করোনা থেকে আমরা কি কোনো শিক্ষাই নেব না?

, যুক্তিতর্ক

আদনান সৈয়দ | 2023-08-29 23:54:56

করোনাভাইরাস পরিস্থিতির আগ পর্যন্ত মানুষ ভুলতেই বসেছিল যে, নিজেও সে প্রকৃতিরই অংশ। বিস্মৃত মানবজাতি তাই নিত্যই প্রকৃতিকে ধ্বংস করার বিভিন্নরকম কলা কৌশলে ব্যস্ত রেখেছে নিজেদের। পৃথিবী হারিয়েছে তার স্বভাবসুলভ ঐকতান। প্রাণীকুলের মধ্যে নিজেদের সবচেয়ে বিচক্ষণ ও পণ্ডিত দাবি করা মানুষই খলনায়কের ভূমিকায় পৃথিবীতে নিজেকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছে।

লক্ষ কোটি প্রাণীর বসবাস এই পৃথিবীতে। আর তাদের শাসক হয়ে বসেছে মানুষ। মানুষের ভাবনা, চিন্তা, নিত্য নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, যন্ত্রকৌশল, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সবকিছু নিয়েই মানুষ এই পৃথিবীকে শাসন করতে মাঠে নেমেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ১৮০০ সালে গোটা পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ছিল এক বিলিয়ন। ১৯৬০ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ বিলিয়ন। বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭ বিলিয়নেরও বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯ থেকে ১০ বিলিয়নে।

সময়ের সাথে সাথে মানুষ নিজেকে প্রতিনিয়ত আধুনিক ও সভ্য করেছে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য, পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসম্য যেমনটি থাকার কথা ছিল মানুষের দ্বারা সেই ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে ভূমিকম্প, সুনামি, দাবানল, বন্যা দিন দিন বাড়ছে। কিছুদিন আগেই অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলের আমাজন জঙ্গল, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে দাবানল—মানুষ এবং পরিবেশের জন্য ভয়াবহরকম বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। সেই আগুনে বনের পর বন উজাড় হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে বন্যপ্রাণী, গাছপালা আর দূষিত হয়েছে বাতাস ও প্রকৃতি। বর্তমান পৃথিবীতে নতুন যোগ হয়েছে করোনা মহামারি। ভয়াবহ এই ভাইরাস থেকে কেউ নিস্তার পাচ্ছেন না। প্রিন্স চার্লস থেকে রাস্তার ঝাড়ুদার, সবাই করোনার রোগী। প্রকৃতির প্রতি নিয়মিত স্বার্থপর মনোভাব আর লোভ মানুষকে বর্তমান এই বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে বললে ভুল হবে না। বলাবাহুল্য মানুষই ভুক্তভোগী।

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম হুমকি। পৃথিবীর নানা রকম প্রাণী ইতোমধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সমুদ্রসীমা দিন দিন বাড়ছে, অতিরিক্ত গরমে গলতে শুরু করেছে বরফ। সাইবেরিয়ান বাঘ ইতোমধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়েছে, অস্তিত্ব সংকটের মুখে পোলার ভালুক। নির্বিচারে গাছপালা আর বন উজাড় করা হচ্ছে। কলকারখানার ধোঁয়া, বিভিন্নরকম ক্ষতিকারক রাসয়নিক উপাদানের যত্রতত্র ব্যবহারের কারণে বাতাস এবং মাটি হয়ে পড়েছে বিষাক্ত।

ইতোমধ্যে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে শীতপ্রধান অঞ্চলগুলো ধীরে ধীরে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো উষ্ণ জলবায়ুর দেশে এখন শীতপ্রধান দেশের মতো তুষার পড়তে শুরু করেছে। অত্যুক্তি হবে না, মানুষ নামের এই প্রজাতির অত্যাচারে গোটা পৃথিবীই ঘাবড়ে গেছে। প্রকৃতি যেভাবে চলার কথা ছিল, সেভাবে চলছে না। একটি প্রাণীর, একটি উদ্ভিদের যেভাবে বাঁচার কথা ছিল সেভাবে বাঁচতে পারছে না।

নিউইয়র্কে বছর দুয়েক আগে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনে তাপমাত্রা ছিল ২২ ডিগ্রি সেলিসিয়াস। ভাবুন, যে সময়ে এই শহরে বরফ পড়ার কথা, বদলে গ্রীষ্মের গরমে শহরটি হাঁপাচ্ছিল! এ বছরও ছিল একই দশা। নিউইয়র্কের সেই কনকনে শীত আর নেই বললেই চলে। গোটা পৃথিবীর জলবায়ুবিদরা এই নিয়ে নানা ভাবনায় নিজেদের চুল ছিঁড়লেও তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই ক্ষমতা পৃথিবীর আঁকড়ে ধরা মানুষের।

বর্তমানে প্রতিদিন করোনাভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীব্যাপী প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে। সন্দেহ নেই এই মৃত্যুমিছিল মানব প্রজাতির জন্যেই এক বড় হুমকি। একই সাথে এই পরিস্থিতি থেকেই শেখার ছিল অনেক কিছু। কিন্তু আমরা মানুষরা আদৌ কি কোনো শিক্ষা নিচ্ছি? অভ্যাসগত কোনো পরিবর্তন আনছি? আমরা কি আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করছি? আমরা কি আমাদের শাকসব্জি, ফলমূল, মাছমাংসে অতিরিক্ত বিষাক্ত পদার্থ মিশিয়ে প্রকৃতি এবং মানব জীবনের বিপর্যয় ডেকে আনা থামিয়েছি? বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণে আমাদের কি সামান্যতম কোনো সহানুভূতি তৈরি হয়েছে?

সেদিনও দেখলাম বাংলাদেশের কোন এক অঞ্চলে বিলুপ্তপ্রায় বাঘডাস ভুল করে লোকালয়ে চলে এসেছিল। স্থানীয় জনতা সেটিকে দেখতে পেয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। গাছপালার কথা ভাবুন! আগে গ্রামে প্রচুর গাছপালা ছিল। এখন চারদিকে শুধু চোখে পড়বে ইটের ভাটা, বড় দালান আর কলকারখানা। মানছি সভ্যতা এগিয়েছে, কিন্তু সমানতালে এগিয়েছি কি প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা? প্রকৃতিকে হত্যা করে কোনো সভ্যতা বাঁচতে পারে না, এখন এ সত্যের প্রমাণ মিলছে।

খাল বিল নদী সব ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে ৫০ বছর আগেও নদীর সংখ্যা ছিল ৭৫০টি। এখন সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৩০টিতে! মাত্র পঞ্চাশ বছরে আমাদের নদী ধ্বংস হয়েছে ৫২০টি! সন্দেহ নেই এটি একটি ভয়াবহ পরিসংখ্যান। এদিকে প্রায় প্রতিদিন খাল, বিল, নদী ভরাট হয়ে সেখানে গজিয়ে উঠছে শপিংমল, দালান। তৈরি হচ্ছে নতুন শহরও। আপনার কি মনে হয় না, প্রকৃতি একদিন নিজের পক্ষে ঠিক ঘুরে দাঁড়াবে?

এখন চলছে মানবজাতির অন্যতম বিপর্যয়—ভয়াবহ করোনা মহামারি। মানুষ ঘরবন্দি হয়ে আছে। চারদিকে সুনশান নিস্তব্ধতা। কোথাও কোনো বায়ুদূষন নেই। কলকারখানাগুলো বন্ধ, যানবাহন চলছে না। ঢাকার আকাশ কত নীল! কানে তালা লাগানোর মতো বিকট কোনো হর্ন নেই। শব্দ দূষণ, পানি দূষণ কমে মানুষ এখন প্রকৃতির নিবিড় সংস্পর্শে চলে এসেছে। সমুদ্রপাড়ে এখন কচ্ছপ আর সোনালী ডলফিনদের দল আপনমনে খেলা করছে। লাল কাঁকড়াগুলো সমুদ্র সৈকতে বিচিত্ররকম আলাপনা আঁকতে ব্যাস্ত। করোনার এই দুঃসময়ে মানুষ এসব ঘরে বসে থেকে দেখছে। জানি, এই দুঃসময় থেকে আমরা একদিন মুক্ত হব ঠিকই কিন্তু আবার সব ভুলেও যাব। তারপর আর কী? হয়তো আমরা ফিরে যাব আবার সেই প্রকৃতি ধ্বংসের বন্য মত্ততায়। কিন্তু তেমনটাই কি হওয়া উচিত? করোনা থেকে কি আমরা কোনো শিক্ষাই নেব না? পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্যে ভাইরাসটি কি ন্যূনতম সচেতনও করে যেতে পারবে না আমাদের?

এ সম্পর্কিত আরও খবর