রিমোট ওয়ার্কে সকলের জন্য শুভকামনা

, যুক্তিতর্ক

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক | 2023-08-31 07:02:37

রিমোট ওয়ার্ক কথাটি এখন হয়তো অনেকেই নিচ্ছেন, অনেকে এখনো নিতে পারছেন না। কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ করা- অফিসের নিয়মিত, গতানুগতিক পরিবেশের বাইরে গিয়েও ঠিকঠাক কাজ চালিয়ে নেওয়া- সে এখন অনেক পুরোনো কথা। বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতায় আমরা এক দশক ধরেই এর চর্চা করে আসছি। এবং ফলপ্রসুূভাবেই করছি।

শুরুর দিকের একটা গল্প বলি। ২০১০ সালের জুলাইয়ে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম যখন যাত্রা শুরু করে, তার ঠিক ছয়-সাত মাসেই অনলাইন সংবাদমাধ্যমটির প্রথম পিকনিক হলো মধুপুর-ভাওয়াল বনে। পিকনিকের আওয়াজে কর্মীরা সবাই খুশি। কিন্তু বার্তা সম্পাদক (আউটপুট এডিটর) হিসাবে আমার দুঃশ্চিন্তা, যেখানে প্রতি মুহূর্তের খবর দেওয়া একটা কাজ, সেখানে পিকনিকে গেলেতো কাজ বন্ধ থাকবে! তাহলে কী দিনটায় আমরা কোনো খবর পাবলিশ করব না? সে প্রশ্ন নিয়েই এডিটর ইন চিফের মুখোমুখি হলাম। তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ আলমগীর হোসেন। যার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ২৪.কম। সেদিন তার মুখেই প্রথম শুনলাম ‘রিমোট ওয়ার্ক’ কথাটি। বললেন যাও ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখো, এই কথার মানে কি?

রিমোট ওয়ার্কের চর্চা বিশ্বে কে কোথায় কবে শুরু করেছে জানিনা, তবে- বাংলাদেশে পায়ওনিয়ার আলমগীর হোসেন/গ্রাফিক্স: বার্তা২৪.কম

সহকর্মীকে শেখানোর এ এক অনন্য ধরন তার। নিজে থেকে ব্যাখ্যা করে বলবেন না বরং উৎসাহিত করবেন ও পথ বাতলে দেবেন কি করে শিখে নেওয়া যায়। তখনই দেখে নিলাম বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেটের আশীর্বাদে এই রিমোট ওয়ার্ক কথাটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশ চালু হয়ে গেছে। এবং কাজও চলছে হরদম।

কিছুটা পড়াশুনা করে এডিটর ইন চিফের সঙ্গে আরেকবার বসলাম। বললেন, ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি নিশ্চিত করতে পারলেই সিক্সটি পারসেন্ট কাজ হয়ে গেল। কনটেন্ট হাতে পেলে, তা তোলা যাবে যদি অ্যাডমিন প্যানেল কাজ করে। এখন কনটেন্ট প্ল্যানটা করে ফেলো। হাতে কিছু কনটেন্ট রেডি করে রাখো। যেগুলো টাইম নিউট্রাল। পিকনিকে মজা করার ফাঁকে ফাঁকে সেগুলো তুলে দেওয়া যাবে।

চব্বিশ ঘণ্টার মিডিয়ায় সেটিই মূল কাজ। একটি নির্দিষ্ট বিরতির পর যাতে কিছু না কিছু কনটেন্ট প্রকাশিত হয়। এরপর বাকি থাকলো খবর ব্রেক করা। ঘটনার প্রতি মুহূর্তের আপডেট দেওয়া, সবার আগে সব খবর পরিবেশনে নাম করতে শুরু করেছে।

ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি থাকলে যেকোন প্রান্ত থেকে কাজ করা যায়

এডিটর ইন চিফ বললেন, আমরা এমন একটা দিনে পিকনিকে যাচ্ছি, দীর্ঘ সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, দিনটি ডাল যাবে। আর এরপরেও যদি কিছু ঘটে যায়, একদিন মিস করলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে না। আর রিপোর্টারদের মধ্যে যারা পিকনিকে যাবে না তারাতো থাকছেই। বড় কিছু হলে তারা কাভার করে খবর পাঠাবে। মোবাইল ফোনে দিলে, পিকনিক স্পট থেকেও সে খবর প্রকাশ করা যাবে।

ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির জন্য গ্রামীণফোনের দুটি মডেম কিনে নেওয়া হলো। আগে থেকেই দুটি অফিসে কেনা ছিলো, যা দিয়ে কারণে অকারণে অফিসে ইন্টারনেট ডাউন হলে কানেক্ট করে কাজ চালাতে হতো। ব্যস চারটি মডেম সঙ্গে নিয়ে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ২০১১ সালে মধুপুরের গহীন বনাঞ্চল থেকেই লাইভ থাকলো। সেই থেকে রিমোট ওয়ার্কের চর্চা শুরু। এরপর প্রতিবছরই পিকনিক হতো। বছরে একটি দিন কর্মীরা গিয়ে আনন্দ করে আসে। তাতে তাদের কাজের উদ্যম বাড়ে। কিন্তু অনলাইন একটি সংবাদমাধ্যম দিনটিতেও ভালোভাবেই সক্রিয় থাকতে পারে। বিশ্বে কে কোথায় কবে শুরু করেছে জানিনা। তবে- বাংলাদেশে এই কাজের পায়ওনিয়ার আলমগীর হোসেন। তার হাত ধরেই আমি কাজটা শিখেছি। এবং বলতে পারি ভালোই শিখেছি। আর এডিটর ইন চিফ এ কাজে কখনও আমার ওপর ভরসা হারাননি।

গতানুগতিক অফিস ডে থেকে একটি রিমোট ওয়ার্কের দিন একটু ভিন্নরকমই হয়/গ্রাফিক্স: বার্তা২৪.কম

এই ভরসার একটি গল্প শোনাই। ২০১২ সালে গেলাম যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন কাভার করতে। ঠিক নির্বাচনের দিনের ঘটনা। পূর্ব পরিকল্পনামতো ওয়াশিংটনের ভার্জিনিয়ার কাছাকাছি বল্টিমোরের এলিকট সিটিতে বন্ধুর বাসায় আগের রাতটি কাটালাম। খুব সকালে চলে যাবো ওয়াশিংটনে। হোয়াইট হাউজের সামনে থেকে প্রথম নিউজ স্টোরিটি লিখবো এমনই প্রত্যাশা। ভোটগ্রহণ শুরুর যথেষ্ট আগেই বের হলাম। এলিকট সিটি থেকে বের হওয়ার পথে ঢাকা থেকে এডিটর ইন চিফের ফোন। অফিসে ইন্টারনেট ও সার্ভার পুরোপুরি ডাউন। কার্যত গোটা দেশেই ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি ডাউন। কোথাও সাবমেরিন কেবল কাটা পড়েছে বা তেমনই কিছু ঘটেছে। আজ নির্বাচনের খবর পাঠালে ঢাকা থেকে কিছুই করা যাবে না। ততদিনে আমি বাংলানিউজের হেড অব নিউজ। আর পদাধিকারবলে, আমার ল্যাপটপে দেওয়া আছে ওয়েব সাইটের কন্ট্রোল প্যানেল। এডিটর ইন চিফ বললেন, যা কিছু করার ওখান থেকে তোমাকেই করতে হবে। আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। সামলানোর দায়িত্বও তিনিই নিলেন। বললেন, ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি পাও এমন কোনও একটা জায়গায় অবস্থান নাও। তাহলেই কাজ করতে পারবে। আমেরিকায় ততদিনে পিজ্জা শপ কফিশপে ওয়াইফাই রীতিমতো পানিভাত। কাছেই একটা পিজ্জা শপে অবস্থান নিলাম। সেখানে বসে কাজ শুরু করলাম। ব্যস! বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর পুরোপুরি অন। ঢাকা থেকে আমাকে নিউজ পাঠানো হচ্ছে- আমি পৃথিবীর ঠিক অপরপৃষ্ঠে একটি পিজ্জা শপে বসে সেই নিউজ সাইটে আপলোড করছি। এরচেয়ে রিমোট ওয়ার্ক আর কীই হতে পারে!

করোনার এই সময়টিতে রিমোট ওয়ার্ক চলছে প্রায় সবগুলো মিডিয়া হাউজেই/গ্রাফিক্স:বার্তা২৪.কম

প্রশ্ন করতে পারেন- ইলেকশনের খবরের কি হলো? পিজ্জা শপে বসে তো আর ইলেকশন কাভার করা যাবে না। সত্যি কথা বলতে কি-সেটাও সম্ভব হয়েছিলো। আর তাও ওই রিমোট ওয়ার্কেরই কল্যাণে।

খোলাসা করি। সেদিন আমি নির্ভর করেছিলাম বিবিসি’র কর্মীদের রিমোট ওয়ার্কের ওপর। ব্যবস্থাটি এমন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের রিপোর্টাররা যে যার স্পট থেকে নিজেই ওয়েবসাইটে খবর তুলে দিচ্ছিলেন। খবর ঠিক নয়, তারা টুইট করছিলেন। আর ওয়েবসাইটের একটি কর্নারে সেগুলো ডিসপ্লে হচ্ছিলো। তাতে গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিবিসি করেসপন্ডেন্টদের দেওয়া তথ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছিলো। ইংরেজিতে পাওয়া তথ্যগুলো নিয়ে প্রতি পনের-বিশ মিনিটেই নির্বাচনের আপডেট দিতে শুরু করি বাংলানিউজের পাতায়। ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া থেকে এমন খবর নেওয়ার চর্চা রয়েছে। ফলে, নির্বাচনের খবরের কমতি ছিলো না বাংলানিউজে। সে জন্য প্রশংসাও পাচ্ছিলাম। আর স্পট কাভারেজ যাতে একেবারে মিস না হয়, সে জন্য একবার বের হয়ে, এলিকট সিটির কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে এসেও লিখলাম সরেজমিন প্রতিবেদন। 

এরপরতো রিমোট ওয়ার্ক আরও সহজ হয়েছে। দেশে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি যত সহজ হয়েছে ততই কাজটি হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। অফিস অ্যাটমোসফেয়ারের বাইরে গেলে, এমনকি প্রকৃতির মাঝে বসেও কাজ করা সম্ভব। ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি শুরুতে এজ হয়ে মডেম হয়ে রাউটারে পৌঁছাতে সময় লাগেনি। একটা সিস্টেম থেকেই পাওয়া যেতো কয়েকটি কানেকশন। আর এখন ওয়াইফাই কানেক্টিভিটি বাংলাদেশেও অনেকটা পানিভাতের মতো, চাইলেই পাওয়া যায়। আর স্মার্টফোনের যুগে এসবের কিছুই লাগে না। স্রেফ হটস্পট করেই ইন্টারনেটে কানেক্ট করে ফেলা যায় আপনার ল্যাপটপ। শুধুই ল্যাপটপ কেনো ওয়্যারলেস ইউএসবি অ্যাডপটার দিয়ে কানেক্ট করে ফেলা যায় ডেস্কটপ কম্পিউটারও। 

যে প্রতিষ্ঠানটি আমি সদ্য ছেড়ে এলাম সেই সারাবাংলা.নেট। সেখানে দুই বছরের অভিজ্ঞতায়, অগ্নিকাণ্ড, ব্ল্যাক আউটের ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার। এই সময়গুলোতে কর্মীরা রিমোট ওয়ার্ক করেছেন। এসব ডিভাইসই তখন কাজে লাগানো হয়েছে। এক দণ্ডের জন্যও সাইট বন্ধ থাকেনি। কেউ জানতেও পারেনি, কোনও একটি ক্যাম্প অফিসে, কিংবা কর্পোরেট অফিসের মিটিং রুমে ঠাসাঠাসি করে কাজ চালিয়ে নিয়েছেন সারাবাংলার কর্মীরা।

বার্তা২৪.কম সম্প্রতি পিকনিক করে এলো। গোটাদিন কাটিয়ে এলো পিকনিক স্পটে। কিন্তু সারাদিনই একের পর এক খবর প্রকাশিত হলো। কেউ বুঝতেও পারলো না রিমোট ওয়ার্ক চলছে। যা সম্ভব হলো এই সব ডিভাইসের কল্যাণে।

এসব সাধারণ কাজের বাইরে ট্রাবলশ্যুটিং একটা বড় কাজ। যেকোনো সময়ই বিগড়ে যেতে পারে আপনার ভার্চুয়াল সিস্টেম। তার জন্যও রয়েছে ভার্চুয়াল সমাধান। কিছু কিছু সফটওয়্যার রয়েছে, যার কল্যাণে রিমোট ওয়ার্কেই সেরে ফেলা যায় এসব ট্রাবলশ্যুটিং।

সুতরাং রিমোট ওয়ার্ক নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। গতানুগতিক অফিস ডে থেকে একটি রিমোট ওয়ার্কের দিন একটু ভিন্নরকমই হয়। কিছু বাধা যে থাকেনা তা নয়, তারপরেও কাজ চালিয়ে নেওয়া কোনো দক্ষ কর্মীদলের জন্য বড় কিছু নয়। করোনার এই সময়টিতে রিমোট ওয়ার্ক চলছে প্রায় সবগুলো মিডিয়া হাউজেই। সকলের জন্য থাকলো শুভকামনা।

লেখক: মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক 

এ সম্পর্কিত আরও খবর