পথে হলো দেরি

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-08-27 05:00:47

নিরাপদ সড়কের দাবি নতুন কিছু নয়।  কিন্তু এবারে এতে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এ আন্দোলনের  পক্ষে-বিপক্ষে নানাজন নানা কথা বলছে। বলবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারের দাবি, দাবি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তারা দেশে নতুন একটি আইন (সংশোধিত) পাশ (মন্ত্রিসভায় অনুমোদন ) করেছে। এতে চালকের শাস্তির মাত্রা বেড়েছে। এতেও একটি পক্ষ সন্তুষ্ট নয়। তাদের দাবি ছিল আইনে কমপক্ষে সাত বছর বা তার বেশি শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। একথা সত্যি, কোনো কোনো দেশে দুর্ঘটনার জন্য দোষীদের ১০ বছর বা চৌদ্দ বছর শাস্তির ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, বেশি শাস্তির ভয় দেখিয়ে কি নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা যায়?  আমরা কি চালকের বেশি শাস্তি চাই, নাকি নিরাপদ সড়ক চাই?  

সড়ক দুর্ঘটনা পুরোপুরি রোধ করা যায় না একথা আমরা জানি। তাই মূল বিষয়টি হলো সড়ক নিরাপত্তা। কেউ কেউ বলেছেন, আইনে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি পাস কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আইন করে কি সড়ক নিরাপদ করা যায়? যদি তাই হতো তবে তো  সব দেশ শক্ত আইন করেই নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতো। আইন সব দেশেই আছে। অপরাধও সব দেশেই হয়। শুধু আইন দিয়ে অপরাধ নিবারণ করা যায় না।  চালকের শাস্তি তিন বছর থেকে পাঁচ বছর হয়েছে। এতে অনেকে একটু খুশি আবার অনেকে নাখোশ। কিন্তু এই আইন পাশ হওয়ার পর থেকেই দেশে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে একথা কি আমরা হলফ করে বলতে পারি? এটি শাস্তির বেশ-কম নিয়ে কথা নয়। আইনের প্রয়োগ ও সড়কে শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টির ওপর আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।

সড়ক পরিবহন আইন বা মোটরযান আইন যা-ই বলি না কেন, এসব আইন দিয়ে আমরা নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে পারবোনা।  আমাদের সড়কগুলো বড় অশান্ত। এই সড়ককে আগে শান্ত করতে হবে। অশান্ত এ কারণে যে এখানে বিরাজ করছে এক চরম অস্থিরতা ও নৈরাজ্য। নৈরাজ্য দূর করবে সরকার। কিন্তু অস্থিরতা দূর করতে সরকার ও জনগণ-দুই লাগবে।

চালকমাত্রই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হলেই কেন যেনো অশান্ত ও অস্থির হয়ে যায়। অনেক ভদ্র-শিক্ষিত লোককে দেখেছি তারা যখনই গাড়ি চালান, একইভাবে অন্যান্য চালকের আচরণ করেন। তাদের আচরণেও দেখা যায় সেই একই ভাব। ড্রাইভারের হট সিটে বসলেই কেন আমরা এতো হট হয়ে যাই বুঝি না।

আসলে আমাদের মানসম্পন্ন সড়ক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। কথায় বলে, একটি দেশ কতটা সভ্য, শঙ্খলাপূর্ণ তা বোঝা যায় রাস্তার অবস্থা দেখে। একটি দেশের রাস্তাই বলে দেবে ওই দেশ কোন দিকে যাচ্ছে? কাজেই আমরা কোন দিকে যাচ্ছি তা রাস্তাই বলে দিচ্ছে।

আমাদের ড্রাইভাররা নাকি গরু-ছাগল চিনতে পারলেই লাইসেন্স পায় ও গাড়ি চালাতে পারে। হতেও পারে। কারণ, এদেশে প্রতিদিন ২০-২৫ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। ২০-২৫টি গরু-ছাগলতো এখানে মারা যায় না। 

দেশের মহাসড়কগুলো যেনো বাড়ির উঠান। মহাসড়কে এখনও ধান শুকাতে দেয়া হয়, মারাই করা ধানগাছও শুকাতে দেয়া হয়। বাড়ির কর্তা গিন্নিকে দৌড়ানি দিলে গিন্নি এক দৌড়ে গিয়ে উঠবে মহাসড়কে। শীতের সকালো রোধ পোহানো থেকে শুরু করে বিকেলের আড্ডা- সবই হয় মহাসড়কের পাশে ঘিরে। সড়ক-মহাসড়কের পাশে বাজারের অভাব নেই পুরো দেশজুড়ে। একই রাস্তা দিয়ে ১০ কিমি গতি সম্পন্ন যানবাহন থেকে শুরু করে ১২০ কিমি গতি সম্পন্ন বাসও চলাচল করে। ঢাকা বা ঢাকার বাইরে একই চিত্র।

কাজেই আইন করে কি পুরো সড়ক ব্যবহারবিধি শেখানো যায়? নিরাপদ সড়কের জন্য যা করা দরকার তা-ই করতে হবে।  সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। রাস্তাঘাটে চলাচলের নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাম দিক দিয়ে চলাচল করার নিয়ম ছাড়া আমরা মূলত রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচলের কোনো নিয়ম-কানুনই প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। চালক, যাত্রী, পথচারী, সাধারণ নাগরিক-সবার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। 

কিন্তু সবকিছুকে বা সবাইকেই তো আর একসাথে রাতারাতি পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু শুরু তো করতে হবে। তাই, গোড়া থেকেই কাজটি শুরু করতে হবে। সব ড্রাইভারদের রাস্তা ঘাটে চলাচলের নিয়ম-কানুনগুলো আগে শেখাতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, সেটা করার জনবল ও মনোবল কোনোটিই বিআরটিএ’র নেই। তাই তাদের উভয় বলই বাড়াতে হবে। গণমাধ্যমও এগিয়ে আসতে পারে। ছোটো-ছোটো একটি-দুটি নিয়ম কানুন মাঝে মাঝো গণমাধ্যমে প্রচার করা যেতে পারে। সরকারি সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই এটি হতে পারে। বিটিভির সংবাদ প্রচারে বাধ্য করার চেয়ে জনহিতকর এসব তথ্য প্রচার করলে ভোটাররাই উপকৃত হবে। দেশে যতো ড্রাইভার আছে তাদেরকে এখন সরাসরি প্রশিক্ষণ দেয়ার মতো লজিস্টিকস আমাদের নেই। তাই গণমাধ্যমকে কাজে লাগাতে হবে। সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে। আন্দোলন মানে সচেতনতা। শিক্ষার্থীদেরও কাজে লাগাতে পারি। আসলে ধীরে ধীরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটি সম্ভব। শিক্ষার্থীরা সেটি করে দেখিয়েছে।

রাস্তায় নিয়ম-মেনে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে চলাচল করার দায়িত্ব আমাদের সবার। এটি শুধু চালকদের না। ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় যতো মানুষ নিহত হয় তার বেশির ভাগই পথচারী। মহাসড়কের চিত্রও প্রায় একই রকম। পথচারীদের রাস্তা পারাপার ও রাস্তা ব্যবহারের নিয়ম-কানুন মেনে চলতেই হবে। সব পথচারীরাই মনে করেন, গাড়িই তাকে দেখে চলাচল করবে। তাই এখানে আমরা সবাই রাস্তার রাজা। 

এই যে আইন বাদ দিয়ে নিয়ম কানুনের সাফাই গাইলাম, সে সব নিয়ম-কানুন কোথাও লেখা থাকেনা। পৃথিবীর কোনো দেশেই এসব লেখা থাকেনা।  রাষ্ট্র ও সরকারকে এসব নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করতে হয়।

চুক্তি ভিত্তিক চালক নিয়োগ বন্ধ হয়েছে বলা হচ্ছে। যদি সত্যি ‌এটি বাস্তবায়িত হয় এটাও একধাপ অগ্রগতি। সব সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনীতির সাথে ‘পরিবহন’-এর যোগাযোগ ছিন্ন করতে হবে। সড়ক দিয়েছে আমাদের অনেক কিছু। গতি, উন্নয়ন এসবই সড়কের অবদান। কিন্তু কেড়েও নিয়েছে অনেক কিছু। হারিয়েছি অনেককে, অনেক কিছু, অনেক প্রাণ, অনেক স্বপ্ন। এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর