করোনা: চীন দায়ী, নাকি ব্যর্থতা ঢাকতেই এ অভিযোগ

, যুক্তিতর্ক

আনিস আলমগীর | 2023-08-25 04:16:36

করোনার উৎপত্তি চীনের উহান থেকে। বলা হয়েছে, বন্য পশু বিক্রির একটি কাঁচা বাজার থেকে মানুষ প্রথম সংক্রমণের শিকার হয়। চীন শুরু থেকে ভাইরাসটি নিয়ে তথ্য গোপন করেছে দাবি করে অনেক দেশই করোনাভাইরাসের বিস্তারের জন্য চীনকে দায়ী করছে। আবার অনেকে বলছেন এটা চীনের ল্যাবে তৈরি করা জীবাণু। তবে অভিযোগ প্রমাণ ছাড়া। এখন তাই প্রশ্ন উঠছে যারা দায়ী করছেন তারা আসলে করোনা বিস্তারে নিজেদের সরকারের আগাম প্রস্তুতির ব্যর্থতা ঢাকতে চীনকে টার্গেট করে দায় এড়াতে চাচ্ছে নাকি সত্যি সত্যি চীন দায়ী।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পতো শুরু থেকেই এটাকে চীনা ভাইরাস বলে উপহাস করে আসছিলেন, যদিও এখন উপহাস থেমেছে। ওয়াশিংটন পোস্টের খবর অনুসারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ডব্লিউএইচও) কর্মরত আমেরিকার ১০ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী করোনা নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা ট্রাম্পকে করোনার প্রত্যেক আপডেট জানিয়ে সতর্ক করলেও তিনি ‘চীনা ভাইরাস’ নিয়ে হাসিঠাট্টা করেছেন। এখন ডব্লিউএইচওকে দায়ী করছেন এবং জাতিসংঘের এই সংস্থাটিতে আমেরিকান ফান্ড বন্ধ করে দিয়েছেন। বলছেন, ডব্লিউএইচও চীনা প্রতিষ্ঠান। তাদের সুরে জাপানও বলেছে ডব্লিউএইচও চীনা সংস্থা।

গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে উহান লকডাউন করার পর সেখান থেকে তিন লাখ ৪০ হাজার লোক আমেরিকায় প্রবেশ করেছে। এমনকি চীনের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার পরও ৪০ হাজার মানুষ আমেরিকায় গিয়েছে চীন থেকে। ট্রাম্প ফেব্রুয়ারি তৃতীয় সপ্তায় ভারত সফর করেছেন। সেখানেও এক শব্দ বলেননি করোনা সম্পর্কে। ভাইরাস এড়ানোর জন্য কোনো ব্যক্তিগত সতর্কতা নিতেও দেখা যায়নি তাকে। এগুলো কি ট্রাম্পের প্রাণঘাতী একটি ভাইরাস মোকাবেলার কোনো লক্ষণের মধ্যে পড়ে!

এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা সারা বিশ্বে এক লাখ ৭৫ হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত ২৫ লাখের বেশি। প্রতি মিনিটে মিনিটে এই সংখ্যা পাল্টে যাচ্ছে। এরমধ্যে এক লাখেরও বেশি মৃত্যু ইউরোপে ঘটেছে সে কারণে ইউরোপের নানা সংস্থা, সরকারও নানাভাবে চীনকে দায়ী করছে কোভিড-১৯ এর বিস্তারের জন্য। জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল চীনকে দায়ী করে কিছু বলেননি কিন্তু তাদের দেশের এক গুজব পত্রিকা খবর করেছে- করোনার জন্য জার্মানির ১০ লাখ কোটি লোকসান হয়েছে। চীনকে এটা দিতে হবে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য ভাল জবাব দিয়েছে এইসব ক্ষতিপূরণ নিয়ে। তাদের মুখপাত্র বলেছেন, ২০০৯ সালে আমেরিকা থেকে এইচওয়ানএনওয়ান ভাইরাস সারা বিশ্বের ২১৪ দেশে ছড়িয়েছে এবং ২ লাখ লোক মারা গেছে। এইডসও ছড়িয়েছিল আমেরিকা থেকে। তার জন্য কেউ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন?

চীন করোনা নিয়ে সতর্ক করেনি, তথ্য গোপন করেছে- এটা আসলে কতটুকু সত্য? ডব্লিউএইচও বলছে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ চীন তাদেরকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে খবর জানিয়েছে। বলেছে এটা দ্রুত বাড়ছে এবং মহামারি হওয়ার আশংকা রয়েছে। ৮ জানুয়ারি চীনের পিপলস ডেইলিতে বড় করে এই ভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে এবং ১৯ জানুয়ারি উহান লকডাউন করার পর সারা বিশ্ব এটা জেনেছে। সারা বিশ্বের মিডিয়ায় সে খবর এসেছে। তারপরও বলা যাবে চীন সতর্ক করেনি?

২৪ জানুয়ারি বিশ্বের দুটি খ্যাতনামা মেডিক্যাল জার্নাল লানসেট (The lancet) এবং দি নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন (The New England Journal of Medicine) চীনের বিজ্ঞানীদের করোনা নিয়ে দেওয়া গবেষণাপত্র ছাপিয়েছে যেখানে করোনার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে সরকারগুলোর মেডিকেল এডভাইজাররা এটা দেখেননি? তারা তাদের সরকারকে অবহিত করেনি কেন? লানসেটের সম্পাদক ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানকে চীনা বিজ্ঞানীদের প্রশংসা করে বলেছেন, চীনের বিজ্ঞানীদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ এই মহামারির সময়ে তারা বিদেশী ভাষায় করোনা নিয়ে তাদের গবেষণা হাজার মাইল দূরে প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছেন যাতে সারা দুনিয়ার লোক সতর্ক হতে পারে।

তারপরও জানুয়ারি গেল, ফেব্রুয়ারি গেল, মার্চের অর্ধেক গেল- সরকারগুলো কী করেছে! ট্রাম্প কী করেছেন!

অবশ্য আমাদের অঞ্চলের বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা ভারত সরকার চীনকে দায়ী করতে দেখা যায়নি। তবে ভারতে সরকার নিজে করছে না কিন্তু সরকারের সমর্থক মিডিয়া, যাদেরকে ‘গোদি মিডিয়া’ হিসেবে সবাই চেনে, তারা কিন্তু চীনকে দায়ী না করে ছাড়ছে না। এরাও ট্রাম্পের তত্ত্ব প্রচার করছে যে উহানের একটি পরীক্ষাগারে এই ভাইরাসকে জন্ম দিয়েছে চীন। এ ধরনের প্রচারণার উদ্দেশ্য একটাই- যাতে করোনা প্রতিরোধে সরকারের ব্যর্থতার ওপর থেকে মানুষের নজর অন্য দিকে সরে যায়।

ভারত অবশ্য ব্যর্থতা ঢাকতে মুসলমানদেরও টার্গেট করেছে। ভারতে করোনাভাইরাসের বিস্তারের জন্য দিল্লির নিজামুদ্দিনে আয়োজিত একটি তাবলিগ জামাতকে দায়ী করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দিল্লিতে তাবলিগ জামাতের সমাবেশ থেকে করোনা ছড়িয়ে পড়ার ফলে হিন্দুদের মধ্যে ‘ভয়’ তৈরি করা হয়েছে। এমনকি মোদির রাজ্য গুজরাটের একটি হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে হিন্দু-মুসলমানের জন্য আলাদা ওয়ার্ড রাখা হয়েছে।

হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর আইটি সেল একের পর এক ‘ভুয়ো খবর’ প্রচার করতে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যেখানে দেখানো হচ্ছে তাবলিগের প্রচার করা রেস্তোরাঁর খাবারে থুতু ফেলছেন, পুলিশের গায়ে থুতু দিচ্ছেন করোনা ছড়ানোর জন্য। আসলে সবই ভুয়া কিন্তু জনমনে বিভেদের বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে দৃষ্টি সরাতে চাইছে বলে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

এদিকে, ২১ এপ্রিল মঙ্গলবার জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো করোনা ভাইরাস বাদুড় থেকে উৎপত্তি হয়েছিল চীনে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র ফাদেলা চাইব বলেন, ‘সকল তথ্য প্রমাণাদি থেকে জানা যায় যে, ভাইরাসটি একটি প্রাণী থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। এটি কোনো গবেষণাগারে বা অন্য কোথাও থেকে ছড়ায়নি।

তিনি আরও বলেন, ‘এটা সম্ভবত প্রাণীর উৎস থেকে বিস্তার লাভ করেছে। তবে প্রাণী থেকে কীভাবে এই ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, এমন ধরনের ভাইরাস ল্যাব থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়া সম্ভব কি না— সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাব দেননি ফাদেলা চাইব। এর আগে দ্য উহান ইনস্টিটিউট এমন দাবিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছিল।

তারপরও প্রমাণ ছাড়া চীনকে দায়ী করা থামবে কিনা জানি না। আর চীনও কি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্যদের দাবী অনুযায়ী একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি করে করোনার জন্ম ল্যাবে হয়েছে কি হয়নি সে নিয়ে তদন্ত করার সুযোগ দিতে এগিয়ে আসবে?

আনিস আলমগীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত

এ সম্পর্কিত আরও খবর