ভাইরাস যুদ্ধ-আমার আপনার সবার যুদ্ধ

, যুক্তিতর্ক

গওহার নঈম ওয়ারা | 2023-08-26 20:16:58

যুদ্ধ ছাড়াই সারা পৃথিবী এখন অবরুদ্ধ। পরিস্থিতি ক্রমশ সঙ্গিন হয়ে উঠছে। সাত-পাঁচ না ভেবে, বুঝে না বুঝে, জিদে বা চাপে পড়ে নেয়া নানা সিদ্ধান্ত পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। ভুল সিদ্ধান্ত মেরামতের জন্য আরও ভুল সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে কখনও কখনও। এসবই কঠিন করে তুলছে আমাদের যুদ্ধটাকে।

কমিউনিকেশন বা বার্তা আদান-প্রদান সবসময়ে একটা জটিল বিষয়। ‘সম্ভব না’ কে ‘সম্ভাবনা’ পড়ে খুশিতে বাগ বাগ হতে পারেন যে কেউ। কোয়ারেন্টাইন, হোম আইসোলেশন, লকডাউন, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজেশন প্রভৃতি ভারি ভারি ‘বড়লোকি’ শব্দ দিয়ে সাজানো বার্তা মানুষের কানে বা মনে কোথাও যে ঢেউ তুলছে না তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘কাশি শিষ্টাচার’ নিয়েই যেখানে আমরা ঘামছি সেখানে কোয়ারাইন্টিন, হোম আইসোলেশন, লকডাউন, ইত্যাদি হুনস্ত দুরস্ত। একটা জাতীয় শব্দভীতির বাতাবরণ তৈরি করে আমজনতার কাছে যাওয়া যাচ্ছে না, যাবে না।

আমরা ১৪৪ ধারা বুঝি, হরতাল বুঝি, কারফিউ বুঝি, ঘরবন্দি, বাড়ি বন্দি বুঝি। ছোটকালে হাম জলবসন্তে আক্রান্ত হয়ে আমরা অনেকই ঘরবন্দি-বাড়িবন্দি থেকেছি, রেখেছি অন্যকেও। ঢাকা নারায়ণগঞ্জের অনেক মানুষের কাছেই ঢাকা নারায়ণগঞ্জ বন্ধ মানে তাদের রোজগার বন্ধ। রেস্টুরেন্টে কাজ করে এমন হাজার হাজার কর্মী রাতে সেখানেই ঘুমায়।

মেস ও বাড়ির দমবন্ধ মানুষগুলোও ঢাকার বাসিন্দা। তাদের কাছে ঢাকা বন্ধের সহজ সমাধান ফেলে আসা গ্রামে ফেরা। আমরা জানতাম কীভাবে ঈদের ছুটিতে গ্রামে বিস্তার লাভ করেছিলো ডেঙ্গু। এত সবের পরেও আমাদের বলতেই হবে যা হওয়ার হয়ে গেছে।

এরকম পরিস্থিতিতে নিরুপায় ক্ষমতাহীন আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষদের এগিয়ে আসতে হয়। এ যেন সেই ‘যার যা কিছু আছে’ তাই নিয়ে এগিয়ে আসার পরিস্থিতি। আমাদের হয়তো কিছুই নেই তেমন, কিন্তু বাড়িতে আছে কয়েকটা খালি পানির বোতল। সেটা দিয়েই আমরা চলমান ভাইরাস বিরোধী যুদ্ধে সামিল হতে পারি। বোতলগুলোতে সাবান পানি ভরে পথে থাকা ভাসমান বা গৃহহীন মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারেন। আপনি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দু-এক বোতল সাবান গোলা পানি সাথে নিন, যে রিকশায় বা সিএনজি বা বাসে চড়ছেন তার চালককে হেল্পার/কনডাক্টারকে দিয়ে দিন। সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়ার পর আমাদের আলগা পানি দিয়ে হাত আবার ধুয়ে নেয়ার একটা চর্চা আছে। না হলে মনে হতে পারে হাত নাপাক রয়ে গেছে। এটা বে-ফজুল দরকার নাই। একান্তই গা রির রির করলে পরিষ্কার কাপড়ে/রুমালে মুছে নিলেই চলে। এক বোতল সাবান পানি শুধু রিকশা চালানোর সময় ব্যবহারের জন্য নয়। রিকশা চালক সেটা তার ডেরায় বয়ে নিয়ে যাবেন অন্যদের জন্য।

এরকম খালি বোতল ভরে দেয়ার জন্য বিভিন্ন সেচ্ছাসেবক দল ইতোমধ্যেই ঢাকার বেশ কয়েকটি জায়গায় কাজ করছে। যদি মনে করেন এতো হ্যাপায় কাজ নেই। তাহলে আপনি কোনো রকমে ২০/২৫টা খালি বোতল যোগার করে এই নম্বরে যোগাযোগ করুন- 01712060621, 01711397082, 01713046748, 01712841583। এদের থেকে মানুষ এসে বোতলগুলি নিয়ে যাবে। আমার জানা মতে এরা কাজ করছে। আপনি চাইলে নিজেও ব্যবস্থা করতে পারেন অথবা অন্য কারও মাধ্যমেও ব্যবস্থা করতে পারেন।

রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের মতো ঢাকার বস্তি এবং সিএনজি, ব্যাটারিচালিত গাড়িতে সাবান গোলা পানির বোতল লাগিয়ে দেয়া যায়। সাবানের পানি ভর্তি একটা বোতলের সেফটিপিন দিয়ে ফুটো করে ঝুলিয়ে দিলেই হয়ে যাবে নিরাপদ হাত ধোয়ার পানির ব্যাবস্থা। বোতলে হাল্কা করে চাপ দিলেই পানি বেড়িয়ে আসে। কেউ বোতলটা উল্টো করে লাগাতে চাইলে ফুটোটা করতে হবে বোতলের মুখে। কুড়ি সেকেন্ড এই পানিতে হাত ধুলেও ঝুঁকি কমে যাবে।

চরম ঝুঁকিপ্রবণ জায়গাগুলোর মধ্যে চুল কাটার দোকান বা সেলুন অন্যতম। বিদেশে চুল কাটার খরচ অনেক। অনেকেই দেশে ফিরে প্রথম যে কাজগুলো করতে পছন্দ করেন তার মধ্যে একটি হচ্ছে চুল কাটা। আবার বিদেশে কর্মস্থলে ফেরার আগে আরেকবার সেলুনে যান অনেকেই। সেলুনে যারা কাজ করছেন তারাও ঝুঁকিতে থাকেন। সিঙ্গাপুরের সেলুনগুলো ইতোমধ্যেই লম্বা হাতলের কাঁচি চিরুনি ব্যবহার শুরু করেছেন।

যাদের সামান্যতম সর্দি-কাশি আছে তারা সেলুনে যাবেন না। যারা যাবেন তারা নিজেদের চাদর-তোয়ালে নিয়ে যাবেন। যদিও এখন সারাদেশে সেলুন একরকম বন্ধ আছে, কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতির সাথে সাথে মানুষ সেলুনে ছুটবে। ঈদ রমজানে সেলুন পারলারের একটা বিশেষ চাহিদা আছে। এখানে যুক্ত আছে হাজার হাজার কম আয়ের নরসুন্দর পেশার মানুষ। তাদের ঝুঁকিহীন আয় রোজগারের পথ বাতলাতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর জনপদ ভারতের কেরালা রাজ্য ইতোমধ্যেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চুলকাটার পদ্ধতি প্রচার ও অনুসরণ শুরু করেছে। বর্তমান সেলুনগুলোকে একটু বিন্যস্ত করে সেটা এখানেও চালু করা সম্ভব। বন্ধের মধ্যেই বিন্যাসের কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে।

মসজিদ মন্দির গির্জা প্যাগোডায় সমাবেশ অনেক দেশেই বন্ধ অথবা সীমিত করা হয়েছে। অনেক দেরিতে হলেও ঢাকাসহ সারা দেশে মসজিদের বদলে বাড়িতেই নামাজ পড়ার বিধান চালু হয়েছে। রমজান মাসে তারাবির অছিলায় মসজিদের বাইরে নানা বাসাবাড়িতে জামাত করে নামাজের একটা চেষ্টা চলতে পারে।

সব জেনে বুঝে এবং এসব বিষয়ে ধর্মীয় বিধি বিধান ও আনুশাসন পাশ কাটিয়ে কেউ যদি জামাতে নামাজ পড়াটা উপযুক্ত মনে করেন তবে সেক্ষেত্রে নিবিড় তত্ত্বাবধান ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার চর্চা নিশ্চিত করে করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে নিজের জায়নামাজ, নিজের রুমাল, নিজের সাবান পানি, সেনিটাইজার সাথে রাখতে হবে। প্রতি বার অজুর সময় ও নামাজ শেষে আবার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে অজু করে তবে ঘরে ফিরতে হবে। নাক-মুখ পরিষ্কার করার জন্য টিস্যু ব্যবহার না করে আলাদা একটা রুমাল ব্যবহার করা উচিত।

ইরানের এক সাংবাদিক ড. এফ্রুজ এস্লামি জানিয়েছেন, তার দেশের (ইরান) জনগণ এখনো যদি কঠোরভাবে বিধিনিষেধ পালন করে তবে শেষ পর্যন্ত ইরানে মারা যাবে ১২,০০০৷ আর মাঝামাঝি সহযোগিতা করলে মরবে এক লাখ দশ হাজার। আর বেপরোয়াগিরি করে কোনো নিষেধাজ্ঞা না মানলে মারা যাবে ৩৫ লাখ।

