করোনাকালে মানবিকতাকে জাগ্রত করি

, যুক্তিতর্ক

মুত্তাকিন হাসান | 2023-08-30 23:01:11

বাঙালি তেলেসমাতিতে বিশ্বাস করে। তাই এ দেশে সৃষ্টি হয়েছে কাঁচিবাবা, তালাবাবা, বিড়িবাবা, জুতাবাবা, দড়িবাবাসহ আরও অনেক বাবা। তাদের তেলেসমাতিতে নাকাল দেশের আনাচে কানাচের লোকজন। শুধু এমন তেলেসমাতি নয়। সময়ে সময়ে আমরা দেখতে পেলাম পেঁয়াজ, লবণসহ নিত্যপণ্য নিয়ে অনেক তেলেসমাতি। তাদের বাবারা ধরা ছোয়ার বাইরে। এমন বাবারা দেশে ছিলো আছে, হয়তোবা যুগ যুগ ধরে থাকবে।

মানুষ হিসেবে আমরা যতদূর জানি দুর্যোগ বা বিপদকালে মানুষের মধ্যে মানবিকতা জাগ্রত হয়। করোনাকালে আমরা অনেকেই যখন মৃত্যুর ভয়ে নিজে ভীত হচ্ছি বা পরিবার নিয়ে ভাবছি, জরুরি প্রয়োজনেও বাসা বা বাড়ির বাইরে বের হতে সংকোচ প্রকাশ করছি এবং সাথে ভাবছি সামনের দিনগুলো কেমন হবে, সৃষ্টিকর্তাকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করছি। অন্যদিকে এই এ মহামারিতে অনেকেই এগিয়ে এসেছে। কেউ অর্থ দিয়ে, কেউ সেবা দিয়ে ধন্য করেছে। এমনকি করোনায় আক্রান্তদের সেবা করতে গিয়ে ডা. মঈন ইতিমধ্যে নিজের প্রাণ দিয়েছেন। মানবিকতা কি জিনিস তার উদাহরণ তিনি যথার্থই রেখে গেলেন।

কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে যারা তাদের জিহবাটা অনেক লম্বা। মহামারিকাল আর আকাল যে কালই হোক না কেন? তাদের একটাই চিন্তা- যে তেলেসমাতিতেই হোক নিজের কাল ঠিক রাখা। ত্রাণের চাল নিয়ে অনেক তেলেসমাতি দেখলাম। ইউপি সদস্যের বাড়িতে চালের খনি পাওয়া গেলো। খড়ের পালা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ব্যক্তিগত গোডাউন এবং গাড়ির গ্যারেজে চাল পাওয়া গেলো। অনেক চাল চোরদের চাল পড়া দিয়ে ধরে ইতিমধ্যে বিভিন্নভাবে শাস্তিও দেয়া হয়েছে। এমন চুরির পেছনে অবশ্যই করোনা ভাইরাসের মতো কিছু মানুষরূপী অদৃশ্য ভাইরাস রয়েছে। যতদিন এমন ভাইরাস এ সমাজে বিরাজ করবে, ততদিনই চাল নিয়ে চালবাজি চলবে।

তবে তেলের তেলেসমাতি আমাদের সবাইকে অবাক করেছে। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ এক অভিযান চালিয়ে রংপুর শহরের এক ব্যবসায়ীর বাসার বক্সখাটের ভেতর থেকে টিসিবির ১২৩৮ লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করেছে, যার অনুমানিক মূল্য ১ লক্ষ ২৩ হাজার টাকা। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। বেচারা ব্যবসায়ীর মুখে পড়েছে চুনকালি। করোনায় ভীত না হলেও মানুষ হিসেবে যতদিন বেঁচে থাকবেন আমার মতো অনেকেই তাকে ঘৃণার চোখে দেখবেন।

আমরা সবাই জানি, মৃত্যুর স্বাদ আমাদের সকলকেই গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো কারো নেই। আমাদের অর্জিত সম্পদের এক কানা কড়িও নিয়ে যেতে পারবো না। আর যদি এ মৃত্যু হয় করোনা আক্রান্তে তাহলে জানাজা বা সৎকার করার লোক হিসেবে থাকবে শুধু পুলিশ বা সরকারি কিছু কর্মকর্তা। মহামারি সৃষ্টিকর্তাই দিয়ে থাকেন আবার তিনিই উঠিয়ে নেন। তাই বিশ্বের সকল শক্তিশালী রাষ্ট্র বা ব্যক্তি আজ করোনা কোভিড-১৯ এর কাছে মাথানত করছে। মুসলিম উম্মাহ অনেকেই আজ জুম্মার নামাজ এবং মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায় করা থেকে বিরত আছে, যা ইতিপূর্বে কখনো হয়নি। এ যে এক অদ্ভুদ অনুভূতি। আজান হচ্ছে অথচ অনেকের ইচ্ছা থাকতেও জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারছে না। হিন্দু, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মের অনেকেই উপাসনালয় না গিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ধর্মীয় চর্চা করছে।

এ বৈশ্বিক মহামারিতে আমরা সত্যিকারের মানুষ হই। এই সংকটকালের লড়াইটা আমাদের ভেতর থেকেই করতে হবে। সঙ্গনিরোধ ও সামাজিক দূরত্ব বজায়ের পাশাপাশি একে অপরের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করি। জীবনের প্রতিটি দিন এক রকম হয় না। আজকের এ নিকশ কালো অন্ধকার কেটে হয়তো ভোর হবে। তবে আমাদের অতীত হয়ে থাকবে ইতিহাসের সাক্ষী। নিজেদের জিহবা একটু খাটো করি। নিজেদের প্রয়োজনে, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সব কিছুর ঊর্ধ্বে মানবিকতাকে জাগ্রত করি।

মুত্তাকিন হাসান: কবি, প্রাবন্ধিক ও মানব সম্পদ পেশাজীবী

এ সম্পর্কিত আরও খবর