সতর্কতা: শূন্য হচ্ছে হাত

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

তুষার আবদুল্লাহ | 2023-08-20 10:23:04

হুলুস্থুল অবস্থা চারদিকে। কিট নিয়ে কীট কাণ্ড। পোশাক তৈরি কারখানা খুলবে কি খুলবে না। একদল বলছে কারখানায় আসো। আরেক দল বলছে ওদের আসতে বলিনি। শ্রমিকরা বলছে, না আসলে বেতন, চাকরি কোনটাই থাকবে না এমন চোখ হুঁশিয়ারি আছে। তাই ঢাকার পথে আবারো শ্রমিকের মিছিল। পথ আটকে দিচ্ছে পুলিশ। লকডাউনে শহরমুখী হওয়া যাবে না। লকডাউন চলছে। লুকোচুরি, টিলো এক্সপ্রেস খেলাও চলছে। সবার হাতে চাবি। লকডাউন এলাকার ভেতরটাই বরং বেশি খোলামেলা। চিকিৎসক, পুলিশ একের পর এক কোভিড-১৯ আক্রান্ত হচ্ছেন। কোভিড-১৯ হাসপাতাল খোলা হয়েছে। সেখানে সেবা না পাওয়ার বিস্তর অভিযোগ। পাল্টা অভিযোগও আছে। সেবা দেয়ার ঢাল তলোয়ার নেই। সাধারণ রোগীরা হাসপাতাল থেকে হাসপাতালের দুয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আতঙ্কে কেউ কোভিড সংক্রমণের ভয়ে তাদের চিকিৎসা দিতে রাজি হচ্ছে না। কৃষক তার ফলন জলের চেয়েও কম দামে বেচে দিতে বাধ্য হচ্ছে। আর আদার ব্যাপারীরা জাহাজ কেনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। আজ ত্রাণ নিয়েও তেলেসমাতি কাণ্ড।

এসব হুলুস্থুল কাণ্ডের বাইরে এসে এখন অনেকটা দূর সময়ের দিকে তাকাতে হবে। সিংগাপুরের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পূর্বাভাস দিচ্ছে জুলাইতে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেবে কোভিড-১৯ । করোনা পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে, নাকি মানুষের কাছে পরাভূত হয়ে দুর্বল জীবাণু হয়ে বেড়াবে ভেসে , তা সামনের পৃথিবী বলবে। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, গবেষণা চলছে। আপাতত ভাবতে হবে আগামী দিনের ক্ষুধার ‘প্রকৃতি’র দিকে। সেই আবহাওয়াটা কতো ভয়াবহ হয়ে সামনে আসছে সেদিকটি পর্যবেক্ষণে রাখা অতীব জরুরি।

বিশ্বায়নের তুষ্টির বেলুন চুপসে গেছে করোনার আঁচড়ে। এই মূহুর্তের পৃথিবীবাসী আর বিশ্বায়নের প্রেমে মজতে রাজি নয়। সবাই যার যার চৌহুদ্দিতে চাকরি হারিয়ে বসে আছে। চাকরি হারানো মানুষের সংখ্যাটি গোলকের মতো বাংলাদেশেও কম হবে না। এমন অনেকে থাকবেন যারা আর চাকরিতে ফেরত যেতে পারবে না। দীর্ঘ সময় চাকরির অপেক্ষাতেও থাকতে হবে অনেককে। বাংলাদেশে যেমন করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার বিকাশ ঘটছিল, আউটসোসিং এর অসীম আকাশ স্পর্শ করেছিল আমাদের তরুণরা, করোনার আঘাতে সেই সম্ভাবনার আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে।

এরই মধ্যে দেশের বৃহৎ, মাঝারি শিল্পগোষ্ঠী তাদের লোকবল কমিয়ে আনার কথা ভাবতে শুরু করেছে। উন্নত দেশগুলোর করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়ে বসে আছে। লকডাউনের কারণে ছোট–বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেমন-ট্রাভেল এজেন্সি, আবাসন কোম্পানি, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, সরবরাহ ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউজ, পোল্ট্রি –খামার মালিকরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছেন।

এতে কর্মহীন লোক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, ব্যবসার বা বিনিয়োগের সংকটও তৈরি হচ্ছে। সুতরাং আয় কমে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছেই। প্রতিনিয়ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এরকমও বলা হচ্ছে বাজারে পণ্য বা খাবার থাকলেও, একটি উল্লেখযোগ্য অংশের খাবার কেনার সামর্থ্য থাকবে না। মানুষের কাছে ত্রাণ বা খাবার পৌঁছে দেয়ার চেয়ে এখন জরুরি হয়ে পড়েছে তাদের হাতে টাকা তুলে দেয়া। মানুষের হাত শূন্য হওয়ার আরও কারণ আছে। ভাড়াটেরা বেতন পাচ্ছে না বলে বাড়ির মালিকের কাছে টাকা নেই। দোকান-বিপণী বিতান বন্ধ, মার্কেট মালিক বা দোকান মালিক কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছেন না। দোকান বন্ধ বলে উৎপাদকের কাছে চাহিদা নেই। তাই উৎপাদন বন্ধ। উৎপাদক কর্মচারীদের মজুরি দিচ্ছে না। গণপরিবহন মালিক শ্রমিক, হকার, নাপিতদের একই হাল। অর্থাৎ বাজার অর্থনীতিতে এখন তারল্য সংকট। এই সংকট মেটাতে বাজারে টাকার যোগান যেমন দিতে হবে, তেমনি উৎপাদিত, মজুদ বা আমদানি হয়ে আসা খাবারের সম বণ্টন প্রয়োজন।

যেহেতু মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে, তাই বাজার মূল্য ও মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অতীতে সকল দুর্যোগে সকল দেশেই খাবারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। এবারের দুর্যোগের ভিন্নতা হলো খাবারের সংকটের মুখোমুখি পুরো গোলক। বিশ্বায়নের ‘অ্যাপস’দিয়ে খাদ্য ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয়। সবাই এখন নিজের ‘পাত’ সামলাতে ব্যস্ত। অতএব এই মূহুর্তে অন্যসব হুলুস্থুলে কান চোখ না পেতে বেশ দূরে তাকাতে হবে আমাদের। করোনকাল এবং তার পরবর্তী একটা দীর্ঘ সময় আমাদের খাদ্য নিয়ে ভাবতে হবে। আপাতত মনে হচ্ছে বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিয়ে রাজনীতি শুরু হতে যাচ্ছে। তার আগে নিজেদের গুছিয়ে নেয়া মঙ্গল।

তুষার আবদুল্লাহ: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

এ সম্পর্কিত আরও খবর