করোনাকালে পুলিশের সুরক্ষা জরুরি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-09-01 12:59:13

পুলিশ সদর দপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশের সর্বমোট ৯১৪ জন করোনায় আক্রান্ত (৪ মে, ২০২০ পর্যন্ত), যাদের মধ্যে ৪৪৯ জন ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) কর্মরত। এছাড়া করোনার লক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইসোলেশনে রয়েছেন ৩১৫ জন এবং সংস্পর্শসহ বিভিন্ন কারণে মোট ১২৫০ জন পুলিশ সদস্য কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন।

প্রতিদিন যেভাবে করোনার সংক্রমণ পুলিশ বাহিনীতে বাড়ছে এবং বেশ কিছু পুলিশ সদস্য করোনায় মৃত্যু বরণ করেছেন, তাতে গোটা বাহিনীর মধ্যে শঙ্কা তৈরি হওয়ারই কথা। গণমাধ্যম বলছে, রাস্তায় তল্লাশি ও টহলরত এবং অবিবাহিত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। পুলিশ সদস্যদের অধিকাংশই যেহেতু ব্যারাকে থাকেন, সেহেতু একজন সদস্য একাধিক সদস্যদের সংস্পর্শে আসায় বেশি হারে সংক্রমিত করার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।

এখানে সহজেই প্রশ্ন উঠতে পারে, পুলিশ নিজে সামাজিক দূরত্ব মানতে পারছে কি এবং পুলিশের সুরক্ষা সামগ্রী মানসম্মত ও পর্যাপ্ত কি?

দুই.

করোনা সংক্রমণের দিনগুলোতে ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ এই কথাটি শতভাগ প্রমাণিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত বেশ কিছু পুলিশ সদস্য তাদের নিজেদের রেশন গরীব-দু:খী মানুষের মধ্যে বণ্টন করেছেন। যখন একজন করোনা রোগীকে আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশী সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছেন না তখন নিজেদের জীবনের ঝুঁকির কথা চিন্তা না করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থাসহ ওষুধ থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন পুলিশ।

রাস্তায় পড়ে থাকা ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হোক বা না হোক পুলিশ, সেনা ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্য ছাড়া অন্য কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। আক্রান্ত রোগীকে খুঁজে বের করা, লকডাউন নিশ্চিত করা, লকডাউন এলাকাগুলোতে খাবার, ওষুধসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার মানবিক কাজ করছে পুলিশ। করোনায় মৃত, স্বাভাবিক মৃত কিংবা অন্য রোগে মৃত হলেও নিজেরা লাশ বহন, গোসল, কাফনে মোড়ানো, জানাজা ও দাফন করানোর মত সংবেদনশীল কাজগুলো অনায়াসে করছেন বা করার জন্য অবলীলায় এগিয়ে আসছেন তারা।

এ ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ অথচ সংবেদনশীল কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে মানসম্মত বা পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী তাদের আছে কিনা তা তারা ভাবছেন না। বলা যায় ভাবার সময়ও পাচ্ছেন না। দেশ ও দেশের জনগণের এই বৈশ্বিক সংকটকালে নিজেদের জীবন বাজি রেখে লুকিয়ে থাকা মারাত্মক ভাইরাস করোনার বিরুদ্ধে লড়াই এবং জনগণে পাশে থাকা পুলিশ বিপদের দিনে পরম বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন এবং দেশ ও দেশের মানুষের কাছে নিজ বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন।

তিন.

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, ঢাকা মহানগরীতে প্রতিদিনই কোনো না কোনো পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের আবাসন ব্যবস্থা খুব বেশি সংকট ও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নারী সদস্যসহ মোটামুটি পুলিশের সব বিভাগ বা ইউনিটের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যেহেতু এটি একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী, সুতরাং একজন আক্রান্ত হলে সহজেই তা অন্যান্য সদস্যদেরকে অনায়াসে সংক্রমিত করছে।

অন্যান্য বাহিনীর চেয়ে করোনায় পুলিশের আক্রান্তের বিষয়টি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। পুলিশে সুরক্ষা সামগ্রী পর্যাপ্ত কিনা? সুরক্ষা সামগ্রী যথেষ্ট মানে উন্নত ও নিরাপদ কিনা? পুলিশ সামাজিক দূরত্ব মানছে কিনা বা মানতে পারছে কিনা? নিজেদের সুরক্ষা পোশাক নিয়ে তারা উদাসীন কিনা? সুরক্ষা পোশাক ব্যবহারে অনীহা আছে কিনা? রাস্তায় তল্লাশি ও টহলরত পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালনের সময় অসচেতন হচ্ছেন কিনা? দায়িত্ব পালন শেষে একই গাড়িতে অনেকের সাথে ব্যারাকে ফিরছেন কিনা? ব্যারাকে অসচেতনভাবে অন্যের সাথে সামাজিক ও ব্যক্তিগত মিথস্ক্রিয়ায় আসছেন কিনা? আক্রান্ত সদস্য নিজের অজান্তেই অন্য সহকর্মীকে সংক্রমিত করছেন কিনা? ব্যারাকে ফেরার পর সুরক্ষা সামগ্রীতে এবং ব্যারাকের আবাসিক কক্ষগুলোতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হয় কিনা? একই পুলিশ সদস্য বারবার দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন কিনা? সংবেদনশীল দায়িত্ব পালন শেষে পুলিশ সদস্যদের সেই দলকে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনে রাখা হচ্ছে কিনা? টহলের সময় সদস্যদেরকে শৃঙ্খলিত রাখার জন্য কমান্ডিং অফিসার আছেন কিনা? সংবেদনশীল দায়িত্ব পালন শেষে তাদেরকে মেডিকেল চেক-আপ করা হচ্ছে কিনা? পরিবার নিয়ে বাস করা পুলিশ সদস্য তার পরিবারের জন্য নিরাপদ কিনা? করোনা উপসর্গ নিয়ে কোন পুলিশ সদস্য অফিস করছেন কিনা? প্রভৃতি অনেক প্রশ্ন সামনে আনে যা সরকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ যাদের অধীনে পুলিশের সদস্যগণ নিরলস ও ক্লান্তিহীন কাজ করছেন, তারা ভালোভাবে এবং গুরুত্ব সহকারে বিষয়গুলি ভাববেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।

চার.

দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি পুলিশের সহমর্মিতা করোনার দিনগুলোতে যেভাবে সামনে এসেছে তা সুদূর ও নিকট অতীতে এভাবে দৃশ্যমান হয়েছে বলে মনে হয় না। করোনাকালে পুলিশ যে নিরন্তর মানবিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সত্যিই খুব কঠিন। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ে ও চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করে এবং ত্রাণ আত্মসাতের সাথে জড়িত আসামিদের ধরতে গেলে সামাজিক দূরত্ব মানা ও নিশ্চিত করা কঠিন। মানবতা হলো দু:সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। পুলিশসহ সকল করোনা যোদ্ধারা সেই কাজটিই করছেন। কিন্তু তাদের সকলের জন্য সরকার, রাষ্ট্র ও জনগণ হিসেবে আমরা কিছু করতে পারছি কিনা সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: প্রাথমিক ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য বিষয়ক পিএইডি গবেষক, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক ও সাবেক চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ

এ সম্পর্কিত আরও খবর