানমারের সমঝোতা চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো, মিয়ানমার সরকার ও জাতিসংঘের মধ্যে সই হওয়া গোপন চুক্তিতে দেশটিতে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কিংবা স্বাধীনভাবে চলাচলের কোনো নিশ্চয়তা নেই।

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক লরা হাই বলেন, মিয়ানমার সরকার ও জাতিসংঘের চুক্তি অনুযায়ি রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরার অর্থ হচ্ছে, তারা এমন একটি বর্ণবিদ্বেষমূলক রাজ্যে ফিরবেন, যেখানে তারা মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারবেন না। এমনকি তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও কর্মস্থলে যাতায়াতের সুযোগও থাকবে না।

রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পশ্চিমা কূটনীতিকদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নাগরিকত্বের যে আইনে রোহিঙ্গাদের কার্যত রাষ্ট্রহীন করে রাখা হয়েছে, তা পর্যালোচনার কোন প্রস্তাব আমলে নেয়া হবে না। তার মানে হলো,  নাগরিকত্বহীন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের বন্দীজীবনে ফেরার প্রত্যাবাসন চুক্তি এটি।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের প্রধান মোহিবুল্লাহ এ চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, এই চুক্তিটি নিয়ে আমরা বেজায় ক্ষুব্ধ। এতে রোহিঙ্গা পরিভাষাটি উল্লেখ নেই। তিনি জানান, আমরা এ সমঝোতা মানবো না। এর মানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ যাবতকালের সব দৌঁড়ঝাপের ফলাফল হলো বড়মাপের একটি শূন্য। বাংলাদেশকে প্রশংসা বন্যায় ভাসানো আর মিয়ানমারকে নখ-দন্তহীন হুংকার দেয়া ছাড়া জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন পর্যন্ত মিয়ানমারকে কোনো একটি সিদ্ধান্তও মানাতে বাধ্য করাতে পারেনি।

লোতশাম্পা শরণার্থীদের মতোই রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও বাংলাদেশে অবস্থান দীর্ঘতর হতে যাচ্ছে এটা বুঝতে রকেট বিদ্যার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশকে এ বাস্তবতা মেনে শরণার্থীদের দীর্ঘ অবস্থানের সাথে সম্পৃক্ত সকল সমস্যা বিশেষ করে নিরাপত্তা ও জঙ্গীবাদের হুমকিকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

নিরাপত্তা ও জঙ্গীবাদের প্রশ্নে রোহিঙ্গারা টাইমবোমার মতো। হিসাবে ভুল হলেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ হতে বাধ্য। ভ্রান্ত মতাদর্শে বিশ্বাসী এক শ্রেণীর মুসলিম রোহিঙ্গাদের জঙ্গীবাদে প্রলুব্ধ করতে, রোহিঙ্গাদের আত্ননিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে উস্কে দিতে ও আওয়ামীবিরোধী দেশি-বিদেশি একটি গোষ্ঠী রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা করতে রোহিঙ্গাদের ব্যবহারে সদা তৎপর রয়েছে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, উদ্বাস্তু জীবনের অসন্তুষ্টিসহ নানা কারণে  খুন, ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িযে পড়ছে রোহিঙ্গারা। গত আট মাসে ১৫ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা। এ ছাড়া ধর্ষণ, অপহরণ, চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, ডাকাতির মতো দেড় শতাধিক অপরাধে নাম এসেছে রোহিঙ্গাদের। এসব ঘটনায় এ যাবত ১৬৩ টি মামলা দায়ের হয়েছে। এ ছাড়াও ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ মাসে ৬০৭ জন রোহিঙ্গাকে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দুই থেকে আড়াই লাখ বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে চলে গেছে। ফলে স্থানীয় ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে সাময়িকভাবে রাজী হলেও রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার মোটেও আন্তরিক নয়। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের শত্রুতামূলক রাষ্ট্রীয় নীতির কোন পরিবর্তন না করে, রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন প্রায় অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, মিয়ানমার জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোন পদক্ষেপকেই মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না।

একথা সর্বজনবিদিত যে, অপরাধী মিয়ানমারের শক্তির উৎস চীন ও রাশিয়া। নিরাপত্তা পরিষদে ভোটো ক্ষমতার অধিকারী এ রাষ্ট্রদ্বয়ের সম্মতি ছাড়া জাতিসংঘের কাঠামোর মধ্যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ প্রায় অসম্ভব। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ অবস্থানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ, মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চতুর্মূখী চাপ সৃষ্টিতে তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া ও চীন-রাশিয়ার মানবতাবোধ জাগ্রত করতে বিরামহীন দেন-দরবার করা ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আর কোন পথ খোলা আছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: zhossain@justice.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর