করোনার বিস্তারে প্রবাসীদের প্রতি বিদ্বেষ

, যুক্তিতর্ক

আনিস আলমগীর | 2023-08-29 22:17:52

সেদিন এক রিপোর্টার তার দেখা ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ছাড়া এক বাসে ওঠা একজন প্রবাসীকে মালামালসহ নামিয়ে দিয়েছে অন্য যাত্রীরা। সত্যতা কতটুকু আমি জানি না। কিন্তু যদি তাই হয় এটি একটি নির্মম ঘটনা। কেউ করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছে কিনা নিশ্চিত না হয়ে মানুষ কীভাবে আরেকজনের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে! বড়জোর তার সঙ্গে দূরত্ব রাখতে পারে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এইসব খেটে খাওয়া মানুষগুলো আমাদের জন্য বছরে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স পাঠায়। আর নিজস্ব বিলাসবহুল গাড়িতে চড়া আমাদের শিক্ষিত শ্রেণি সেই টাকা ব্যাংক থেকে লুট করে বিদেশে পাচার করে।

গত দু’দিন ধরে ইতালি ফেরত প্রবাসীদের আচরণ নিয়ে নানা কথা বার্তা হচ্ছে, এর অনেকগুলো তাদেরকে আক্রমণ করে। নীল জামার কোন ছেলে কি বলেছে সেটার ভিডিও ছেড়ে প্রবাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। তাদেরকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখার দাবি উঠেছে। একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখলেন, ‘ইতালি থেকে ১২৫ জন পালিয়ে এসেছে। একটাকেও বাড়িতে পাঠানো যাবে না।’ তার স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট পাঠিয়ে আরেক স্বনামধন্য সাংবাদিক জানতে চাইলেন, উনিসহ একদল সাংবাদিক ভারত ভ্রমণ করে এসেছেন, উনাদেরকে কেন ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে না।

এর মধ্যে রোববার (১৫ মার্চ) পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের একটি মন্তব্য প্রবাসীদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ আলোচনা হচ্ছে এটা নিয়ে। আশকোনা হজ ক্যাম্পে শনিবার প্রবাসীদের বিক্ষুব্ধ আচরণের সমালোচনা করে মন্ত্রী বলেন, ‘হজ ক্যাম্পে যাদের রাখা হয়েছে আমরা তাদের পর্যটন করপোরেশন থেকে খাবার দিয়েছিলাম, তারা পছন্দ করেননি। তারা মনে করেন সোনারগাঁ হোটেল থেকে, ফাইভস্টার হোটেল থেকে তাদের খাবার দেয়া উচিত। আমরা সেটা দিতে পারিনি। সেজন্য তারা অসন্তুষ্ট হয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, প্রবাসী বাঙ্গালীরা দেশে আসলে নবাবজাদা হয়ে ওঠেন। তখন তারা ফাইভস্টার হোটেল না হলে অপছন্দ করেন। তাদের বুঝতে হবে এটা একটা বিশেষ অবস্থা।

যাক, প্রবাসীদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ভাষায় কিছু বলার আগে আমাদের ভাবতে হবে দেশটা সবার। তারও আগে জানা দরকার সমস্যাটা হয়েছে কোথায়! করোনা জোরে সোরে শুরু হয়েছে মধ্য জানুয়ারি থেকে। আমাদের কিছু শিক্ষার্থী যারা চীনে আটকা পড়েছিল, তাদেরকে ফিরিয়ে এনে সরকার প্রশংসাও পেল। কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করলো। কিন্তু আমাদের করোনা প্রস্তুতি কি যথেষ্ট ছিল? এতদিন পরও আমরা কেন কোয়ারেন্টাইনের জায়গাগুলো ঠিক করতে পারলাম না। করলেও তাকে বাসযোগ্য করতে পারলাম না। সন্দেহভাজন রোগীদের জন্য নিয়মকানুন ঠিক করতে পারলাম না। আর যদি পেরে থাকি তাহলে কোয়ারেন্টাইনে যেতে প্রবাসীদের আপত্তি থাকবে কেন! তারা কেন হাসপাতাল থেকে পালাবেন! তারাতো জেনেশুনে দেশে আসছেন। এখানে এসে আত্মীয়-স্বজন, দেশবাসীর মধ্যে ভাইরাস ছড়ানোতো তাদের উদ্দেশে হতে পারে না।

সমস্যা হচ্ছে, এই লোকগুলোর দেশে আসা এখন যেমন জরুরি না, আবার আসার আগে আমরাও তাদেরকে সে বার্তা দিতে পারিনি। দেখুন, সারাবিশ্ব যখন একের পর এক দরজা বন্ধ করছিলো আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন সেটাকে ‘মিডিয়ার বাড়াবাড়ি’ ভেবে আরও অপেক্ষার পলিসি নিতে চেয়েছেন। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করলেও বাংলাদেশ ভিসা দেওয়া স্থগিত করবে না- সিদ্ধান্ত এমন ছিল।

ভারত বাংলাদেশসহ অন্যান্যদের জন্য ভিসা বন্ধ করে দেওয়ার পর আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করেছিলাম বাংলাদেশ বেশি আক্রান্ত দেশসহ যারা আমাদের ভিসা বন্ধ রেখেছে তাদের ক্ষেত্রেও একই পলিসি নিবে। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণায় বিস্মিত হয়েছি।

গত বৃহস্পতিবার (১২ মার্চ) মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে এক বৈঠকের পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, প্রতিবেশী দেশ ভারত ও শ্রীলংকা ভিসা দেওয়া স্থগিতের ঘোষণা এলেও বাংলাদেশ এর প্রয়োজন দেখছে না। প্রতিবেশী দেশগুলো ভিসা প্রদান স্থগিত করলেও বাংলাদেশ কেন করছে না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন নেই। আমার মনে হয় মিডিয়ার কারণে (করোনাভাইরাসের) ভীতি বেশি ছড়াচ্ছে। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে পেনিডেমিক (বৈশ্বিক মহামারি) ঘোষণা করায় হইচই শুরু হয়েছে। কিন্তু যদি দেখেন শতাংশ হারে মৃত্যুর সংখ্যা অত্যন্ত কম। অধিকাংশ ভালো হয়ে যাচ্ছে। এটি সর্দি-জ্বরের মতো। এ অবস্থায় আমরা আতঙ্কিত হবো কেন?’

শুধু তাই নয়, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চারটি দেশের অন অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ করার ঘোষণা দেয় সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। দেশগুলো হচ্ছে, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ইরান ও ইতালি। গত ৪ মার্চ এই ঘোষণা দেয় আইইডিসিআর'র পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই নিয়েও চটে যায়। পত্রিকায় খবর আসে, করোনা ভাইরাসের কারণে জাপানিদের অন অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এককভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তে বিব্রত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন বলে মনে করেন ওই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

সোমবার (৯ মার্চ) স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত করোনাভাইরাস জাতীয় কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি উত্থাপন করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের ঘোষণার একটি কূটনৈতিক ফলাফল আছে। সেগুলো বিবেচনায় না নিয়েই এককভাবে অন্যরা বিদেশ সম্পর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে আমরা বিব্রত হই কারণ বিদেশি কূটনীতিকরা অন্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না, তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাদেরকে আমাদের জবাব দিতে হয়।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু এমন একটা কঠিন সময়ে পররাষ্ট্র বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একক সিদ্ধান্তের বিষয় নয়, দরকার ছিল যৌথভাবে এটিকে নিয়ে মনিটর করা, সিদ্ধান্ত দেওয়া। এখানে এই দুই মন্ত্রণালয়ের বাইরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও ভূমিকা রয়েছে। ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আসল কর্তৃত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তারা থাকবে না কেন বৈঠকে!

অবশেষে, সারা বিশ্ব যখন ভিসা বন্ধ করা শেষ করেছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী শনিবার (১৪ মার্চ) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত এক জরুরি ব্রিফিংয়ে জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশের কোনো উড়োজাহাজ বাংলাদেশে আসবে না। ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে আসা ফ্লাইট বন্ধের এই নিষেধাজ্ঞা ৩১ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। ১৫ মার্চ রোববার মধ্যরাত থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ যেসব দেশের নাগরিকদের অন অ্যারাইভাল বা আগমনী ভিসা দিয়ে থাকে, তা ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।

এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘অনেক দেশই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে যাত্রী প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। আমরাও যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের বাকি দেশগুলোর সঙ্গে যাতায়াত বন্ধ করে দেব। আর যেসব দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, সেসব দেশ থেকে কেউ বাংলাদেশে এলে তাদের বাধ্যতামূলকভাবে দুই সপ্তাহের জন্য কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। এ ছাড়া যেসব দেশ করোনার কারণে বাংলাদেশ থেকে যাত্রীদের ঢুকতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেসব দেশ থেকে যাত্রীদের বাংলাদেশে ঢুকতেও নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা হবে স্বল্প সময়ের জন্য।’

এর মানে দাঁড়ালো সিদ্ধান্ত তারা নিলেনই, কিন্তু জল ঘোলা করে আর গ্যাঞ্জাম লাগিয়ে। যেসব প্রবাসী বাইরে আছে তাদেরকে না আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ঘোষণাটি যদি আগে আসতো তাহলে প্রবাসীদের ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। তারাও স্ব স্ব অবস্থানে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারতো।

যেসব দেশে করোনা আক্রমণ করেছে সেখানে এখন শ্রমিকরা প্রায় বেকার। গ্রিসসহ ইউরোপের অনেক দেশ বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাকরি বন্ধ করে দিয়েছে বলে জেনেছি। এরা এখন কোথায় যাবে? একদিকে তাদের দেশে ফেরা অনিশ্চিত, ভোগান্তি এবং আসাও হবে ভুল সিদ্ধান্ত, আবার তারা পড়ছে আর্থিক সংকটে। তাদের পাঠানো অর্থ বন্ধ হবে বলে দেশ পড়বে রেমিটেন্স সংকটে। তাহলে এখানে আর প্রবাসী, দেশি বিষয় নেই। সবাই বাংলাদেশি। সংকটে পড়ছি আমরা বাংলাদেশিরা, বাংলাদেশ। তাই তা মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশি হয়ে।

আমরা ভুক্তভোগী হচ্ছি তার আরও কারণ, সবকিছুতে আমাদের ধীরগতি ও সিদ্ধান্তহীনতা। মন্ত্রী আর মন্ত্রণালয়গুলো ঠুঁটো জগন্নাথের আচরণ করছেন। মন্ত্রীরা বেসুরে কথা বলছেন। তাদের জন্য সব কিছুতে দরকার হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ। আবার কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের মতো কিছু আমলা ভাবছেন, চেয়ার পেয়ে তারা দেশের মালিক, জনতা তাদের প্রজা। গভীর রাতে সাংবাদিককে বাসা থেকে তুলে এনে মদ, গাঁজা দিয়ে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে জেলে ঢুকানো যায়।

আনিস আলমগীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর