গুগল মিডিয়াকে টাকা দেবে! দিতেই হবে

, যুক্তিতর্ক

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক                | 2023-08-24 21:48:06

‘পৃথিবীতে কোনও কিছুই মুফতে পাওয়া যায় না’, এই আপ্তবাক্যকে অকেজো করছে ভার্চুয়াল জগত। এখানে সবকিছুই যেন ফ্রি। সামান্য কিছু খরচে ড্যাটা কিনেই যেন সব কিনে ফেললাম। মানে গোটা বিশ্বের তথ্যভাণ্ডারে অবাধ গতায়ত। শুধু যে যাওয়া-পড়া-দেখা কিংবা শোনা তাতো নয়- সেইসব তথ্য থেকে তুলে নিয়ে ইচ্ছামাফিক নতুন নতুন কনটেন্ট বানানোও চলে অবাধে। নেই কোন বাঁধা এবং নেই বাছ-বিচার। কিন্তু কনটেন্টের যারা উদগাতা, কিংবা যাদের শ্রমে ও ঘামে তৈরি হয় একেকটি কনটেন্ট তাদের পকেটে পৌঁছায় না কিছুই। পৌঁছালেও তা যৎসামান্য। পাঠকের পাওয়া না পাওয়ায় প্রশ্ন নয়। কিন্তু বিনে পয়সায় পাওয়া এইসব তথ্য নিয়ে ভার্চুয়াল দুনিয়াজোড়া পসরা সাজিয়ে সেবার নামে ব্যবসা ফেঁদেছে যারা তাদের নিয়েই প্রশ্ন- আর কতকাল মুফতে পাওয়া তথ্য তারা বেচবে চড়া দামে? তথ্যভান্ডারের সবচেয়ে একক বড় গুদামঘর এখন গুগল। এর জন্য তারা আর কিছুই করেনি, মেধা খাটিয়ে এমন এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে নিয়েছে যে- যে কারো তথ্যই সেখানে মিলবে। সার্চইঞ্জিন নামের সে এক অদৃশ্য যন্ত্র। গুগলে যান, আপনার চাহিদামতো কথাগুলো লিখুন কিংবা মাইক্রোফোন অন করে বলুন আর পাশেই দেওয়া আছে অনুসন্ধানের চিরচেনা আইকন আঁতশকাচ। ব্যস আকাশ-পাতাল-মর্ত্য যেখানে যে তথ্য রয়েছে তা ছেকে বের করে আনবে। আর কয়েক সেকেন্ডেই হাজির করবে তথ্যের ডালি। লক্ষ-কোটি ইউআরএল এসে পাতার পর পাতা ডিসপ্লে হবে আপনার ডিভাইসে। বেছে নিন। দেখে নিন। যা চান তাই পাবেন এখানে। তবে তাবত তথ্য নিয়ে কথা নয়। যে যারটা বুঝে নেবে। কথা উঠেছে সংবাদমাধ্যমগুলোর দেওয়া তথ্য কিংবা খবর নিয়ে। সংবাদমাধ্যম খবর সংগ্রহ করে তা প্রকাশ করে নিজের প্ল্যাটফর্মে। গুগল তা স্রেফ সার্চ ইঞ্জিনে টেনে নিয়ে বিনাশ্রমে বিনামূল্যে নিজের প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করে দেয় বিনাবাক্যব্যয়ে। আর তা থেকে আয় করে নেয় শত বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালের হিসাবে ১১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কামিয়েছে এই সার্চইঞ্জিন জায়ান্ট। বাংলাদেশি মুদ্রায় ১১৩০৫০০০০০০০০০ টাকা। কিন্তু এভাবে আর কত? নতুন কিছু কথা উঠেছে তাতে মনে হচ্ছে সেদিন বুঝি গত হতে চলেছে। এই একছত্র মুনাফাভোগ করতে পারবে না গুগল। অন্তত সংবাদমাধ্যম থেকে কনটেন্ট নিয়ে ডিসপ্লে করতে হলে- মিডিয়া গ্রুপগুলোকে পয়সা দিতে হবে সার্চ জায়ান্ট গুগলকে।

প্রথম আওয়াজটি উঠেছে ফ্রান্স থেকে। দেশটি গুগলকে সরাসরি নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে- মিডিয়ার কনটেন্ট গুগল নিলে তার বিনিময়ে অর্থ দিতে হবে। কারণ দেশটির মিডিয়া তদারকি কর্তৃপক্ষ দেখতে পেয়েছে গুগলের কারণেই ফ্রান্সের সাংবাদিকতা খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে।

তবে এর মাসকয়েক আগেই ইউরোপ যে নতুন ডিজিটাল কপিরাইট অ্যাক্টটি করেছে-তাতেই ঘাবড়ে যায় গুগল। আইন প্রণয়নের পর থেকেই আইন মানা যাবে না বলে চিৎকার করে আসছে সার্চইঞ্জিন জায়ান্টটি। তারা বলছে- এতে ক্ষতি খবরের প্রকাশকদেরই বেশি হবে। রীতিমতো হুমকি দিয়ে আসছে এই বলে যে- আইনটি বাস্তবায়ন হলে সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরগুলোই সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজে পাওয়া কমে যাবে কিংবা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এখন যে একটু আধটু আয় সংবাদমাধ্যমগুলো তুলে নিচ্ছে তাও বন্ধ হয়ে যাবে।

আইনটিতে কী রয়েছে সে কথা পরে বলছি। তবে ফ্রান্সের কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি গুগুলের এহেন আচরণকে স্রেফ মোড়লিপনা হিসেবে দেখছে। বলছে, এটা ক্ষমতার অপব্যবহার বইতো কিছু নয়। বিষয়টি ঠেকাতে দেশটি এমন এক নির্দেশনা জারি করেছে- যাতে বলা হয়েছে নিউজ মিডিয়ার খবর সার্চ ইঞ্জিনে পাওয়া কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখাতে হলে সে জন্য সংশ্লিষ্ট মিডিয়াকে পয়সা দিতে হবে।

গুগল সে কথা মানছে না। তারা বলছে- সেটাই যদি হয় কথা- তাহলে গুগলও বলে দিচ্ছে- পয়সা না দিতে হলেই কেবল কোনও মিডিয়ার খবর তারা সার্চ ইঞ্জিনে আনবে- নচেৎ নয়। আরও বলছে- তাদের কথা যদি না মানা হয় তাহলে সার্চ ইঞ্জিন শুধু খবরের শিরোনামগুলোই সামনে আনবে। ক্লিক করলে কোন ফল দেখাবে না- কিংবা ফাঁকা পৃষ্ঠা দেখাবে। তাতে নিউজ মিডিয়াগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ তাদের কনটেন্টও দেখা যাবে না আর তাতে বিজ্ঞাপনও থাকবে না। এতে করে নিউজ মিডিয়াগুলো এখন যে টুপাইস কামাচ্ছে- সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে।

গুগলের মোড়লিপনা মেনে নিতে পারছে না ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, ভার্চুয়াল জগতের প্রভাবশালী অবস্থানে যাওয়ার পর এখন নিজের শক্তিমত্তার অপব্যবহার করছে গুগল। পেছনের খবর হচ্ছে- ফরাসি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হয়েছে দেশটির আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় সংবাদ সংস্থা এজেন্সি ফ্রেঞ্চ প্রেস- এএফপি’র দায়ের করা একটি নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে। গেল নভেম্বরে এএফপি তার অভিযোগটি দায়ের করে। এরপর সবধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ের পরই ফরাসি কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। তাদের মতে, গুগলের কাজটি সংবাদমাধ্যমের জন্য তাৎক্ষণিক ও ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ আরও বলছে, সংবাদের প্রকাশক ও সংবাদ সংস্থাগুলোর কনটেন্ট নিলে এর প্রস্তুতকারকদের কীভাবে তার বিনিময়মূল্য দেবে তা নিয়ে গুগলকে এখনই একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। এএফপি’র একটি খবরের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো লিখছে- কনটেন্টের মূল্য কত দিতে চায় সে প্রস্তাবও গুগলের কাছ থেকেই আসতে হবে। এরপর দরকষাকষির মধ্য দিয়ে তা নির্ধারণ করবে। কোনো ঢালাও রেট ধার্য করা যাবে না। একেক সংবাদমাধ্যমের খবরের মূল্যমান বিবেচনায় তার দর নির্ধারণ করা হবে। একবার ফয়সালা হয়ে গেলে এবং সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হয়ে গেলে ২০১৯ অক্টোবর থেকে তা কার্যকর করা হবে। ফলে পেছনের পাওনাগুলোও পরিশোধ করবে গুগল। উল্লেখ্য যে, গেলো বছরের অক্টোবর মাসেই ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম দেশ হিসেবে ইইউ ডিজিটাল কপিরাইট অ্যাক্টটি অনুসমর্থন করে।

গুগল এতদিন ধরে বলে আসছিলো- ইইউ ডিজিটাল অ্যাক্টে এমন কথা বলা নেই যে কোন সংবাদমাধ্যমে লিংক পোস্ট করলে তার জন্য ফি দিতে হবে। গুগলের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ইউরোপীয় সংবাদ প্রকাশকরা বরং বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে বলেই মত দিয়ে আসছিলো তারা। সংস্থাটি জানাচ্ছে স্রেফ সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে ইউরোপীয় মিডিয়াগুলো মাসে আট বিলিয়ন ভিজিট পায়। সেসব ভিজিটের বদৌলতে মিডিয়াগুলো ভালো আয়ই করে। সেটা মোটেই কম কিছু নয়। এখন যদি তারা সার্চইঞ্জিনকে বলে দেয় খবরগুলো আনবে না- তাহলে খবরের প্রকাশকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ খবরে আসা বিজ্ঞাপনগুলো ডিসপ্লে হবে না। এটা সত্য বিজ্ঞাপন থেকেই সংবাদমাধ্যমগুলোর আয়। কিন্ত অ্যাড নেটওয়ার্কিং বা সেন্সিংয়ের মাধ্যমে যে কতটুকু আয় আসে- তা মিডিয়াগুলোর খুব জানা। অতি নগন্য সে আয়। কত ইম্প্রেশনে কত আয় তার হিসাব কষা দায়। সে কথা বাদ থাক- কিছু আয় যে হয় তা নিশ্চয়। কিন্তু সে আয় দিয়ে কি কনটেন্টের মূল্য নির্ধারণ করা যাবে? একজন সংবাদকর্মীর যে ঘাম-শ্রম ও মেধা ব্যয় হয় একটি সংবাদ তৈরির ক্ষেত্রে, তার মূল্য এভাবে নির্ধারণ করা যায় না। এখানে কনটেন্টের মূল্যই আগে নির্ধারণ করতে হবে।

গুগল বলছে গেলো বছর যখন ফ্রান্স নতুন কপিরাইট আইনটি অনুসমর্থন করে তখন থেকেই তারা প্রকাশকদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেছে, যাতে করে খবরে আরও বিনিয়োগ ও সহযোগিতা দেওয়া যায়। ফ্রান্স কর্তৃপক্ষের নতুন নির্দেশনার পর গুগলের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিউজ রিচার্ড গিংগ্রাস একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে বলেছেন- আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখবো এবং আলোচনা চালিয়ে যাবো। তবে এর আগে গুগল কেবল আট বিলিয়ন ভিজিট জেনারেট করার বিষয়টিই সামনে আনছিলো।

আইনটির কথায় আসি। গত অক্টোবরে ইইউ ডিজিটাল কপিরাইট অ্যাক্টে ফ্রি লাইসেন্স-এর অপশনটি যোগ করে, তখনই ফ্রান্সের কর্তৃপক্ষ সংবাদমাধ্যমগুলোর কপিরাইটে সংরক্ষিত কনটেন্ট বিনামূল্যে কেন গুগল ডিসপ্লে করবে সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠায়। বলে নতুন আইনের উদ্দেশ্য ও যে সুবিধাগুলো আনা হলো, বিষয়টি তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ আইনটি করাই হয়েছে খবরের প্রকাশক ও খবরগুলো ডিসপ্লে করার প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে মূল্য ভাগাভাগির দিকগুলো পুনর্বিন্যাস করতে। আইনে যেসব সংশ্লিষ্ট অধিকার (নেইবারিং রাইটস) দেওয়া হয়েছে, তাতে সংবাদমাধ্যমের পাওনা বাড়বে। গুগলের এই ঢালাওভাবে সকল কনটেন্টের জন্য জিরো রেমুনারেশন বলে দেওয়াকে অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত বলেই মনে করছেন তারা।

হতে পারে অনেকেই তাদের কনটেন্ট বিনামূল্যেই দিতে চায়। তার জন্য সে অপশনটাই খোলা থাক, কিন্তু কেউ কেউতো থাকবে, যার কাছে তার কনটেন্ট মূল্যবান। এবং সেটি নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিনে টেনে আনতে তাকে মূল্য দিয়েই আনতে হবে। ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ মনে করছে, গুগল তার আর্টিফিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহারে একটি প্রভাবশালী অবস্থানে পৌঁছানোর পর এখন এই মোড়লিপনা করছে। যা অন্যায়।

এখানে আরও একটি বিষয় এসেছে। সেটি হচ্ছে গুগলের ইনডেক্সিং ও তাতে নিরপেক্ষতা প্রসঙ্গ। বলা হচ্ছে নিউজ মিডিয়াগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সমঝোতার মাধ্যমে এখানেও একটি নিরপেক্ষ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারবে গুগল। ফরাসি কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের এই নতুন নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গুগল যেসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার একটি মাসিক প্রতিবেদনও জমা দিতে হবে।

গুগল কী করতে যাচ্ছে তা হয়তো দিনে দিনে আরও স্পষ্ট হবে। তবে ধারণা করা যায়, বিষয়গুলো আরও কাঠামোগত রূপ পেলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও ভালো সাংবাদিকতার সুদিন ফিরবে। আর এখান থেকে মূল্য পাওয়া গেলে মিডিয়াগুলো তার মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। সবশেষে মানসম্পন্ন সাংবাদিকতারই হবে জয়জয়কার।

এ সম্পর্কিত আরও খবর