যেদিন ড. এফ্রুজ এস্লামি তার হিসাবের আর আশঙ্কার কথা বলছিলেন সেইদিন পর্যন্ত ইরানের মৃতের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৫৫৬ আর আক্রান্ত ছিল ২০ হাজার ৬১০। একইদিনে তাদের লাগোয়া পাশের দেশ ইরাকে মৃত ছিল ১৭ জন, আক্রান্ত ২১৪ জন। পাশের আরেক দেশ পাকিস্তানে তখন মৃত ছিল ৩ জন আক্রান্ত ৭২০ জন।

আমাদের অফিস, মসজিদ লিফটের কার্পেট/ম্যাটগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে। খালি মেঝে জীবাণুনাশক দিয়ে যতো তাড়াতাড়ি পরিষ্কার রাখা সম্ভব কার্পেট/ম্যাট সেভাবে পরিষ্কার রাখা সম্ভব নয়। লিফটে আসেন ভাই আসেন ভাই বলে গাদাগাদি করে ওঠার চর্চা বন্ধ করতে হবে। লিফটে উঠলে পরস্পরের দিকে পিছন দিয়ে দাঁড়ান। প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি লাগতে পারে, কিন্তু ভাইরাস মোকাবিলার শিষ্টাচার বা ম্যানার এখন এটিই। লিফটের বোতামে লিফটচালক ছাড়া কেউ হাত দেবেন না। লিফটচালক না থাকলে বোতাম টেপার আগে টিস্যু আঙ্গুলে জড়িয়ে নিন। অনেকেই এ কাজে টুথপিক ব্যবহার করছেন।

অফিসে বাড়িতে ডিসইনফেকটরের অভাবে একগ্যালন পানিতে পাঁচ চা চামচ ব্লিচ মিশিয়ে কাজ চালানোর মতো ডিসইনফেকটর বানিয়ে নেয়া যায়। সেটা দিয়ে দরজার নব/কড়া/হাতল রান্নাঘরের টেবিল পড়ার টেবিল মুছে ফেলতে হবে।

স্কুল বন্ধ। শিশুদের নিয়ে অনেকেই প্রায় অতিষ্ঠ। একজন মা লিখেছেন “ঘরে পোলাপানের সময় কাটে না। বোরড হইয়া মেজাজ খারাপ কইরা ঘুরতেসে।” আরেকজন জানাচ্ছেন “ আমার বাসায় আবার ছানা পুনার ডিভাইস আসক্তি ছুটাইতে...ওয়াইফাই কেটে দিয়েছি। এবার বোঝ, আমরা কেমন আছি!...’

বিদেশে এক মা তার তিন সন্তানকে রীতিমতো বেঁধে রেখে ঘরে বসে অফিসের কাজ সারার দৃশ্য এখন ফেসবুকে ঘোরাফেরা করছে বিনোদন হয়ে।

আসলে এরকম পরিস্থিতি পৃথিবী কখনো দেখেনি। কারো কাছে কোনো প্রস্তুত ব্যবস্থাপত্র নেই। এখনো আমরা প্রকৃত সমস্যার বা সংকটের এককানাও দেখিনি। আমাদের মানসিক চাপ আরও বাড়বে। সবাই সেটা সমলাতে পারবে না, তবে চেষ্টা করতে হবে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রেখে। না ছুঁয়ে না দেখে যোগাযোগ রাখা কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা আর সেটা মোকাবিলার কথাগুলো লিখে রাখুন। পৃথিবী টিকলে পরের প্রজন্মের কাছে তা ট্রেজার হয়ে থাকবে।

আমরা শুধু আমাদের কথাই ভাবছি। বাড়িভাড়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একজন বাড়িওয়ালা ইতোমধ্যেই ভাড়া না নেয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। হয়তো আরও ঘোষণা আসবে। কিন্তু রিকশা চালকদের জমার কি হবে? কি হবে সিএনজির জমা? মালিকরা এটা অর্ধেক করে দিতে পারেন। সরকার কমিয়ে দিতে পারেন গ্যাসের দাম। সাময়িকভাবে জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেলের দাম কমিয়ে দিতে পারেন।

ধানের দামে মার খেয়ে বসে যাওয়া নিরুপায় কৃষক ইরি বোরোতে নেমেছে। তার ডিজেল ও সার’এর দাম না কমলে আসন্ন অতি মন্দার বাজারে সে টিকতে পারবে না। ঢাকার রিকশা চালকদের আয়ের একটা বড় অংশ যায় ধান চাষে এবং সেটার মোক্ষম সময় এটা। তাকে সেচের পানি কিনতে হবে, সার দিতে হবে কমপক্ষে আরও দুইবার, কীটনাশকেও লাগে নগদ টাকা। রিকশা না চললে ধান ফলবে না।

কেউকি শুনছেন কোনোদিন একথা? বিশ্বাস যায়? চালের দাম কী এমনি এমনি বাড়ছে? রিকশায় প্যাডেল মারতে মারতে ক্ষেতলাল উপজেলার আলিম মিয়া আমাকে সেকথাই বললেন।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গবেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর