বঞ্চিত মানুষ, খণ্ডিত উন্নয়ন

, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-08-28 13:42:09

এক.

সংবাদপত্রের লিড শিরোনাম নয়, কোনাকাঞ্চিতেই জায়গা, কিন্তু শিরোনাম আর পুরো খবরটা পড়ে অনেক্ষণ ধরে থ মেরে থাকি। এই তাহলে আমাদের জীবন!

ঢাকা শহরের লোক সংখ্যা এখন ১ কোটি ৮০ লাখের ওপরে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব তাই বলছে। এরমধ্যে ৬৩ লাখ মানুষের বাস বস্তিতে। মানে ৩৫ শতাংশ লোক বাস করে বস্তিতে। এই বস্তিতে বসবাস করা শিশুরা যে পানি খায় তার শতকার ১০০ ভাগই দূষিত। মানুষের মলে যেসব ব্যাকটেরিয়া থাকে তা পাওয়া যায় এখানকার পানিতে।

গবেষণা বলছে, বস্তির শিশুরা নিয়মিত যে খাবার খায়, তার ৮৬ শতাংশে থাকে বহু ধরনের ক্ষতিকর ছত্রাক। ৭৩ শতাংশ খাদ্যে পাওয়া গেছে ব্যাকটেরিয়া। ডায়রিয়ার জন্য দায়ী ই-কলাই জীবাণু পাওয়া গেছে ৩০ শতাংশ খাবারে। বস্তির শিশুরা বারবার যে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয় তার কারণ খাবার ও পানির এই ভয়াবহ দূষণ।

এ খাদ্য গ্রহণের ফলে অপুষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে বস্তির শিশুরা, বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ। গবেষণার ফলাফলে জানা যাচ্ছে, বস্তির পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ৫৮ শতাংশ খর্বকায়।

আইসিডিডিআরবি-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এসব তথ্য মিলেছে। ১১ আগস্ট ২০১৮ দৈনিক সংবাদপত্রে গবেষণার খবর এসেছে।

দুই.

আমাদের গার্মেন্টস খাতে যে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কর্মরত তারা দিনে ৮ ঘণ্টা করে শ্রম দিলে তাদের দরকার পুষ্টিবিদদের মতে প্রতিদিন ন্যূনতম ২ হাজার ৮০০ কিলো ক্যালরি উৎপাদন করার মতো খাবার। বর্তমান বাজারদরে সেই খাবার সংগ্রহ করার জন্য দরকার দিনপ্রতি ১ শত ৯ টাকা। মাসে দরকার ৩ হাজার ২৭০ টাকা। অথচ এক গবেষণা বলছে পোশাক শিল্পে কর্মরত একজন শ্রমিক খাবারের জন্য মাসে ব্যয় করেন গড়ে ১ হাজার ১১০ টাকা।  ন্যূনতম কাজটা চালিয়ে নেবার জন্য একজন শ্রমিকের খাবারের পেছনে যে পরিমাণ টাকা খরচ করা দরকার বাস্তবে তিনি করতে পারছেন তার তিন ভাগের একভাগ। ‘কী করে বাঁচে শ্রমিক’-শিরোনামের এক গবেষণার ফল বলছে, ৯২ শতাংশ শ্রমিক তার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বলে ঋণ করেন।

খরচ বাঁচাতে ৪১ শতাংশ পোশাক শ্রমিক তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠান। মাদ্রাসায় সন্তানকে পাঠান ২৩ শতাংশ শ্রমিক। মজুরি কম পান বলে বা আয় কম বলে ব্যয় হ্রাস করতে অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে বসবাস করেন পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের একটা বড় অংশ।

৭০ শতাংশ শ্রমিকের বাসস্থানে কোন বারান্দা নেই। প্রতিটি শ্রমিক পরিবারকে গড়ে প্রায় চারটি পরিবারের সঙ্গে বাথরুম, পানির কল, রান্নার চুলা ভাগাভাগি করতে হয়।

তিন.

গল্প উপন্যাসের মতো শোনায়। তবুও পড়ি। এসব গবেষণা আর জরিপের খবর বারবার পড়তে থাকি। কম মজুরির কারণে নাকি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের একটি বড় অংশ খাবারের খরচ কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। গবেষণার ফলাফল বলছে, ৩৪ শতাংশ শ্রমিক মাসে একবারও বড় মাছ খায় না। যে শহরে তারা শ্রম বিক্রি করে বাঁচতে চেয়েছেন, সেই শহরে তাদের আবাস স্থলে ১৬ শতাংশ শ্রমিকের ঘরে ফ্যান নাই। ১৭ শতাংশ খাট ছাড়াই ঘুমান। ৪০-৪৪ শতাংশ শ্রমিকের ঘরে টেবিল চেয়ার নেই। ৬৫ শতাংশের ঘরে টেলিভিশন নাই। ১৬ শতাংশ শ্রমিক মাসে একবারও মুরগির মাংস খান না। সপ্তাহে তিনটি ডিম জোটে একজন শ্রমিকের কপালে। এই হচ্ছে তাদের জীবনযাপনের ভেতর কথা।

চার.

এসব গবেষণার তথ্য নিয়ে ভাবতে বসি। চারপাশে যে এত উন্নয়নের কথা শুনি তাকি কিছুতেই তাদের জীবন বদলাতে পারছে না? এরই মধ্যে জানতে পারলাম শ্রমিকদের মজুরি পুননির্ধারণের কথাবার্তা চলছে। মালিকপক্ষ, সরকার, শ্রমিকপক্ষের মধ্যে চলছে এই নিয়ে দরকষাকষি। এখন সরকার আর পোশাক মালিকরা খুব দূরের নন। সংসদে সাংসদদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের বৃহত্তম অংশ কোনো না কোনোভাবে গার্মেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ফলে মালিকপক্ষের প্রস্তাবিত মজুরি আর শ্রমিকপক্ষের প্রস্তাবের ফারাক আকাশ পাতাল হচ্ছে। সে কারণে শ্রমিকদের পাশে সরকার কি দাঁড়াবে জোরালোভাবে? সেই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাও থাকছে।

পোশাক শিল্পের জন্য গঠিত মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি নিম্নতম মজুরি দাবি করেছেন ১২ হাজার ২০ টাকা। মালিকপক্ষ তার বিপরীতে প্রস্তাব করেছে ন্যূনতম মজুরি হবে ৬ হাজার ৩৬০ টাকা। শ্রমিক সংগঠন উভয়পক্ষের প্রস্তাবকে ‘না’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের দাবি হচ্ছে ন্যূনতম মজুরি হবে ১৬ হাজার টাকা।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের প্রস্তাব হচ্ছে নিম্নতম মজুরি ১০ হাজার ২৮ টাকা নির্ধারণ করা হোক। কিন্তু কে শুনবে কার কথা?

পাঁচ.

বস্তির শিশুরা খর্বকায় হচ্ছে। অপুষ্টিতে ভুগছে। যে পানি আর খাবার খাচ্ছে তা জীবাণুতে ভরা। পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থাও তথৈবচ।

ঢাকা নগরীর জনসংখ্যার একটা বড় অংশ, পোশাক শ্রমিক আর বস্তিবাসী। তাদের এইরকম মৃত্যুর মুখে রেখে, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, খাদ্য ঝুঁকিতে ফেলে কাঙ্খিত  উন্নয়ন কতটা অর্জিত হবে? বড় বড় অবকাঠামোর চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের আলো-ঝলমলে আলোর নিচে এই যে গভীরতর অন্ধকার তা যদি দূর করা না যায় তাহলে সামষ্টিক উন্নয়ন কতটা এগোবে?

এই গবেষণার তথ্য তাই নিছক পরিসংখ্যান হিসাবে বিবেচনার সুযোগ নেই। এই বিপন্ন মানুষ শুধু জনসংখ্যার ভারই বাড়াচ্ছে না, এরা জাতীয় নিরাপত্তাও ঝুঁকিতে ফেলবে। ক্ষুদ্র মানুষ, অনাহারী মানুষ, অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ, ন্যূনতম মৌলিক অধিকার বঞ্চিত মানুষ জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সব সময়ই বিপজ্জনক। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে ব্যয় ক্রমশ বাড়াচ্ছি কিন্তু সমাজের ভেতর ‘ক্ষতিকর বোমার’ উপাদান তৈরি করছি ভুল নীতি আর উপেক্ষার আদর্শ গ্রহণ করে।

আমাদের সংবিধান শুরু যে ‘প্রস্তাবনা’ দিয়ে সেখানে বলা হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার সুনিশ্চিত হইবে।’

কিন্তু আমরা কি বঞ্চিত এই বস্তিবাসীদের জীবনে, পোশাক শ্রমিকদের একটা বড় অংশের জীবনে সেই সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করতে পারছি?

লেখক নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর