রাষ্ট্রীয় পদক প্রদানে বিশৃঙ্খলা কাম্য নয়

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার | 2023-08-25 23:18:19

প্রাণিকুলে মানুষ সবচেয়ে মেধাবী ও কর্মঠ। মানুষ তার আগ্রহের এলাকায় কাজ করতে ভালোবাসেন। মালী ফুল ফোটাতে, শিল্পী শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে, বিজ্ঞানী নতুন আবিষ্কারে, উদ্ভাবনে, শিক্ষাবিদ জ্ঞান অর্জন ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে কাজ করেন।

শিল্পী তার শিল্প সৃষ্টিতে কাজ করেন সানন্দে। জয়নুল আবেদিন বা এস এম সুলতানকে যদি কেউ শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি না দিতেন, তাহলে কি তাঁরা ছবি আঁকতেন না? অবশ্যই আঁকতেন। মানুষ তার আনন্দের জন্য কাজ করেন। কাজ করতে করতে পেশাদারিত্ব অর্জন করেন। মানুষ অন্যের স্বীকৃতির জন্য কাজ করেন না। কে তার কাজ দেখে প্রশংসা বা নিন্দা করল তাতে তার কিছু এসে যায় না। তবে কেউ যদি তার কাজে খুশি হন, হতে পারেন। তার কাজের স্বীকৃতি দেন, দিতে পারেন।

মানুষ ভাল কর্মীদের উৎসাহিত করে তার কাজের স্বীকৃতি দিতে চান। সে জন্যই তাকে পুরস্কৃত করতে চান। এ জন্যই বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন এলাকায় নাগরিকদের অবদানের জন্য তাদের পুরস্কার দেয়। রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবেও পুরস্কার দেওয়ার আয়োজন।

আন্তর্জাতিকভাবে যেমন পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে, তেমনি মহাদেশভিত্তিক পুরস্কারের ব্যবস্থাও আছে। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে দেয়া হয় বিভিন্ন দেশে নানা রকম পুরস্কার। এ পুরস্কার যারা পান, তাঁরা যোগ্য। নিজ কাজের এলাকায় তাঁদের রয়েছে ঈর্ষণীয় পেশাদারিত্ব। এর মধ্যে যে আন্তর্জাতিক পুরস্কারটি বিশ্বব্যাপী খ্যাতিসম্পন্ন, তার নাম ‘নোবেল’। প্রতিবছর এ পুরস্কার দেয়া হয়। বেশ কিছু ক্যাটাগরিতে অবদানের জন্য এ পুরস্কার দেয়া হয়ে থাকে। আবার এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দেয়া হয় ম্যাগসাইসাই পুরস্কার। এটিকে আমরা মহাদেশভিত্তিক পুরস্কারের উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। আর দেশে দেশে যে সব পুরস্কার দেয়া হয়, তার সংখ্যা এত বেশি যে, বলে শেষ করা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে দু’একটি নমুনা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন, ভারতে ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী; পাকিস্তানে নিশান-ই-পাকিস্তান, হিলাল-ই-পাকিস্তান, তমঘা-ই-পাকিস্তান; বাংলাদেশে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রভৃতি।

নোবেল পুরস্কার যারা পান তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে একেকজন অবদানসৃষ্টিকারী আইকন। নিজ এলাকায় তাঁদের কাজের সুনাম দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ায় তাঁদের নাম এ পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়। অযোগ্যরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এমন উদাহরণ বিরল। তবে প্রতিযোগিতা তীব্র হওয়ায় এখানে যে কোনো তদবির বা রাজনীতি হয় না সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। অর্থনীতিতে নোবেলের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম একাধিকবার প্রস্তাবিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি। তবে পরে তিনি ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। এর পেছনে কোনো রাজনীতি ছিল কিনা সে বিষয় নিয়ে আলোচনা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তবে নোবেল পুরস্কার যারা পান, এটি যুগপৎ সে ব্যক্তির এবং তাঁর দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনে। কিন্তু ড. ইউনূসের বেলায় তেমনটি হয়নি। তিনি বিদেশে যতটা সম্মান পান, দেশে ততটা সম্মান পান বলে প্রতীয়মান হয় না। এর পেছনেও রাজনৈতিক দোলাচলের প্রভাব সক্রিয় বলে ভাবা যায়।

ম্যাগসাইসাই পুরস্কার দেয়া হয় এশীয় দেশগুলোর মধ্যে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি এ পুরস্কার পেয়েছেন। তাহরুন্নিসা আবদুল্লাহ ১৯৭৮ সালে, ফজলে হাসান আবেদ ১৯৮০, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৮৪, জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৮৫, অ্যাঞ্জেলা গোমেজ ১৯৯৯, আবদুল্লাহ আবু সাইদ ২০০৪, মতিউর রহমান ২০০৫, এ এইচ এম নোমান খান ২০১০ এবং সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ২০১২ সালে নিজ নিজ এলাকায় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ  ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান।

এবার রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদত্ত পুরস্কার প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রসঙ্গে আসি। ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন তিন শতাধিক ব্যক্তিত্ব। নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁরা এ পুরস্কার পান। এর মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজ অবদানের জন্য এঁরা পুরস্কৃত হয়েছেন। তবে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রদানের গতিধারা পর্যালোচনা করে বলা যায় যে, এ দেশে এ প্রক্রিয়াটি ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না’ নীতি দ্বারা প্রভাবিত। এ কারণে যে তিন শতাধিক ব্যক্তি এ পর্যন্ত এ পুরস্কার পেয়েছেন, তার এক তৃতীয়াংশের মত (১০৫ জন) পেয়েছেন মরণোত্তর পুরস্কার। মৃত্যুর পর কাজের স্বীকৃতি পাওয়া দুঃখজনক। এ পর্যন্ত সাহিত্য বিভাগে ৩৬ জন স্বাধীনতা পদক পান, যার মধ্যে পাঁচজন নারী আর বাকিরা পুরুষ। পাঁচজন নারীর মধ্যে সৈয়দা মোতাহেরা বানু, সুফিয়া কামাল, রোমেনা আফাজ, রাবেয়া খাতুন এবং সেলিনা হোসেন। এসব রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য যেসব নাম প্রস্তাবিত হয়, সেখান থেকে বাছাই করার কাজটি অনেক সময় পেশাদারিত্বের সঙ্গে করা হয় না। আমরা বলতে পারলে খুশি হতাম, সাহিত্য বা সংস্কৃতি বিভাগে যারা স্বাধীনতা পদক পান, তাদেরকে যথাক্রমে সাহিত্যবোদ্ধা ও সংস্কৃতিজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিত্বগণ যোগ্যতা বিচার করে বাছাই করেন। যদি তাই হতো, তাহলে ২০২০ সালে হয়তো এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদ-কে সাহিত্যে স্বাধীনতা পদক দেয়া হত না।

ব্যক্তি রইজ উদ্দিনের সঙ্গে আমার যেমন আলাপ-পরিচয়, বন্ধুত্ব বা শত্রুতা নেই, তেমনি সাহিত্যিক রইজ উদ্দিনের সঙ্গেও আমি অপরিচিত। আমি সন্দেহ করি, ঢাকার লব্ধপ্রতিষ্ঠ কোনো প্রকাশনা সংস্থা থেকে তার কোনো বই প্রকাশিত হয়েছে কিনা। প্রায় সব বই যদি গাঙচিল প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়ে থাকে, তাহলে তো আর বলার কিছু নেই। এদের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা অনেক। তবে সেগুলির মান বিচার করা হয় কিনা আমি জানি না। বাংলা একাডেমি যেমন ২০২০ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত ৪ হাজার ৫৯১টি নতুন বইয়ের মধ্যে যাচাই করে মাত্র ৪৮৮টি বইকে মানসম্পন্ন বলেছে, তেমনি গাঙচিল প্রকাশনা যে হাজার হাজার বই প্রকাশ করেছে, তাদেরও সাহিত্যবোদ্ধাদেরকে দিয়ে যাচাই করিয়ে বলা উচিত, তাদের প্রকাশিত বইয়ের শতকরা কতভাগ মানসম্পন্ন বই।

শুনেছি জনাব রইজ উদ্দিন নাকি গোটা ত্রিশেক বই লিখেছেন। তা তিনি লিখতেই পারেন। তবে সাহিত্যমান বিচারে তার কয়টি মানসম্পন্ন বইয়ের সনদ পাবে সে বিষয়টিই মুখ্য। বইয়ের সংখ্যাটি এখানে গৌণ বিষয়। জনাব রইজ ত্রিশটির পরিবর্তে একটি বা দুটি বই লিখে স্বাধীনতা পদক পেলে আমাদের মোটেও আপত্তি থাকবে না। তবে সে বইগুলোকে সাহিত্যমান বিচারে অবদানমূলক হতে হবে।

২০২০ সালের জন্য স্বাধীনতা পদক ঘোষণার পর কেউ কেউ জনাব রইজকে চিনেন না বলে তার সম্পর্কে জানতে চান। অনেকে লেখালেখির জগতে এমন অপরিচিত ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রদানে আপত্তি জানান। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নূহ আলম লেনিন ২০২০ সালের স্বাধীনতা পদক তালিকার মধ্যে দু’জনকে কেন স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হচ্ছে তার জন্য মন্ত্রীপরিষদ বিভাগকে ব্যাখ্যা দিতে বলেন। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘এবার সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন রইজউদ্দীন, ইনি কে? চিনি না তো। কালিপদ দাসই বা কে! হায়! স্বাধীনতা পুরস্কার!’ একইভাবে জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ জনাব রইজ উদ্দিনকে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে ‘মহাকবি’ আখ্যায়িত করে তাঁর পদক কেড়ে নিয়ে জাতীয় পাপ স্খলন করতে পরামর্শ দেন। ড. সেলিম জাহান রইজ উদ্দিনের কবিতাকে ‘মন্তব্যযোগ্য নয়’ বলে প্রশ্ন করেন, কারা এ ব্যক্তিটিকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত করেছেন? সাহিত্যে রইজ উদ্দিনের স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তির ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ‘চলে গেলে’ এবং ‘নড়েআল হতে নড়াইল’ শিরোনামযুক্ত দুটি কবিতা অনেকের চোখে পড়ে। এসব কবিতাকে অনেক কবি কবিতা বলতে আপত্তি জানান। যার লেখা ১৩ লাইনের ‘চলে গেলে’ কবিতায় সাতটি বানান ভুল, তাকে দেয়া হল স্বাধীনতা পদক (কালের কণ্ঠ, ২৫-০২-২০২০)! একইভাবে সাহিত্যাঙ্গণে প্রশ্ন ওঠে সংস্কৃতি বিভাগে কালীপদ দাস এবং ভাষা ও সাহিত্যে নাজমুন নেসা পিয়ারীর যথাক্রমে স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্তি নিয়ে।

আমার মনে হয়, ২০২০ সালে স্বাধীনতা ও একুশে পদক প্রদানে যে বিশৃঙ্খলা হয়েছে তার জন্য পদকপ্রাপ্তগণ দায়ী নন। এর জন্য দায়ী হলেন তারা, যারা এদের বাছাই করে পদকের যোগ্য মনে করেছেন। আমরা সবিনয়ে সরকারের কাছে ২০২০ সালের একুশে ও স্বাধীনতা পদক বাছাইয়ের কাজ করা কমিটির প্রতিটি সদস্যদের নাম জানতে চাই। অচিরেই গণমাধ্যমে তাদের নাম প্রকাশ করা হোক। আমরা দেখতে চাই যে, সেখানে ক’জন সাহিত্যবোদ্ধা আছেন। আর সেখানে যদি সাহিত্যবোদ্ধাদের পরিবর্তে আমলাদের ঠাঁই দেয়া হয়, তাহলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। আমলাবিদ্বেষী হয়ে একথা বলছি না। সরকার যদি হাসনাত আবদুল হাই, ড. আকবর আলী খান, আসফউদ্দৌলাহ বা আবদুশ শাকুরের মত বা ওই মানের আমলাদের এমন কাজে ব্যবহার করেন, তাহলে কেউ আপত্তি করবেন না। তবে এখন আমলাদের মানের যে অবনমন ঘটেছে তাতে ওই মানের সাহিত্যবোদ্ধা আমলার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। এমনই ব্যক্তিত্বকে এবারের বাছাই কমিটি সাহিত্যে স্বাধীনতা পদকের জন্য বাছাই করলেন, যার নাম ঘোষণার ২০ দিন পর ব্যাপক অসন্তোষ ও আপত্তির মুখে সংশোধিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তার পদক বাতিল করতে হল। এ এক নজিরবিহীন লজ্জাজনক ঘটনা। এ লজ্জা শুধু বাছাই কমিটির নয়, পুরো জাতির। এতে নিঃসন্দেহে যুগপৎ দেশে ও বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
 
আমরা চাই, স্বাধীনতা ও একুশে-র মত সম্মানজনক পদক প্রদানে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা হোক। এ সব পদক দেবার জন্য গঠিত কমিটিতে প্রকৃত সাহিত্যজ্ঞানসম্পন্ন এবং সুযোগ্যদেরকে যেন স্থান দেয়া হয়। আর এ কমিটিতে যারা কাজ করবেন, তাঁরা যেন সতর্কতার সঙ্গে নিজ নিজ এলাকায় অবদান সৃষ্টিকারী যোগ্য ব্যক্তিত্বদেরকে পদকের জন্য বাছাই করেন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে যেন কোনো রকম লেনদেন, দুর্নীতি, দলপ্রীতি বা রাজনীতির প্রভাব না পড়ে। পদকপ্রাপ্তদের বাছাইয়ের কাজটি যেন এমন নিপুণ পেশাদারিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করা হয় যাতে এ বিষয়ে কেউ সমালোচনা করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে।      

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার: অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর