এই লেখাটি ধীরে পড়ুন... কেন? তবে শুনুন

, যুক্তিতর্ক

মাহমুদ মেনন | 2023-08-31 07:00:29

ডিজিটাল যুগে আমরা সবকিছু ভাসা ভাসা পড়েই ক্ষান্ত থাকি। প্রযুক্তিই আমাদের মনোযোগী হতে দেয় না। বরং কোনকিছু ধীর লয়ের পাঠ করতে নিরুৎসাহিত করতে থাকে। এই যে মিনিস্ক্রিনে বুড়ো আঙুলের ছোট ছোট ধাক্কায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে চলেন, আর কিছুই পড়েন না, মানে গভীর পাঠ বলতে যা বুঝায় তা করতে অনীহা কিংবা অমনোযোগিতার চূড়ান্ত প্রকাশ করে ছাড়েন; তার পেছনে একটাই কারণ, আপনার চোখদুটো কোথাও ঠিক আটকায় না। এক জায়গায় চোখ স্থির রাখতে পারেন না। বিশেষ করে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনেতো নয়ই। সুতরাং অনলাইনে পাঠ মানেই ভাসা ভাসা। কিন্তু কেন?

অনলাইনে সবকিছুই সংক্ষেপিত। সংক্ষিপ্ত মনোযোগিতার যুগে, কোনো কিছুতেই মানুষ দীর্ঘক্ষণ মনটাকে ধরে রাখতে পারে না। পাঠে তো নয়ই, প্রতিক্রিয়াতেও নয়। সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে এই প্রতিক্রিয়ার সংক্ষেপ রূপ আমরা দেখতে পাই। অনেকেই স্রেফ ইমোটিকনে কাজ সারেন। লাইক, ডিজলাইক, ওয়াও, স্যাড ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার এক কাঠি সরেশ- এরা লেখাটি শেয়ার করেন, কিন্ত পড়েন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেই আমরা আমাদের লেখালেখি ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছি। কিন্ত সেখানে পাঠক যদি আপনার লেখা না পড়ে টিএল;ডিআর লিখে দেয়, তার চেয়ে কষ্টের আর কীই-বা হতে পারে। হ্যাঁ সম্প্রতি একটি কথার এই সংক্ষিপ্ত রূপটিতে চোখ আটকে গেলো বলেই এই লেখার অবতারণা। শব্দটি ছিলো- টিএল; ডিআর, যার পূর্ণাঙ্গ রূপ দাঁড়ায় টু লং; ডিডন্ট রিড। ইন্টরেস্টিং ইনডিড।

গ্রাফিক্স: বার্তা২৪.কম

আমরা যারা অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোর ভেতরে থেকে কাজ করে আসছি দীর্ঘদিন, তারা দেখেছি, কোনো একটি পোস্ট ফেসবুকে শেয়ার দেওয়া হয়েছে হয়তো অনেক বেশি,  এমনকি সংখ্যায় সর্বোচ্চও  কিন্ত তা সর্বাধিক পাঠে এলো না। তাতে কী দাঁড়ালো, আগ্রহ পেলে পাঠক পড়বে, সেই আপ্তবাক্যটিও এখানে কাজ করলো না। আমরা এও দেখতে পাই, ওয়েবসাইটে পাঠকের সেশন ডিউরেশন পাঁচ মিনিটের বেশি মেলাই দুষ্কর। আবার বাউন্স রেট অনেক বেশি। মানে পাঠক এসেই ফিরে যায়। এসবই পাঠকের শর্ট স্প্যান অব অ্যাটেনশন (স্বল্পমাত্রার মনোযোগিতার) ফল। সুতরাং আপনার ওয়েব আর্টিকেলের পাঠের সময় ওই ৫-৬ মিনিটের মধ্যেই সীমবদ্ধ রাখা শ্রেয়। কিন্তু কেন? এমন প্রশ্ন করতেই পারেন। পাঠক পড়বে না বলে আমরা লিখবো না? লেখারই যদি প্রয়োজন থাকে, আর্টিকেল বড় হতেই পারে। এই আর্টিকেলটিও কলেবরে বড়ই হচ্ছে... হয়তো সেই ফিফটিন মিনিটস রিড’ই। তাই বলে পড়া বন্ধ করবেন না যেন।

টিএল; ডিআর বিষয়টি একটু বেশিই মনোযোগিতা পেলো। ফলে একটু গুগল করে, এ নিয়ে আরও কিছু পাঠের চেষ্টা করে যা মিললো সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

‘বোধ’ সম্পর্কিত স্নায়ুবিজ্ঞানী যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ম্যারিয়ান উল্ফ পাঠকের এই নতুন পাঠাভ্যাস দেখে বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে বলেছেন, ভীষণরকম ওলট-পালট ঘটে গেছে। আর যা ঘটেছে, তা স্রেফ সকলের অগোচরে। তবে তিনি এর একটি ব্যাখ্যাও দাঁড় করিয়েছেন। বলেছেন- মনোযোগী হয়ে পাঠের সক্ষমতা তৈরি করে মস্তিষ্কের যে স্নায়বিক সার্কিট, তা এখন গভীর পাঠে তথ্য অনুধাবনের বদলে দ্রুতপাঠে তথ্যগুলো গোগ্রাসে গিলতে চায়। ফলে পাঠে বা পাঠকৃত বিষয়ের জটিল বিশ্লেষণগুলো সঠিক সহমর্মিতায় তাদের পক্ষে উপলদ্ধি করা সম্ভব হয় না।

গ্রাফিক্স: বার্তা২৪.কম

ওদিকে উল্টো মতও আছে। দ্য গার্ডিয়ানে এ নিয়ে কলামিস্ট জো মোরান এক আর্টিকেলে এই বিপদে এক্কেবারে হা-হুতাশ না করার পক্ষেই মত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সঙ্কট নতুন কিছু নয়। এক্কেবারে গোড়াতেই গলদ। তার মতে, সব পাঠকই আ‌সলে ভাসা ভাসা পাঠ করে। তার শুরু হয় খুব ছেলেবেলা থেকেই। তখন থেকেই আমরা পাঠে কমবেশি অমনোযোগিতা দেখাই। মনস্তত্বের দোহাই দিয়েই তিনি বলেছেন, শুরুটা হয় নয় বছর বয়স থেকে। তখন পাঠের বই, তা যত মজারই হোক না কেন, পড়তে গিয়ে শিশুর চোখ এদিক ওদিক ছুটে যায়। ফলে মনোযোগও সরে যায়। আর তাতে তারা যেটুকু পাঠ করে তার মধ্যে মোটে চার ভাগের একভাগই পড়া হয়, বাকিটুকু ছুটে যায়। আর পরে তা স্রেফ অনুমান করে মিলিয়ে নেয়। আর যারা নিরব পাঠক, তারাতো, পড়াতেই ফাঁকি মারে। এবং না পড়া অংশটুকু অনুমানে মিলিয়ে নেয়। ফলে এই ভাসা ভাসা পাঠ এক মজ্জাগত মানব আচরণ।

তবে তারপরেও ইন্টারনেট যে পাঠকের মনোযোগিতা কেড়ে নিয়েছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। এখানে ঘটে গেছে আরেক বিপদ, আগে মানুষ পড়তো বেশি, আর লিখতো কম মানুষ। কিন্তু এখন লিখিয়ের অভাব নেই। ফেসবুকের কল্যাণে তো বলা যায়, সবাই লেখক। অল্প কিংবা বিস্তর। অন্যদিকে মানুষের পাঠাভ্যাসে ঘাটতি পড়ে গেছে। সংখ্যায় বাড়লেও তাদের বলা চলে কেউই আর নয় মনোযোগী পাঠক।

এনালগ যুগে, আরেকটি বিষয় ছিলো, লেখা হয়ে গেল তার অনেক পড়ে পাঠক তা পড়ত। এখন ডিজিটাল যুগে, লেখা যা কিছু হয়, পাঠক তখুনি তা পড়ে নেয়। পড়াতো নয়! এ যেন গোগ্রাসে গিলে খাওয়া। ফেসবুকে লেখা স্ট্যাটাস কিংবা টুইটারে করা টুইট দিতে দেরি নেই, নিমিষেই হয়ে গেলো শত পাঠ। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়াও। এতো পাঠ নয়, যেন কথোপকথন। সামাজিক মাধ্যম ছাড়াও অনলাইনগুলোতে কোনও আর্টিকেল প্রকাশিত হলে তার নিচে মন্তব্য করার সুযোগ থাকে। ফলে এই ধরনের লেখায় পাঠক যতটা না পড়তে চায়, তার চেয়ে অনেক বেশি করে চায়, এর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে। কিছুক্ষণেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে আর্টিকেলটি যতটা না পঠিত হয়েছে, তার চেয়ে সেটি নিয়ে কথা হয়েছে অনেক বেশি। আর সেসব কথায় কিংবা মন্তব্যেই অনেক পাঠক  আর্টিকেলটি পাঠে তার অমনোযোগিতারই প্রমাণ রেখে যায়।

সে সব কারণেই বোধ হয় বলার সময় এসেছে- থামো, রোসো, ধীরে হাঁটো। মানে ধীরে পড়ো। শান্ত হয়ে পড়ো, তথ্যগুলো স্রেফ গিলো না, অনুধাবনের চেষ্টা করো।

বলাই বাহুল্য, নতুন নতুন প্রযুক্তিই মানুষের এই পাঠের অনীহা তৈরি করেছে। তবে সেটা নিতান্তই যুক্তিহীন।

প্রযুক্তিগত পরিবর্তন মানুষের হাত থেকে বই কেড়ে নিয়েছে। তাদের ভার্চুয়াল পাঠের হাতছানি দিচ্ছে। তাতে ক্ষতি কি? কাগজের বই হাতে নিয়ে পড়ার চেয়ে কিনডল থেকে বই পড়াই যায়। পুরনোর সঙ্গে নতুন এই প্রযুক্তি খাপ খাইয়ে নিতেই পারে। কিনডল এসে ছাপার বইকে তো একেবারে শেষ করে দেয়নি। এখানে পাঠটাই আসল কথা। তা হোক ছাপায়, কিংবা ভার্চুয়ালে। প্ল্যাটফর্ম যেটাই হোক, আর সময় যতো দ্রুতই গড়িয়ে যাক না কেন, আমাদের পাঠ হতে হবে ধীর, গভীর ও যথার্থ অনুধাবনের।

জানিনা, লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়লেন কিনা! নাকি অনেক আগেই টিএল;ডিআর লিখে সটকে পড়েছেন। যারা পড়লেন, তাদেরকে ধন্যবাদ।

লেখক: মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর