বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ডে পরিণত করতে চাই: বঙ্গবন্ধু

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 13:24:40

বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতার সংগ্রামের মূল চেতনাকে ধারণ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করেন, যাতে আবশ্যিকভাবে এবং কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল ঠাণ্ডা লড়াইয়ে আকীর্ণ ও বিভাজিত তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার। আর ছিল, বাংলাদেশকে প্রাচ্যের শান্তির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির স্থপতি হিসেবে তিনি যে ঐতিহাসিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু বৈদেশিক নীতি প্রণয়নকালে যে বিবৃতি দেন, তাতেই বিম্বের বুকে বাংলাদেশের স্বচ্ছ, স্বতন্ত্র এবং আত্মমর্যাদাপূর্ণ অবস্থান স্পষ্ট হয় এবং পররাষ্ট্র নীতির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শ মূর্ততা লাভ করে।

বঙ্গবন্ধু ঠাণ্ডা লড়াইয়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় বিশ্বে বাংলাদেশকে শান্তির মডেলে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়, এই নীতিতে আমি বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ডে পরিণত করতে চাই।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমরা সকলের বন্ধুত্ব প্রত্যাশী…বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক, কোনও ব্যাপারেই কোনও বহিঃশক্তির আদেশ-নিষেধ গ্রহণ করবে না।’

তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির সংঘাতময় বাস্তবতায় নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক মুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে বিরাজমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ছিল পরিস্কার উপলব্ধি। স্বাধীন রাষ্ট্রে জাতি গঠনের লক্ষ্যে এবং বাধাহীনহীন বিকাশের স্বার্থে তিনি সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এজন্য তিনি সাবেক পাকিস্তানের আমলে গৃহীত সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গাইজেশনের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন, যে সংগঠন বা সামরিক জোট ছিল সম্পূর্ণভাবে মার্কিন সাহায্যপুষ্ট মোর্চা।

সাম্রাজ্যবাদী জোটের বলয় থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্য জোট নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো আন্তর্জাতিক উত্তেজনার তীব্রতা কমিয়ে নিজেদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগ করে নিয়েছে। তিনি এটাকেই তার বৈদেশিক নীতির মূল ভিত্তি প্রস্তর হিসেবে চিহ্নিত করেন।

তিনি বলেন, ‘আমার সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষ নীতিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু এই জোট নিরপেক্ষ নীতি বলতে আমরা কোনও নিষ্ক্রিয় বা পরোক্ষ নীতি বুঝাচ্ছি না। আমরা জাতিসংঘের কাছে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার উন্নয়নের ব্যাপারে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখার প্রস্তাব করছি।’

জোট নিরপেক্ষ নীতিই বঙ্গবন্ধুর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীন বৈদেশিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন রূপে গৃহীত হয়। তিনি বাংলাদেশকে কোনও নির্দিষ্ট বৃহৎ শক্তির ছত্রছায়ায় রাখতে চাননি। বরং স্বাধীনতা আন্দোলনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে প্রয়াসী হন।

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষ নীতি শান্তি অর্জনে এবং জাতীয় উন্নয়নের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে যথেষ্ট সহায়ক হবে। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন পেরিয়ে জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য তিনি তাই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেন এবং জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতিতে অবিচল থাকার কারণে বঙ্গবন্ধুকে নানা ধরনের চাপের সম্মুখীন হতে হলেও তিনি তার নিরপেক্ষ অবস্থানের সঙ্গে আপস করেন নি।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন তৎকালীন বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর রক্তাক্ত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে একজন নির্ভীক শান্তিদূত। আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অটল ও অবিচল। আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে তার অবদান ও বিশেষ তৎপরতার জন্য তাকে ১৯৭২ সালে ‘ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল’র পক্ষ থেকে ‘জুলিও কুরি পদক’ প্রদান করে সম্মানিত করা হয়। তিনি শুধু শান্তির বাণী প্রচার করেন নি, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় নিরলস ভূমিকা পালন এবং বিশ্বের মুক্তিকামী জাতিসমূহের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু অ্যাঙ্গোলা, গিনিবিসাউ, মোজাম্বিকের স্বাধীকার আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুই ও নামিবিয়ায় সংগঠিত বর্ণ-বৈষম্য নীতি এবং সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়ান।

১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে ভাষণদানকালে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক স্বাধীনতা সংগ্রাম হলো শান্তি ও ন্যায়বিচার আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্ব সংগ্রামেরই প্রতীক। এটা খুবই সঙ্গত ও স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।…এ সংগ্রাম আগ্রাসনের মাধ্যমে বেআইনীভাবে ভূখণ্ড দখলের বিরুদ্ধে, সাধারণ মানুষের অধিকার অস্বীকার করার বিরুদ্ধে এবং বর্ণবৈষম্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে।’

শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি তার সমর্থন জানিয়ে ইসরাইলের বেআইনী আগ্রাসনেরও তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কম্বোডিয়ার উপর বোমা বর্ষন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। বাংলাদেশের স্বাধীনত সংগ্রামের কথা মনে রেখেই তিনি দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাধীনতার সংগ্রামরত জনতার প্রতি সমর্থন দানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বৈদেশিক নীতি কতিপয় সুস্পষ্ট মৌলিক নীতির ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা, জোট নিরপেক্ষ নীতি, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সংহতি, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব, সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সঙ্গে সুন্দর ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি বিষয় ছিল তার বৈদেশিক নীতির কেন্দ্রস্থলে। প্রকৃতপক্ষে, এসব নীতি ছিল, গণতন্ত্র, মানবিক নৈতিকতা ও গণমুখী মনোভাবের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক আদর্শেরই বহিঃপ্রকাশ, যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনভাব জেল-জুলুম-নিপীড়ন সহ্য করেও সংগ্রাম করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর এই সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যেই নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব পরিমণ্ডল একটি সম্মানজনক স্থান লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার জন্যই বাংলাদেশ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অগ্রণী অবস্থান অর্জন করে এবং আত্মমর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

সদ্য-স্বাধীন নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সাফল্য নিশ্চিত হয়েছিল বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি প্রণয়নে বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বের কারণে। তিনি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি হিসেবে সাফল্যজনক বৈদেশিক নীতির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল চালিকা শক্তি।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর

বার্তা২৪.কম, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর