লকডাউন নিয়ে কিছু কথা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মো. উজ্জল হোসেন | 2023-08-29 11:53:09

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন হুজুরের জানাজার লকডাউন ভেঙে সামাজিক দূরত্ব না মেনে লক্ষাধিক লোক অংশ নেওয়ায় সবাই যেভাবে ওই জেলার লোকদের গালাগালি, হাসাহাসি এবং ট্রল করছে, তাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের মানচিত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হঠাৎ করেই যোগ হয়েছে। ওই জেলার মানুষগুলো ভিন্ন কোন গ্রহ থেকে এসেছে। কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ সারাদেশে আপনার আশপাশে কান পেতে শুনুন সারা বাংলাদেশেরই এক টুকরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। অনেক প্রগতিশীল লোকও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন করে বলবে হুজুর অনেক বড় আলেম ছিল তাই সবাই ভালোবেসে জানাজায় গিয়েছে।

আমরা অনেকদিন থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ করছি। রিকশাওয়ালার হাতে পর্যন্ত স্মার্টফোন, কৃষক, জেলে সবার ফেসবুক, বিকাশে সেকেন্ডের মধ্যে বিদ্যুৎ বিল প্রদান, অনলাইন শপিং, মোবাইলে উবার-পাঠাও এর হোন্ডা ডেকে আমরা ভাবছি দেশ ডিজিটাল হয়ে গেছে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জানাজা আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নে কি দারুণভাবেই না চপেটাঘাত করল।

আমরা জেলায় জেলায় সরকারি এবং রাস্তার মোড়ে মোড়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে যখন একটি আধুনিক জাতির স্বপ্ন দেখছি, তখন অনেক নামকরা এমনকি চূড়ান্ত আধুনিক ওয়েস্টার্ন ধারার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও জঙ্গি হচ্ছে।

আমরা যখন জেলায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করছি, বিদেশ থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী যখন আমাদের দেশে ডাক্তারি পড়তে আসছে, আমরা যখন করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করছি, তখন সমাজের বিশাল একটা অংশ কবিরাজের বাড়িতে তাবিজ, কবজ ও ঝাড়-ফুকের জন্য দৌড়াচ্ছে। ঝিনাইদহের সেই ভণ্ড বাবার কথা নিশ্চই মনে আছে। সারাদেশ থেকে প্রতিদিন শত শত বাস ভর্তি করে হাজার হাজার শিক্ষিত, অশিক্ষিত লোক গিয়ে লাইন দিয়ে বসে থাকতো আর হুজুর মাইকে ফু দিত। কয়েকদিন আগেও তো ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ৫০ হাজার লোক জড়ো হলো ফু নেওয়ার জন্য।

আমরা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাচ্ছি, আমাদের বিজ্ঞানীরা পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করছে, আমাদের ছাত্ররা রোবট বানাচ্ছে, আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। অথচ এখনো অনেক মানুষ জীনের বাদশাহের থেকে স্বর্ণমুদ্রা পেতে, মোবাইলে লটারি জিতে, বিকাশের গাড়ি জিতে লাখ লাখ টাকা প্রতারিত হচ্ছে।

আমাদের আছে বিশ্বের প্রভাবশালী নারী প্রধানমন্ত্রী, আমাদের মেয়েরা বড় বড় চাকরি করছে, এভারেস্টের চূড়ায় উঠছে, চালাচ্ছে প্লেন। ভাবছি দেশে বেগম রোকেয়ার নারী জাগরণ ঘটে গেছে। কিন্তু কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে নারী তালাক পাচ্ছে, ৪ বছরের শিশু ধর্ষিত হচ্ছে, মাত্র ৬ হাজার টাকা বেতনে গার্মেন্টসে চাকরি করা মেয়েটি বেতনের দাবিতে আন্দোলন করছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সুনামের সাথে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে কাজ করছে, আফ্রিকার দেশগুলোতে দশকের পর দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করছে। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লুডু খেলায় চুরি করা নিয়ে হাজার হাজার লোক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে, প্রতিপক্ষের কাটা পা নিয়ে করছে আনন্দ উল্লাস।

আমরা গর্ব করে প্রচার করছি আমরা মধ্যম আয়ের দেশ, বছরে ৪ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা হচ্ছে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করছি, হলমার্ক কেলেঙ্কারির পরও আমাদের অর্থমন্ত্রী বুক ফুলিয়ে বলেন ৪ হাজার কোটি টাকা কিছুই না, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রেকর্ড রিজার্ভ আছে, আমরা অচিরেই সিঙ্গাপুর হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। অথচ করোনার থাবায় অসহায় মানুষ যেভাবে ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে, লকডাউন ভেঙে ক্ষুধার জ্বালায় ঘরের বাহির হচ্ছে তা আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার অহংকারকে নতুনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

আজ ভয়ংকর করোনা পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী দিয়ে মানুষকে ঘরে রাখতে হচ্ছে মূলত অজ্ঞতা আর অভাবের কারণে। সমাজের বিশাল একটা অংশকে যুগের পর যুগ জ্ঞানের আলোর বাইরে রেখে এবং সম্পদের অসম বণ্টনের মাধ্যমে ধনী লোক আরও ধনী এবং গরীবকে আরও গরীব বানিয়ে আমি আপনি এসি রুমে বসে পেট ভরে বিরিয়ানি আর চিকেন ফ্রাই খেয়ে বাড়িতে সঙ্গরোধে থেকে লকডাউন লকডাউন করে যতই চিল্লাই তাতে ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর কিছু যায় আসে না।

মো. উজ্জল হোসেন: সহকারী অধ্যাপক, ইনফরমেশন সায়েন্স এন্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর