ডা. মঈন, একজন মা ও করোনা যুগের আমরা

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-30 14:14:45

আমরা এক সংকটকাল অতিক্রম করছি। পুরো বিশ্বই আজ সংকটের মধ্যে আছে। এ সংকটের কালো মেঘ হয়তো একদিন কেটে যাবে। কিন্তু আজকের ঘটনা-দুর্ঘটনা সবই স্মৃতি হয়ে থাকবে আগামীর বুকে। মানুষের জীবনে দু:খ আসে, আসে রোগ-শোক-বেদনা-অমানিশা। এগুলো সবই জীবনের অনুষঙ্গ। কিন্তু মানুষের পরিচয় এখানেই যে এই বিপদ বা সংকটের সময়েও ধৈর্য ধারণ করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে। বিপদাপদ মোকাবিলা করতে গিয়ে মানুষকে অনেক কিছুই করতে হয়। কিন্তু মানবিকতা বিসর্জন দিয়ে বিপদ উতরানো মানুষের কাজ নয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানবিকতা নিয়ে বেঁচে থাকার নামই জীবন।

প্রেক্ষাপট গাজীপুরের জঙ্গল। মানবিকতা সেখানে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। মানুষকে জঙ্গলেও মানুষের মতোই আচরণ করতে হয়। জঙ্গলে গিয়ে মানুষ অমানুষ হয়ে গেলে মানুষে আর জঙ্গলের জীবজন্তুর মধ্যে ফারাক কী? জানি, জীবন খুব মূল্যবান। কথায় বলে জান বাঁচানো ফরজ। কিন্তু তাই বলে বিপদের মধ্যে মাকে জঙ্গলে ফেলে সন্তানের পলায়ন? আসলে এ সমাজে এ তেমন কিছুই নয়। আমরা যে সমাজে বাস করছি সেখানে এর চেয়েও গা শিউড়ে ওঠার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে দেখি। এখানে তুচ্ছ কারণে রক্তের বন্ধন ছিন্ন করাতো কিছুই নয়। জীবন থেকে বিদায় করে দেয়াও কোনো ব্যাপার না। হয়তো এসবই সভ্যতার সংকট।

ছেলে বলেছিল, মা, কাল সকালে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। এই বলে মাকে জঙ্গলে রেখে চলে গেলো এক ছেলে, দুই মেয়ে ও জামাতারা। তারা সবাই গ্রামে চলে গেছে। মায়ের করোনা হয়েছে তাই মায়ের জন্য সন্তানের উপহার- বনবাস। আসলে এই সভ্য সমাজে হয়তো জঙ্গলই নিরাপদ। মানুষের কাছে মানুষ যেনো ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে এই শহরে, দেশে এমনকি এই সভ্যতায়ও। ছেলে-মেয়েরা চলে যাবার সময় মা কি বিশ্বাস করেছিল তার আদরের টুকরা সন্তানরা আর ফিরে আসবে না? হয়তো করেনি। কিন্তু সন্তানকে পিছুও ডাকেনি। মায়ের বুকের হাহাকারে তখন ভারী হয়ে উঠেছিল জঙ্গলের বাতাস, কিন্তু এই সমাজ ও সভ্যতায় তার আঁচ লাগেনি। অত:পর বন থেকে ভেসে আসে মানুষের কান্নার আওয়াজ। এ যেনো এক ভুতুড়ে কাহিনী। মানুষের সেই কান্নার আওয়াজ শুনে এগিয়ে আসে কিছু মানুষ। অত:পর পুলিশ, প্রশাসন, মিডিয়া, সাংবাদিক, কলামিস্ট, টকশো বক্তা আরও কত কি!

কথায় বলে বিপদাপদে মানুষ চেনা যায়, বন্ধু চেনা যায়। মানুষের আসল রূপ দেখা যায় বিপদ ও সংকটের সময়। করোনা আমাদের জীবনে এক সংকট। এ সংকট আরও ঘনীভূত হলে না জানি সমাজের আরও কত বীভৎস চেহারা বের হয়ে আসে। এই সংকটের সময়ও বক্স খাটর নিচে টিসিবির তেল গুদামজাত করতে আমরা দেখি। ত্রাণের বস্তা বস্তা চালের লোভ সামলাতে পারছেন না অনেকে। একদিকে মানুষের একমুঠো খাবারের জন্য হাহাকার আরেকদিকে মানুষের মুখের খাবার চুরি করে মুনাফার লোভ। লুটপাট করার এইতো সময়!

কিন্তু আশার গল্পও আছে। একদিকে মানবিকতার গ্লানি আছে, অপর দিকে আছে মানবিকতা জয়ের গল্পও। একদিকে যে ডাক্তাররা জীবন বাঁচানোর ব্রত নিয়েছিলেন, করোনার ভয়ে তারা আজ পলাতক। আবার অন্যদিকে একজন ডা. মঈনের মতো মানুষও আমরা খুঁজে পাই এ করোনাকালেই। একদিকে করোনা আক্রান্ত মাকে রেখে সন্তানের পলায়ন, অন্যদিকে করোনা আক্রান্ত মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে দাফন করতে যাওয়ার চিত্রও দেখি এই করোনাকালেই। এ সমাজে ডাক্তারের পিপিই লাগে। বাবাদের পিপিই লাগে না।

জীবনকে আমরা খুব ভালোবাসি। করোনা আমাদের জীবনকে নতুন করে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। জীবন বাঁচাতে আমরা অনেক সতর্ক হয়ে চলাফেরা করছি- মাস্ক পড়ছি, হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহার করছি, ঘরে বসে সামাজিক সঙ্গরোধ আর মোরগ পোলাও খাচ্ছি। করোনার পরে কার সঙ্গে কোথায় কী খাবো, বেড়াতে যাবে তারও একটা খসড়া পরিকল্পনা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এটি খণ্ডিত সমাজেরই একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। অখণ্ড সমাজের পুরো চিত্র হয়তো কোনোদিনই আমরা দেখবো না। কারণ, আমারা এক খণ্ডিত  সমাজেই বসবাস করছি।  

এ সমাজে আজ মৃতের লাশ নিয়েও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তার স্বজনদের। অনেক ক্ষেত্রে নিজ এলাকায় দাফনও করতে দেওয়া হচ্ছে না। করোনা সন্দেহে পড়শির বাড়ি আক্রমণ করে তাদের ভিটেমাটি ছাড়া করাকে কি আমরা সচেতনতা বলবো না অমানবিকতা বলবো? করোনা আক্রান্ত মাকে গ্রামবাসী গ্রামে থাকতে দেবে না, হাসপাতালও ভর্তি করবে না, লোকজন গ্রাম থেকে, ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। তাহলে ওই মা-ই বা যাবে কোথায় আর ওই সন্তানরাই বা কী করবে?

মূল সমস্যা আসলে আমাদের মূল্যবোধে চিড় ধরেছে, উপলব্ধিতে ফাটল ধরেছে। আমরা একবারও ভেবে দেখছি না যদি আজ আমি বা আমারই কোনো স্বজন করোনা আক্রান্ত হয় তবে কী হবে? সমাজের এই প্রতিক্রিয়াশীল ও অমানবিক আচরণ কি সেদিন আমাদেরকে শেষ রক্ষা করতে পারবে? কে কখন কীভাবে আক্রান্ত হবে তা কখনোই বলা যায় না। শুধু রোগ ব্যাধি কেন, মানুষের কোনো অবস্থাই চিরস্থায়ী নয়। রোগ-শোক-বালা-মুছিবত-সম্পদ-ফসল-সন্তান এ সবই মানুষের পরীক্ষার সামগ্রী মাত্র। আজ আছে কাল নেই। টিকে থাকে শুধু মনুষ্য আচার।

সমাজের মানুষকে বেঁচে থাকতে হয় পারস্পরিক সাহায্য ও সহমর্মিতা নিয়ে। সামাজিক দূরত্ব মানে সামাজিকতা ও মানবিকতার বিসর্জন নয়। সচেতনতা মানে মাকে রেখে পলায়ন নয়, কাউকে ভিটেমাটি ছাড়া করা নয়। মা, পরিবার, সমাজ তথা মানুষ বিসর্জন দিয়ে পালিয়ে বাঁচার নাম জীবন নয়। ওই মা কি কোনো দিন তার দু:খ ভুলতে পারবেন? পারবেন কি ওই সন্তানরা কোনোদিন নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে। হয়তো বেঁচে যাবেন ওই মা, ওই সন্তানরা। কিন্তু জীবন কি ক্ষমা করবে ওই সন্তানদের?

জঙ্গলের মধ্যে পড়ে থাকা ওই মাকে যারা উদ্ধার করেছে তারাও এই সমাজেরই মানুষ। পালিয়ে বাঁচা ডাক্তাররাও মানুষ, আবার মানুষের জীবন বাঁচাতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা ডা. মঈন উদ্দীনও মানুষ। সংকটকালের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা আমরা কোন মানুষের পক্ষে? মানুষ না ঊনমানুষ? জীবন-মৃত্যুর ফায়সালা মানুষের হাতে না, কিন্তু এ প্রশ্নের ফায়সালা যার যার হাতে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর