করোনা: আসুন ইগনাজ সেমেলুইসকে ধন্যবাদ জানাই

, যুক্তিতর্ক

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক | 2023-08-23 22:52:36

দুই দিন ধরে গুগলের ডুডলে একটি ছবি ভাসছে। ছবিটি ইগনাজ সেমেলুইসের। সাথে হাত ধোয়ার অ্যানিমেটেড কিছু দৃশ্য। যখন গোটা বিশ্ব কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে তখন এমন একটি ছবি কেন সামনে আনলো গুগল? আর কে এই ইগনাজ সেমেলুইস?

তাকে বলা হয়, সংক্রমণ নিরোধের জনক। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন হাত ধোয়ার গুঁড়া সাবান। সেই ১৮৫০ এর দশকে তার সেই জীবনদায়ী উদ্ভাবন আজও স্মরণীয়। সেমেলুইস যেমন ছিলেন পথপ্রদর্শক, তেমনি একজন বিদ্রোহীও। সমসাময়িকদের ব্যাপক সমালোচনা আর হেনস্তার মুখে তিনি পড়েছিলেন বটে কিন্তু তিনিই স্থাপন করেছিলেন আধুনিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ভিত। তার মুখেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিলো, হাত ধুলে রোগ প্রতিরোধ হয়।

আজ থেকে শতবর্ষ আগেই মৃত্যু হয়েছে সেমেলুইসের। কিন্তু মানব স্বাস্থ্য রক্ষায় তার নেওয়া হাত ধোয়ার বিপ্লব আজও অব্যাহত রয়েছে।

সেমেলুইসের নেওয়া হাত ধোয়ার অভ্যাস পরবর্তী পৃথিবীতে কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে, তাতে সন্দেহমাত্র নেই। আর আজ গোটা বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞান যখন কোভিড-১৯ এর মতো ভয়াবহ ভাইরাসের চ্যালেঞ্জে জেরবার তখন সেই হাত ধোয়াকেই বলা হচ্ছে এই জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধানতম অস্ত্র।

১৮১৮ সালে জন্ম নেওয়া এই হাঙ্গেরীয় চিকিৎসক অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার একটি হাসপাতালে কাজ করতে করতেই এই হাত ধুলে রোগ নিরোধ হওয়ার বিষয়টি প্রথম অনুধাবন করেন। সেমেলুইস লক্ষ্য করলেন, হাসপাতালের চিকিৎসক কিংবা মেডিকেল শিক্ষার্থীদের হাতে যেসব বাচ্চা প্রসব হচ্ছে সেসব নবজাতক কিংবা মায়েদের জ্বর হওয়া ও পরে মারা যাওয়ার হার ধাত্রীমা কিংবা প্রশিক্ষণার্থী ধাত্রীদের হাতে প্রসব হওয়া নবজাতক কিংবা মায়েদের মৃত্যুর হারের চেয়ে তিনগুণ বেশি। একটু খোঁজ নিয়ে দেখলেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা একের পর এক রোগীর সেবা দেন, মরা ঘাঁটেন, ময়নাতদন্ত করেন, ঘাঁ ইত্যাদিতে হাত দেন, আবার সেই হাতেই সন্তান জন্ম প্রক্রিয়ায় গিয়ে অংশ নেন। মাঝে হাত ধুয়ে নেওয়ার সুযোগ পান না, প্রয়োজনও বোধ করতেন না। ফলে চিকিৎসকের হাতে বয়ে আনা ব্যাকটেরিয়া কিংবা জীবাণুতেই অন্য রোগীরা বিশেষ করে প্রসূতি মায়েরা সংক্রমিত হন এবং একটি বিশেষ রোগে মারা যান, যাকে বলা হতো সন্তানপ্রসবজনিত জ্বর (পারপেরাল ফিভার)।

 গুগলের ডুডলে ইগনাজ সেমেলুইস/গ্রাফিক্স-বার্তা২৪.কম

সেমেলুইস বিষয়টি বুঝতে পেরে হাসপাতালের চিকিৎকদের ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের অনেকটা বাধ্য করলেন, প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসা দেয়ার আগে হাত ধুয়ে নিতে। আর হাত জীবাণুমুক্ত করতে ক্লোরিনযুক্ত লাইম ব্যবহার করতেও বললেন। ধীরে ধীরে সেটাই হয়ে উঠলো জীবনরক্ষাকারী এক অভ্যাস। সেমেলুইসের উদ্যোগে তখন থেকে সন্তান প্রসবকালে ব্যবহৃত চিকিৎসা সামগ্রীও কাজটি করার আগে ও পরে উভয় ক্ষেত্রেই ধুয়ে নেওয়ার প্রচলন হলো।

এতে যে সেমেলুইসকে বাহবা দেওয়া শুরু হলো তা নয়। বরং সে সময়ের মেডিকেল ব্যবস্থা তার দেওয়া এই পন্থা বাতিল করল। এমনকি হাসপাতালটি সেমেলুইসের চাকরির মেয়াদটাও নবায়ন করল না। ফলে হাসপাতালটি তাকে ছাড়তে হলো। পরে আরেকটি হাসপাতালে কাজ নিলেন। সেখানেও হাত ধোয়ার লড়াই শুরু করলেন। এখানে তার অল্প-বিস্তর সাফল্য এলো বটে, কিন্ত অধিকাংশ চিকিৎসক তখনও ‘‌মিয়াজমা তত্ত্বে’ বিশ্বাস করতেন। ধারণা করা হতো এক ধরনের বিষাক্ত বাতাস থেকেই এই রোগের সৃষ্টি।

সেমেলুইস কিন্ত তার পরবর্তী জীবনের গোটাটাই পার করে দিলেন, মানুষের মধ্যে সুস্থ থাকার জন্য যে পরিচ্ছন্নতা জরুরি, সেই ধারণা দিতে। কিন্ত খুব যে সফল হয়েছিলেন, তা নয়। পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি মানুষের কাছে গুরুত্ব পেতে আরও সময় লাগল।

সেমেলুইসের মৃত্যুর দুই দশকেরও বেশি সময় পর লুই পাস্তুর যখন জীবাণুতত্ত্ব আবিষ্কার করলেন তখন বিষয়টি মানুষের বোধগম্যতায় পৌঁছাল। পাস্তুরের সঙ্গে ছিলেন জোসেফ লিস্টার ও রবার্ট কচ। তাদের সেই আবিষ্কার প্রমাণ করল হাত ধোয়ার সঙ্গে রোগ প্রতিরোধের একটা সম্পর্ক রয়েছে এবং সেমেলুইসই সঠিক ছিলেন।

জীবাণুতত্ত্বই জানাল, রোগের অতি প্রাথমিক কারণই কোনও না কোনও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু, ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়া। আজ শতবর্ষ পরেও সেই তত্ত্বটিকেই গ্রহণ করে আসছে চিকিৎসা বিজ্ঞান। তবে হাত ধোয়ার বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে স্বীকৃত অনুসঙ্গ হতে সময় লেগেছে আরও বেশি। ১৯৮০’র দশকে যখন খাদ্যবাহিত রোগ ও স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত সংক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল, তখন ইউনাইটেড সেন্টারস ফর ডিজিস কন্ট্রোল প্রথমবারের মতো পরিচ্ছন্নতার নির্দেশিকা প্রকাশ করল। যার মধ্যে হাত ধোয়া ছিলো অন্যতম। 

আজতো আর চিন্তাই করা যায় না, কোনও সার্জন তার হাত না ধুয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকবেন, কিংবা অস্ত্রোপচার শেষে নিজের হাত ধুয়ে নেবেন না।

হাসপাতাল থেকে এই হাত ধোয়ার অভ্যাসও অনেক আগেই সাধারণ মানুষের জীবনধারায় যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে খাবারের আগে হাত ধুয়ে নেওয়া এখন সাধারণের অভ্যাস। আর বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই হাত ধোয়াকেই দেখা হচ্ছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ কিংবা অভ্যাস হিসেবে।

পরের বার যখন সাবান মেখে হালকা গরম পানিতে ২০ সেকেন্ড ধরে ডলে ডলে নিজের হাত দুটি ধুবেন, ইগনাজ সেমেলুইসকে ধন্যবাদ দিতে ভুলবেন না যেন।     

লেখক: মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক   

এ সম্পর্কিত আরও খবর