আমরা আবার ভুলে যাবো নাতো সবকিছু!

, যুক্তিতর্ক

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক | 2023-09-01 10:04:56

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

মহত্ত্ব, ঔদার্য, সহমর্মিতা, সমমর্মিতা, সহযোগিতা, সমাজবদ্ধতা, অংশীদারিত্ব, ভাগাভাগি, সামাজিকতা, সঙ্গপ্রিয়তা, যুথবদ্ধতা, নিরপেক্ষতা, সমতা, জনমুখী, গণমুখী, নাগরিকতা, পারস্পরিকতা, সমন্বয়, জনসাধারণ, সম্পদ, সংবাদ, সম্মান, সংলগ্ন, সংলাপ, অবদান, খোলামন, কল্পনা, জ্ঞানার্জন, সৃষ্টিশীলতা, উদ্ভাবন, পরীক্ষণ, নিরীক্ষণ এই শব্দগুলোর কথা একটু ভাবুন।

সময়টা জানা সময়ের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ তাতে সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু মুদ্রার উল্টোপীঠটাতে দেখুন- এটিই বোধ হয় জানা সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সময়ও আমরা পার করছি। যখন পরিস্থিতির বিবেচনায় মনে পড়ে যাচ্ছে উপরে উল্লিখিত শব্দগুলোও। কারণ চরম উদ্বেগের মধ্যেও আমরা একে অন্যের জন্য শক্তির উৎস হয়ে উঠছি। একাকীত্ব থেকেই আমরা আমাদের সমাজকে নতুন করে চিনছি। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থেকেই আমরা বুঝে নিচ্ছি কাকে বিশ্বাস করা যায়, কাকে নয়। প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেই আমরা বুঝতে পারছি, নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান আমাদের জীবনের জন্য মূল্য বহন করে। প্রত্যেকেই বুঝে নিচ্ছি নিজ নিজ বিশ্লেষণ আর বিমূর্ত ভাবনা থেকে। এতে যদি আপনার-আমার আত্মার পরিস্ফুটন হয়ে থাকে তবে সেতো বিপরীতেই হীত।

ধন্যবাদার্হ ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ক, যার সুবাদে আমরা অনেকেই আমাদের ভাবনাগুলো প্রকাশ ঘটাতেও পারছি।

হ্যাঁ এটা সত্য- অমানবিকতা, মনুষ্যত্ব বিবর্জিত কিছু ঘটনার মধ্য দিয়েও আমরা যাচ্ছি। এখনও ধর্ষিত হচ্ছে শিশু, পারিবারিক পর্যায়ে সংঘাত বেড়েছে, বেড়েছে পারিবারিক নির্যাতন। মাকে জঙ্গলে ফেলে পালাচ্ছে সন্তান, মা নদীতে ফেলছে বুকের ধন, বাবার লাশ ফেলে রেখে কেটে পড়ছে সন্তান, স্বামীকে ফেলে রেখে পালাচ্ছে স্ত্রী,  স্ত্রীকে চোখ তুলেও দেখছে না স্বামী-এসবও সত্য। এবং এক একটি অতি বাস্তবতা।

তার মাঝেও আমরা আজ আমাদের ফ্রন্টলাইন ফাইটারদের দেখছি— সকল ঝুঁকি উপেক্ষা করে রোগীর চিকিৎসা দিয়ে চলেছেন চিকিৎসকরা। নার্সরা দিচ্ছেন সেবা। তাতে আমরা মৃত্যু কমাতে পারছি, তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। বরগুনার একটি হাসপাতালে করোনা পজিটিভ নিয়ে ভর্তি হওয়া সকল রোগীকেই সুস্থ করে তুলে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। সে হাসপাতালের চিকিৎসক কামরুল আজাদের অসীম মনোবল ও আত্মনিয়োজনের খবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে। সম্মুখ সারির যুদ্ধে আমরা চিকিৎসকদের সাফল্যের খবর এখন বেশি বেশিই পাচ্ছি। অনেক রোগী এখন সুস্থ হয়ে ফিরছেন। সম্মুখ সারির অপর একটি লড়াকু অংশ পুলিশ বিভাগের সদস্যরা। তারা নিজেদের জন্য মানবিক পুলিশের তকমা অর্জন করেছেন। তারা নিজেরা নিজেদের সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে আত্মীয় পরিজন ফেলে যাওয়া রোগীকে পথ-জঙ্গল থেকে তুলে এনে হাসপাতালে পৌঁছাচ্ছেন, আবার কেউ মৃত্যুবরণ করলে সেখানেও যেহেতু ঘেঁষছে না আত্মীয়-পরিজন, সেখানেও পুলিশ সদস্যরা দাফন সম্পন্ন করছেন।

আমরা ঝিনাইদহের সেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বদরুদ্দোজা শুভ’র কথা বলতে পারি, যিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা রোগীর জানাজা নিজেই পড়িয়েছেন। আমরা বলতে পারি পুলিশ সুপার আবুল বাশারের কথা যিনি তার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে দাফন সম্পন্ন করেছেন।

সমাজে আমরা সবাই স্বাধীন। এমন সব গভীর সঙ্কটকালেই আমরা আমাদের নিজেদের অনেক বেশি চিনতে পারি। আর এমন সঙ্কটই আমাদের মনে করিয়ে দেয় কিছু সত্য। এমন সঙ্কটকালের কোন কোন মুহূর্ত আমাদের সামনে সম্ভাবনার ঐতিহাসিক ক্ষণ হয়ে ধরা দেয়। আবার কোন কোন ক্ষণ আমাদের কাছে হয়ে থাকে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া মুহূর্ত হয়ে।

এমন সময়গুলোতে আমরা ভুলও অনেক করি। আবার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই এগিয়ে যাই। কোন কোন ভুল ঐতিহাসিক হয়ে ধরা দেয়। আবার কোন কোন সঠিক সিদ্ধান্তও সুযোগ করে দেয় বড় অর্জনের কিংবা বড় বিপদ থেকে মুক্ত থাকার।

এই দেখুন করোনার সময়কাল, সবচেয়ে বড় ভুলটা করে বসলেন দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পখাতের গুটিকয় মালিক। তারা ব্যবসা বাঁচাতে, শ্রমিকদের জীবন নিয়ে খেললেন। শত শত মাইল পায়ে হেঁটে, কিংবা ট্রাক-লরিতে গাদাগাদি করে চেপে যে মানুষগুলো ঢাকায় এলো এবং ফিরে গেলো, তারই কিন্তু অনিবার্য পরিণতি আজ আমরা দেখছি। গোটা বিশ্বে যখন নতুন রোগি শনাক্তে ডাউনট্রেন্ড চলছে, তখন বাংলাদেশে তা ঊর্ধ্বগতি। একটি টেলিভিশন টকশোতে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক দায়িত্ব নিয়ে বলছিলেন, জেলাটিতে করোনা রোগীর সংখ্যা ওই ঘটনার কারণেই বেড়েছে।

আসলে দরকার একটি সুসমন্বয়। শুরুতেই যে শব্দটি বলেছি। পারস্পরিক সমন্বয় হলেই কিন্তু একটি বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান আসে। ঝিনাইদহে যেমনটি হয়েছে, ইউএনও জানাজা পড়েছেন, পুলিশ সুপার এগিয়ে এসে মৃতদেহ দাফনের ব্যবস্থা নিয়েছেন। ঘটনা হিসেবে অতি ছোট। কিন্তু সমন্বয়টি ছিলো বলেই এই খবর জাতীয় সংবাদমাধ্যম হয়ে, আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও স্থান করে নিতে পেরেছে। আর চরম সমন্বয়হীনতার কারণে, গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের ঢাকায় টেনে এনেছে, আর পুলিশ তাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য পিটিয়েছে।

আবার দেখুন ধানকাটার বিষয়টি। করোনার এই ক্রান্তিকালে চাষির ক্ষেতের ধান পেকেছে। কিন্তু কাটার লোক নেই। দূর গাঁয়ে কিষাণের ভাগ্যের কথা নিয়ে ভাবলেন খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী। ভেবে উপায়টিও তিনিই বের করলেন। কিশোরগঞ্জের ধানকাটার জন্য চট্টগ্রাম থেকে সকল স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করে আনা হলো মজুর। কিন্তু এত ধান কাটার জন্য আরও মানুষ প্রয়োজন। সে নিয়ে ভেবে প্রধানমন্ত্রী নিজের দলের নেতা-কর্মীদের বললেন, তারা যেন নিজ নিজ এলাকায় কর্মীদের দিয়ে কৃষকের ধান কাটিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। আর যায় কোথা। শুরু হলো ধানকাটা নিয়ে চরম এক হ্যাংলামো। হ্যাঁ কোথাও কোথাও কাজটি নেতা-কর্মীরা সুচারুভাবে করেছেন বটে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়টি নিয়ে হয়েছে দুর্বল রাজনীতির চেষ্টা। ফলে জুতো পায়ে কাস্তে হাতে মাঠে নেমে পড়েছেন স্বয়ং সংসদ সদস্য। তার সঙ্গে শতশত কর্মীর মহড়া। ছবি, সেলফির মচ্ছব। এতে কৃষকের ধান যতটা না কাটা হয়েছে তার চেয়ে পায়ের তলায় দলা পড়েছে বেশি।

আমরা স্বেচ্ছাসেবীদের সক্রিয়তাও দেখেছি। এক টাকায় আহারের সফল ও মহৎ উদ্যোগ যেমন দেখেছি। তেমনি বিদ্যানন্দ নামকে হিন্দুয়ানি তকমা দিয়ে, মহৎ কাজের ওপর নোংরা আক্রমণও দেখেছি। ধর্মকে এমন ন্যাক্কারজনকভাবে উপস্থাপন আমাদের বিস্মিতই করেনি, সামাজিক জীব হিসেবে নিচু স্তরেও নামিয়েছে।

এদিকে, সংবাদমাধ্যম যে পুরোপুরি মুক্তভাবে কাজ করতে পেরেছে তা নয়। মিডিয়াকে যাতে তথ্য দেয়া না হয়, মিডিয়ার সাথে যাতে কথা বলতে না পারে সে লক্ষ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করে মুখ বন্ধ করার উদ্যোগও দেখা গেছে। করোনার ভয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে যতটুকু সম্ভব, ততটুকুই সাংবাদিকতা করে আসছে সংবাদমাধ্যমগুলো। তার উপরে এসে এমন সব সিদ্ধান্ত তথ্য প্রবাহকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

এর মধ্যে মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকেও অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনা ক্রান্তির মধ্যেই সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, লেখকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। মামলার পর গ্রেপ্তার, কারাগারে পাঠানোর ঘটনাও ঘটেছে।

তবে, করোনা ভাইরাস নিয়ে লিখতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলা সাংবাদিকের কলামে এক সময়ের পর্নো তারকা, এখনকার শক্তিশালী এক অভিনেত্রীর সঙ্গে ভাইরাসের তুলনা করে সার্বিকভাবে সাংবাদিকতাকে কলঙ্কিত করার মতো ঘটনাও ঘটছে এই সময়ে।

ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবেত্তা আলেক্সে দ্য তকভিল প্রায় দুইশ’ বছর আগে বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক সমাজে সমন্বয়ের জ্ঞানটা অন্য সকল জ্ঞানের সুতিকাগার। অগ্রসরতা সবকিছু মিলে হয়, একক কিছু তা সম্ভব করে তুলতে পারেনা। তৈরি পোশাক খাতের বিষয়টি, আর ধান কাটার কিছু বিচ্যুতি এসব আমরা দেখেছি। তবে তা সত্ত্বেও অন্য বিষয়গুলোতে অনেকটা সমন্বয় আমরা স্পষ্টই দেখতে পেয়েছি এই করোনা মহামারির কালে। এই সমন্বিত প্রচেষ্টার মূল ভাগে চিকিৎক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি দেশের সশস্ত্র বাহিনীর কর্মতৎপরতাও আমরা দেখেছি। তাদের সক্রিয়তায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণে একটা শৃঙ্খলা তাতে দ্রুতই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

এসব কিছুর সাথে একটি অনিবার্য শক্তি হিসেবে পাশে থেকেছে দেশের সংবাদমাধ্যম। ফ্রন্টলাইন ফাইটারদের মতো তারাও তুলে এনেছে সঠিক সংবাদ। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ওয়ার্ক ফ্রম হোম এ থেকেও সংবাদ কর্মীরা কাজ করেছে দিনরাত। তার জন্য খেসারত যে গুনতে হয়নি তা নয়। বৃহস্পতিবার অবধি অন্তত একজন সংবাদকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ও দুইজন উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন কয়েক ডজন সাংবাদিক। আক্রান্ত রয়েছেন আরও কয়েকজন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও সংবাদ কর্মীরা সঠিক তথ্য তুলে এনে-গুজব প্রতিহত করার কাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পেরেছেন, সে কথা অনস্বীকার্য। এমন নাজুক সময়ের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির অসাধুরা ফেক মেশিন ফ্যাক্টরি থেকে গুজব ছড়াতে শুরু করে। বাংলাদেশে সে প্রচেষ্টা কমবেশি চলছে। কিন্তু মূলধারার সংবাদকর্মীদের সক্রিয়তায় সেগুলো ডালপালা ছড়াতে একটু কমই পেরেছে।

স্ব-অন্তরণই হোক, কিংবা লকডাউনের বাধ্যবাধকতায় হোক আমরা ঘরেই আছি। আর ঘরে বসেই জানছি, বুঝছি এতসব খবর। তবে এরই মধ্যে আমরা নিজেরা নিজেদের পুনরাবিষ্কারের সুযোগটাও বুঝে পাচ্ছি। সমন্বয়ের শক্তিটাও আমরা উপলদ্ধি করতে পারছি। গত দিনগুলোতে কোনো কিছুই কিন্তু আমাদের পাশে ছিলো না। না অফিস, না স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, না বন্ধু, না হোটেল রেস্টুরেন্টে চেকইন, জিমে শরীর চর্চা, কিংবা পার্লারে রূপচর্চা, হয়নি মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় কিংবা মন্দিরে পূজাপাঠ। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা টিকে আছি। আমাদের মনে মহত্ত্ব, ঔদার্য, সহমর্মিতা, সমমর্মিতা, সহযোগিতা, সমাজবদ্ধতার কথাগুলো আসছে। আমরা বলছি সুসমন্বয়ের কথা।  আগেই বলেছি ধন্যবাদ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। এবার বোধহয় সমন্বয়ের দায়িত্বটা ইন্টারনেটই সবচেয়ে বেশি নিয়েছে।

তবে করোনাকালের এটাই বুঝি সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। দুর্যোগ একদিন কেটে যাবে। আসবে সুন্দর কোনো ঝকঝকে সকাল। এখনি, নয়তো আরও কিছুদিন পরে। তখন আমরা আবার এসব ভুলে যাবো নাতো!

এ সম্পর্কিত আরও খবর