ডা. মঈনের মৃত্যু ও কিছু কথা

, যুক্তিতর্ক

ড. মো. কামাল উদ্দিন | 2023-08-30 22:17:02

দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন মৃত্যুবরণ করেছেন। এই মৃত্যু যেভাবে আমাদের ব্যথিত করেছে তেমনি নানান প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। এ মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে, আসলে সত্যিকার অর্থে আমরা করোনার মতো মহামারি মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত।

ডা. মঈন ১৫ এপ্রিল সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে তিনিই প্রথম কোন চিকিৎসক। গত ৫ এপ্রিল ডা. মঈন কোভিড পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হন। প্রথমে তাকে সিলেটের শহীদ সামসুদ্দীন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু, সেখানে ভেন্টিলেটরসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা না থাকায় এই চিকিৎসকের আকুতি ও তার পরিবারের অনুরোধে ৮ এপ্রিল তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে রেফার করা হয়। পরদিনই তাকে নিয়ে আসা হয় সিলেট থেকে ঢাকায়। ৯ এপ্রিল থেকে প্রথমে আইসিইউ ও পরে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল তাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে রক্ষা করা গেল না।

তবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সামাজিক মাধ্যম, ডা. মঈনের ফেসবুক স্ট্যাটাস ও পরিবারের বক্তব্য থেকে ডাক্তার মঈনকে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান করা হয়নি বলে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয় তা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। ডা. মঈন একজন আদর্শ চিকিৎসক ছিলেন। গরিবের ডাক্তার নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চিকিৎসকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন।

দেশজুড়ে নামে শোকের ছায়া, ভয় ও অবিশ্বাস। ডা. মঈনের ফেসবুক স্ট্যাটাস ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়, যেখানে তিনি লিখেছেন, তিনি হাসপাতালে পিপিই (পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট) ছাড়াই রোগী দেখেছিলেন। তিনি বলেছেন সবাই যার যার অংশ পালন করুন, আমরা হাসপাতালে কাজ করছি, আপনি ঘরে থাকুন, আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

ডা. মঈন করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথমে নিজ শহরে একটা ভেন্টিলেটর চেয়েছিলেন, তারপর এয়ার অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলেন, তারপর চেয়েছিলেন নিদেনপক্ষে একটা আইইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তার এই আকুতিতে ভ্রুক্ষেপ করেনি। অন্যদিকে আমরা দেখেছি একজন সহকারী কর্মকর্তা লকডাউন-এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আহত হওয়ার ফলে তাকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আসলে রাষ্ট্র কাকে গুরুত্ব দেবে সেটা একান্তই রাষ্ট্রের ব্যাপার!

একটি কল্যাণকর গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্রে, রাষ্ট্রের আচরণ হবে সকলের জন্য সমান। কিন্তু এ করোনার সময়ে যাদের আমরা মহামারির সম্মুখে দাঁড় করে দিচ্ছি ঢাল-তলোয়ার বিহীন যুদ্ধ করার জন্য সেই ডাক্তাররা করোনা আক্রান্ত হলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

ডা. মঈনের বেশি কিছু চাওয়া ছিল না। তিনি শুধু বাঁচতে চেয়েছিলেন। সুচিকিৎসা চেয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে আবার করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে চেয়েছিলেন। আর আমাদের দেশ তার এই ছোট্ট চাওয়াটুকু পূরণ করতে পারেনি। ফলে অন্যান্য ডাক্তার যারা করোনার চিকিৎসা করছেন তাদের কাছে কী মেসেজ রাষ্ট্র দিল তা এখন ভাবনার বিষয়।

ডা. মঈনের মৃত্যুতে জনগণের মধ্যে একটি অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। মানুষের মধ্যে এমন এক ধারণা তৈরি হয়েছে যে, যেখানে একজন ডাক্তারই চিকিৎসা পাচ্ছেন না, ডাক্তারের কথা কেউ শুনছে না, সেখানে সাধারণ মানুষ কোনো চিকিৎসা পাবে না।

হয়তো বলতে পারেন জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। মানুষ তো মরবেই। ডা. মঈনের মৃত্যু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। হ্যাঁ, আমরা জানি জন্ম-মৃত্যু সবই আল্লাহর হাতে। মৃত্যু হবেই সেটা নিয়ে আমাদের কারো প্রশ্ন নেই। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে ডা. মঈনকে কেন উন্নত চিকিৎসা দেয়া যায়নি? কোন অজানা কারণে ডা. মঈনের মৃত্যুর আগে একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে তাকে ঢাকায় আনা গেল না? প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়ার অধিকার আমাদের রয়েছে।

সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হয়তো বলবেন ডা. মঈন এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাওয়ার যোগ্য নন। ডা. মঈনের মৃত্যু এবং হাহাকার এদেশের অসংখ্য মানুষের হৃদয়কে ভেঙে চুরমার করে দেয়। হয়তো ডা. মঈনের সেই হৃদয় বিদারক হাহাকার আমাদের মোটেও পরিবর্তন করবে না। আমরা খুব স্বাভাবিক! আমরা নির্লজ্জ! আমরা স্বার্থপর!

দিনদিন ডাক্তারদের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ড. মঈনের মতো আমরা আর কাউকে হারাতে চাই না। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দিবেন।

হ্যাঁ, এটি সত্য যে ডা. মঈনের গুরুত্ব তার মৃত্যুর পরেই বেড়ে গিয়েছে। এখন সবার কাছে তার গুরুত্ব। রাষ্ট্র তার পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমার এক ছাত্র তার ফেইসবুক স্টাটাসে হতাশা ব্যক্ত করে উল্লেখ করে যে 'দেশে জীবিত মানুষের থেকে মৃত মানুষের দাম বেশি' সেটি যেন বাস্তব হল ডা. মঈনের ক্ষেত্রে।

আমরা জানি ডাক্তারদের অনেক শক্তিশালী পেশাজীবী সংগঠন রয়েছে। তারা ডা. মঈনের চিকিৎসা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল কিনা তাও আমাদের মনে প্রশ্ন তৈরি করেছে।

করোনা পরবর্তী অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক ধরনের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই প্রণোদনা দিয়ে কী হবে যদি মহামারি থেকে যাদের জন্য প্রণোদনা তাদের রক্ষা করা না যায়? করোনা যুদ্ধে যারা সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন বিশেষ করে ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল স্টাফ, পুলিশ, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সেনাবাহিনী ও দেশের জরুরি নাগরিক সেবা খাতে নিয়োজিত কেউ যদি করোনা আক্রান্ত হন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে তাদের চিকিৎসা প্রদানের জোর দাবি জানাচ্ছি।

ড. মো. কামাল উদ্দিন: প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর