করোনা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামর্থ্যের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার দরকার

, যুক্তিতর্ক

আনিস আলমগীর | 2023-08-26 19:46:18

ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস বিশ্বের ৭৫০ কোটি মানুষকে পাগল করে তুলেছে। তার আক্রমণে সৌদি ধনকুবের যুবরাজ থেকে শুরু করে তাদের ‘মিসকিন’ শ্রমিক, ইসরাইলের ইহুদি, ভারতীয় হিন্দু, আমেরিকার খৃষ্টান, বাংলাদেশি মুসলমান আর শ্রীলংকার বৌদ্ধ- কেউ রেহাই পাচ্ছে না।

কারণ ধনী-দরিদ্র, ধর্ম-বর্ণ-সীমান্ত মেনে আক্রমণ করছে না করোনাভাইরাস। রাষ্ট্র ক্ষমতায় কে আছে আর জনতা কে- সেটিও বিচার করছে না কোভিড-১৯। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন মাত্র হাসপাতাল ছেড়েছেন। ব্রিটিশ রাজকুমার চার্লস, কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর স্ত্রী আর বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী-আমলারা সমানে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। ছাড়ছে না খোদ ডাক্তার-বিজ্ঞানীদেরও।

পৃথিবীতে কোনো ভাইরাস জন্ম নিলে, তা নিঃশেষ হয় না, প্রতিষেধক দিয়েই তাকে প্রতিরোধ করতে হয়। কোভিড-১৯ এর কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। জাপানের আবিষ্কৃত ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক নাকি কিছুটা কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। অনেক দেশে আক্রান্ত রোগীদের তাই দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেরও কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি তা উৎপাদন করার প্রস্তুতি নিয়েছে। করোনারভাইরাস পরীক্ষার কিট ব্যয়বহুল, যদি বিদেশি কিট দিয়ে পরীক্ষা করাতে হয়। গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী ৩০০ টাকার মধ্যে এটা করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। সরকারও অনুমতি দিয়েছে। ফলাফল এখনও মানুষ চোখে দেখেনি। তারা সফল হলে বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট উপকৃত হবে।

চীনে এই ভাইরাসটির উদ্ভব। তাইওয়ানের সঙ্গে চীনের অবস্থান-মধ্যখানের একটা প্রণালী মাত্র। আর উত্তর কোরিয়া চীনের সীমান্তবর্তী দেশ। উত্তর কোরিয়ার দক্ষিণ সীমান্তের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান। বলতে গেলে চীনের অনতিদূরে। উত্তর কোরিয়া থেকে করোনার কোনো খবর সহজে বহির্বিশ্বে আসে না। সুতরাং উত্তর কোরিয়ায় করোনার কী অবস্থা, তা জানা যাচ্ছে না। তবে সেখানে প্রথম আক্রান্ত রোগীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সম্ভবত এখনো তেমন কাণ্ড অব্যাহত আছে। চীনের সঙ্গে তার সীমান্ত, চীনের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক- সব কিছুর ব্যাপারে উত্তর কোরিয়া চীনের ওপর নির্ভরশীল। হয়তো এখন চীনের পরামর্শে চলছে তারা।

দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানেও করোনা ছড়িয়েছিল, তবে তা ব্যাপকহারে ছড়াতে পারেনি। তারা আপাতত সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ান উভয়ে চীনের বৈরী রাষ্ট্র। তাদের চীনের সহযোগিতার কথা শোনা যায়নি। এখন সারাবিশ্ব চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানের মডেলকে প্রতিরোধের উপায় হিসেবে স্থির করে অনুসরণ করছে। বাংলাদেশও সে পদ্ধতি অনুসরণের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।

বাংলাদেশ করোনার দ্বিতীয় পর্যায় অতিক্রম করে এখন তৃতীয় পর্যায়ে এসে উপস্থিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ ১১ বছর টানা ক্ষমতায়। খুব ভালো মতো তিনি এই পর্যন্ত সব কিছু সামাল দিয়ে এসেছেন। দেশ পরিচালনার ব্যাপারে তিনি কারো মতামতকে তোয়াক্কা করেননি। তবে তেমন ব্যাপক কিছু ভুলও করেননি। এবার সারা বিশ্বের নেতাদের মতো তারও অগ্নিপরীক্ষা। ভাগ্যের ফেরে যদি উত্তীর্ণ হন, সুখের কথা, যদিও পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে নয়।

 

করোনাভাইরাসের রয়েছে নবাবী চরিত্র। তার থেকে বাঁচতে হলে, সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হলে, ঘরে বসে থাকতে হবে। এতদিন ধরে এই ভাইরাসটি যেসব দেশে ছড়িয়েছে- চীন, আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ইতালি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, স্পেন, সৌদি আরব- সবই ধনী রাষ্ট্র। এই দেশগুলোর মানুষ ঘরে বসেছিল। কোনো হাহাকার ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা আর তাদের অবস্থা এক নয়। বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ। এরই মধ্যে তার ৩০ শতাংশ মানুষের পূঁজিপাট্টা যা ছিল শেষ। এখন তাদের ঘরে বসিয়ে রাখতে হলে পেটের ভাত সরবরাহ করতে হবে। আর না হয় ইকুয়েডরের মত পথে ঘাটে লাশ পড়ে থাকবে।

উন্নয়নশীল বিশ্বে মানুষকে করোনাকালে দীর্ঘদিন লকডাইন বা ঘরে বসে থাকা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার আইন মানানো সম্ভব নয়। এই দেশগুলোর দিল্লি, করাচি, মুম্বাই, ঢাকা, লাগোস, কায়রো, জাকার্তা এবং সাও পাওলো-এর মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে এসব আইন নিষ্ঠুর ও অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। মানুষ যদি ক্ষুধার মুখোমুখি হয়, কাজ না পায়, তারা না খেয়ে মরার চেয়ে করোনভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নেবে।

মুরব্বিদের মুখে শুনেছি, ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষ নাকি ৪৩ দিন ছিল, আর তাতে মেরে গেছে ৪৩ লাখ লোক। অবশ্য ইংরেজরা বলে ৪৩-৪৪ সালের ওই দুর্ভিক্ষে ২১ থেকে ৩০ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। বাংলাদেশের সামনে আগামী ৪০ দিন ভয়াবহ কঠিন সময়। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একমাত্র পথ হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের যে সামর্থ্য রয়েছে, তার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার। দেশে খাদ্য ঘাটতি নেই বরঞ্চ সরকারের গুদামে আপৎকালের জন্য খাদ্য মজুত রয়েছে ১৭ লাখ টন। আলুর ফলন ভালো হয়েছে। তিন-চার লাখ টন আলু হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে বোরো ফসল আসবে। সরকার ত্রাণের কাজও আরম্ভ করেছে। ১০ টাকা দরে কেজি চাল বিক্রি করছে। তবে সরকারি দলের অনেক কর্মী ত্রাণ আত্মসাৎ করছে। পত্রিকায় চালের বস্তাসহ ছবি দেখেছি। অনেককে গ্রেফতারও করা হচ্ছে। চুরি প্রতিরোধের চেষ্টা জোরদার করা উচিত।

অবশ্য তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ হয়। মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির শাসন দেখেছে এই দেশের মানুষ। কারো কর্মীরা যুধিষ্ঠির বরপুত্র নয়। ব্রিটিশ সময়ে লর্ড মেকলে যখন ফৌজদারি দণ্ডবিধি প্রণয়ন করেছিলেন তখন তিনি বাঙালি জাতিকে নিয়ে গবেষণা করেছিলেন আর বলেছিলেন মিথ্যা, চুরি-চামারি ছাড়া নাকি বাঙালি হয় না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আগে ‘আমার সোনার বাংলা, আমার সোনার মানুষ’ বলতেন। আর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘মানুষ পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’। নিজের দেশের মানুষ সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি বলা ঠিক হবে না আমার।

সরকারকে এখন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে একটি সুষ্ঠু, সমন্বিত ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করে অগ্রসর হতে হবে। কারণ বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ। আমেরিকার মতো ধনী দেশও করোনায় হিমশিম খাচ্ছে। আবার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য শক্তিশালী মানুষ দরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাত-দিন পরিশ্রম করছেন। তাকে মন্ত্রিসভা বিন্যাস করার জন্য অনেকবার অনুরোধ করেছি। এখন পুনরায় অনুরোধ করব। প্রধানমন্ত্রী, আপনি মন্ত্রিসভায় কয়েকজন শক্তিশালী মন্ত্রী নিয়োগ করুন। অপদার্থদের বাদ দিন।

পরিশেষে একটি হাদিস উল্লেখ করে লেখা শেষ করব, হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন ‘যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে বা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অনুপযুক্ত লোককে বসানো হবে,, তখন তোমরা অপেক্ষা করো কেয়ামত অতি সন্নিকটে।’

আনিস আলমগীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর