বঙ্গবন্ধুর কল্যাণধর্মী উন্নয়ন ভাবনা ও সমকালীন বাংলাদেশ [পর্ব ৩]

, যুক্তিতর্ক

ড. আতিউর রহমান | 2023-08-31 14:08:54

প্রথম পর্বের লিংক
দ্বিতীয় পর্বের লিংক

বঙ্গবন্ধু এবং আগামীর বাংলাদেশ
স্বল্প পরিসরের এই আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বঙ্গবন্ধুর সকল ভাবনার মূলে ছিলেন সাধারণ মানুষ। সেই শৈশব থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি কৃষকের কল্যাণ, শ্রমিকের কল্যাণ, সাধারণের মঙ্গল-ভাবনায় ছিলেন সমর্পিতপ্রাণ। প্রশাসক হিসেবেও সর্বক্ষণ তাঁর পক্ষপাতিত্ব ছিল সাধারণের দিকে। তাঁর দেওয়া সংবিধানই এর বড় প্রমাণ। সাধারণ মানুষকে তিনি প্রজাতন্ত্রের মালিক বানাতে চেয়েছেন ওই সংবিধানের মাধ্যমে।

তাঁর শাহাদাৎ বরণের পর স্বদেশ হাঁটতে থাকে অন্ধকার ও অনিশ্চিত এক গন্তব্যের দিকে। দীর্ঘ একুশ বছর ধরে উল্টোপথে হাঁটা সেই বাংলাদেশকে ফের ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সড়কে তুলে আনেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর গরিব-হিতৈষী কৃষক ও উদ্যোক্তা-বান্ধব উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে’ তুলে আনেন তিনি। ফের ছন্দপতন ২০০১ সালে। আবার মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিরোধী অপশক্তির দাপটে হতাশায় নিমজ্জিত হয় বাংলাদেশ। মাঝখানে দু’বছরের সামরিক হস্তক্ষেপের পর বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ফের ক্ষমতায় আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে প্রায় একদশক ধরে এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ। নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও গত এক দশক ধরে ৬ শতাংশেরও বেশি হারে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটছে। গত তিন বছর ধরে তা বেড়েছে ৭ শতাংশেরও বেশি হারে। গত অর্থবছরে বেড়েছে ৭.৬৫ শতাংশ হারে। এ দশকে অবকাঠামো খাতে ব্যাপক হারে সরকারি বিনিয়োগ হয়েছে (জিডিপির ৪.৩% থেকে ১২.২%)। পদ্মা সেতু, এলএনজি টার্মিনাল, মেট্রোরেল, পায়রা বন্দর, রূপপুর আণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চারলেনের রাস্তা, ফ্লাইওভারসহ ব্যাপকহারে অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের শক্তিশালী পাটাতন নির্মাণ করেছে সরকার। গত একশো বছরে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষম অবকাঠামো মাত্র দশ বছরে তিনগুণেরও বেশি উৎপাদনসক্ষম করে গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের খাদ্য উৎপাদন বেড়ে স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে। গত এক দশকে অতি দারিদ্র্য কমেছে ১৭.৬ শতাংশ থেকে ১২.৯ শতাংশে। আমাদের মাথাপিছু আয় ২০০৮ সালের হিসেব থেকে তিনগুণ বেড়ে ১৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমরা এখন স্বল্পোন্নত দেশের তকমা ঝেড়ে জাতিসংঘ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পরিচয়ের ছাড়পত্র পেয়েছি। আমাদের গড় আয়ু এখন ৭২.৫ বছর, যা একজন ভারতীয়’র চেয়ে চার বছর এবং একজন পাকিস্তানীর চেয়ে ছয় বছর বেশি। এক দশকে শিশু মৃত্যুর হার হাজারে ৩৯ থেকে নেমে ২৮ হয়েছে এবং মাতৃ মৃত্যুর হার হাজারে ২.৫৯ থেকে কমে ১.৭৮-এ দাঁড়িয়েছে। মনে রাখা চাই ১৯৭২ সালে ৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির আকার এখন দাঁড়িয়েছে ২৮০ বিলিয়ন ডলার। এই দশকে ১৬ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

গ্রামে গঞ্জে মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ আর্থিক সেবা ব্যাপক হারে পৌঁছে গিয়েছে বলে সহজেই রেমিটেন্স ও অর্থের লেনদেনও বেড়েছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুনর্জাগরণ ঘটেছে। খালি চোখেও গ্রাম-বাংলায় অর্থনীতির দিন বদল দেখা যায়। গ্রাম আর শহরের অর্থনীতিতে সংযোগ বেড়েছে। আট হাজারেরও বেশি অনলাইন রিটেল ব্যবসায়ী প্রতিদিন সামাজিক মধ্যমে ব্যবহার করে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। ই-কমার্স, ক্ষুদে ও মাঝাারি উদ্যোগে নারীর অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে। সর্বত্রই অর্থনীতির গতিময়তা চোখে পড়ছে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতি যে স্থিতিশীল রয়েছে তা তিনটি আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিই তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে। সম্ভাব্য রাজনৈতিক ঝুঁকির কথা স্বীকার করেও তারা বলেছেন আগামী দিনের অর্থনীতি স্থিতিশীলই থাকবে। তবে আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনাকে আরো শক্ত হাতে পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছে তারা। তাদের এই পরামর্শের সাথে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাও একমত। কেননা ব্যাংকিং খাত যে অর্থনীতি হৃৎপিণ্ড। তাই তাকে সবল ও সচল রাখার কোনো বিকল্প নেই। নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের যে নয়া কৌশল বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্ভাবন করেছে তার বাস্তবায়নে নিবেদিত থাকা গেলে এই খাতের ঝুঁঁকি মোকাবেলা সম্ভব। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর অমর্ত্য সেন, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ প্রফেসর কৌশিক বসু এবং বর্তমান প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার বাংলাদেশের বিস্ময়কর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রশংসা বরাবরই করে যাচ্ছেন। এই সাফল্যের পেছনে মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আর সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার লড়াকু মন তৈরি করে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর আপোষহীন নেতৃত্ব। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্নিমাণের নেতৃত্বও তিনি দিয়েছেন একইভাবে। তাই দুর্যোগে দুর্বিপাকে ঘুরে দাঁড়াবার এক অসাধারণ সহনশক্তি অর্জনে আমাদের পুরো জাতির বিশ্বব্যাপী সুনাম রয়েছে। সেই অন্তর্নিহিত শক্তিকে পুঁজি করেই আমরা এগিয়ে যেতে চাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আদলে আগামীর বাংলাদেশ গড়তে। সেই স্বপ্নিল সোনার বাংলা গড়ার কাজে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মন প্রাণ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর উদ্যম, স্বদেশ প্রেম, প্রশাসনিক দক্ষতা, গণমুখী চিন্তচেতনা নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে চলেছেন দৃপ্ত পদক্ষেপে। উন্নয়নের এই অভিযাত্রাকে আরো বেগবান ও টেকসই করতে আমাদের বেশ কিছু নীতিকৌশলের দিকে নিরন্তর মনোযোগী থাকতে হবে :

এক. অবকাঠামো উন্নয়নের অংশ হিসেবে মেগা-প্রজেক্টগুলোর বাস্তবায়নের ধারা এমনভাবে অগ্রাধিকার দিয়ে চালু রাখতে হবে যাতে করে সময়ের দাবি অনুযায়ী প্রযুক্তিগত সংযুক্তি বাড়ে। এর ফলে ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তারা প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনে বেশি করে যুক্ত হয়ে আমাদের অর্থনীতিকে আরো দক্ষ করে তুলবেন। রপ্তানি আয় ও সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই ধরনের সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের অগ্রাধিকার বিন্যস্ত করতে হবে। এফডিআই বাড়লে বিদেশ থেকে নয়া জামানার ধ্যান-ধারণা ও প্রযুক্তির সংযোজন ঘটবে আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। ভিয়েতনাম ও কমবোডিয়ায় জিডিপির ৬ ও ৯ শতাংশ এফডিআই এলে আমাদের দেশে তা কেন এক শতাংশের গণ্ডিও পার হতে পারছে না? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্যি আমাদের নীতি নির্ধারকদের খোঁজার চেষ্টা করতে হবে।

দুই. বিপুল হারে আমাদের শিক্ষিত তরুণদের জন্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। শুধুমাত্র সরকারি খাতে চাকুরির মধ্যমে তা সম্ভব নয়। তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি-নির্ভর উদ্যোগে উৎসাহী করার জন্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন ও বাজার তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করে দেবার নীতি উদ্যোগ সরকারি ও ব্যক্তিখাতকে নিতে হবে। ই-কমার্স তথা ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে নয়া ধারা অর্থায়নের সুযোগ অবশ্যি আমাদের তৈরি করতে হবে।

তিন. নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তারাই বেশি বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবেন। সে জন্যে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমকে নতুন করে সাজাতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্ভাবন কেন্দ্র প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই স্থাপন করতে হবে। আমাদের সবচেয়ে সফল রপ্তানি শিল্প বস্ত্রখাতের প্রকৌশল ও ব্যবস্থাপক তৈরি করাকে অগ্রাধিকার হিসেবে উচ্চ শিক্ষানীতিতে যুক্ত করতে হবে।

চার. আমাদের সফল উদ্যোক্তারা যেন মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নে কোনো বাঁধার মুখে না পড়েন সে দিকে খেয়াল রেখে আর্থিক খাতের তিনটি রেগুলেটর কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সিকিউরিটি কমিশন ও বীমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে সমন্বিতভাবে সুদূরপ্রসারি নিয়মনীতি উদ্ভাবন ও পরিচালনায় মনোযোগী হতে হবে।

পাঁচ. দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে স্থিতিশীল করার জন্যে জ্বালানি সরবরাহ অপরিহার্য। বাংলাদেশ সনাতনি জ্বালানি উন্নয়নে বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগ সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগকে টেকসই করতে হলে প্রয়োজনীয় অর্থপ্রবাহ (দেশি-বিদেশি) নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আগামী দিনের জ্বালানী অবশ্যি সবুজ উৎস থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এখন থেকেই ওই দিকটায় নজর দিতে হবে। ঘরে ঘরে কী করে সবুজ জ্বালানী উৎপাদন করা যায় সে জন্যে প্রয়োজনীয় রাজস্ব-প্রণোদনা (‘নেট মিটারিং’-এর মাধ্যমে) নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের প্রধান রপ্তানি শিল্পকে সবুজায়নে বড় মাপের আর্থিক সহযোগিতা ও প্রযুক্তিগত রূপান্তরের নিয়মনীতি চালু করতে হবে।

ছয়. জিঞ্জিরা, ধোলাইখাল, কেরানিগঞ্জ, যশোর ও বগুড়াসহ অসংখ্য হাল্কা প্রকৌশল কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তা রয়েছেন। তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন দিয়ে, দেশি-বিদেশি বাজারের সাথে যুক্ত করা গেলে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানে এক ধরনের বিপ্লব আনা সম্ভব। নীতি-নির্ধারকদের এ দিকটায় নজর দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে শিল্পায়নেও বহুমুখীকরণ করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। বস্ত্র ও চামড়া ছাড়াও আমরা ওষুধ, সিরামিক, মটর গাড়ির যন্ত্রাংশ এবং তথ্য প্রযুক্তির পণ্য তৈরির শিল্পে বাড়তি মনোযোগ দিতে পারি।

সাত. শুধু শিল্পায়নের ওপর নির্ভরশীল না থেকে আমাদের কৃষির আধুনিকায়নের জন্যে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে যেতে হবে। এরই মধ্যে আমরা এ খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের উপযুক্ত নীতি সমর্থন দিয়ে গত এক দশকে ব্যাপক উন্নয়নের ধারা চালু করেছি। ধান, পাট ছাড়াও পানি সম্পদ, শাক-সবজি ও ফলের উৎপাদনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছি। কৃষি ও প্রাণি সম্পদের এই উন্নতিতে ক্ষুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অসামান্য অবদান স্বীকার করতে হবে। এ ধারা যাতে অব্যাহত থাকে সেজন্যে সরকারি বিনিয়োগ বছর বছর আরো বাড়িয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্যে যন্ত্রায়ণসহ সকল উপকরণের দামে ভর্তুকির যে ধারা চালু করা হয়েছে তাকে টেকসই করতে হবে। কৃষকদের বিনিয়োগে প্রয়োজনীয় স্বল্পমূল্যের অর্থায়নের নীতিও চালু রাখতে হবে।

আট. বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সংযোগ বাড়াতে হবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রপ্তানি করার ঝোঁক কমাতে হবে। ভারত, জাপান, চীনসহ এশিয়ায় রপ্তানি বাড়াতে উদ্যোগী হতে হবে। চীন থেকে অনেক শিল্প বাংলাদেশে চলে আসছে। ভারত থেকেও বিদ্যুত ও রেলের যন্ত্রপাতি আসছে। তাই আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি করার এই ধারা আরো বেগবান করার সুযোগ রয়েছে। সেজন্যে বাণিজ্য সহায়তামূলক অবকাঠামো ও নীতিকাঠামো সংস্কারে আমাদের মনোযোগী থাকতে হবে। বাংলাদেশও সিংগাপুরের মতো এক নয়া বাণিজ্যিক আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সম্ভাবনা রাখে।

নয়. শুধু বিদেশে রপ্তানি নয় স্বদেশের বাড়ন্ত বাজারের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে আরো চার কোটি মানুষ দারিদ্র্য রেখা টপকে উপরে উঠে আসবে। প্রতি বছর পাঁচ হাজার ডলারের বেশি মাথাপিছু আয় করেন এমন ২০ লক্ষ মনুষ নয়া ধাঁচের ভোক্তা বাজারে আসছে। তাদের চাহিদা মাথায় রেখে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে হবে। আগামী এক দশকেই ৩৩টি শহরের প্রতিষ্ঠিত এমন মধ্য ও উচ্চ আয়ের ভোক্তার সংখ্যা তিন লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। তারা আমাদের স্বদেশি ব্রান্ডের পণ্য কিনবে। তাই তাদের কথা মাথায় রেখে উন্নয়ন নীতিকৌশল সংস্কার করতে হবে।

দশ. সার্ভিস খাতেও মনোযোগ বাড়াতে হবে। বিশ্বের সাথে সংযোগ বাড়িয়ে আমরা ব্যাংক, বীমা, অডিট, ডিজাইনসহ নানা ধরনের কম্পায়েন্স নির্ভর সার্ভিস শিল্প ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে গড়ে তুলতে পারি। এর ফলে শিক্ষিত তরুণদের প্রচুর কাজের সুযোগ বাড়বে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজারকে আমরা ‘এভিয়েশন হাব’ হিসেবেও গড়ে তুলতে পারি।

এগারো. শিল্পায়ন দ্রুত হলে নগরায়নও দ্রুত হবে। উপযুক্ত নীতি না থাকলে নগরায়ণ বিশৃংখল রূপ নিতে পারে। তাই শিল্পকে পরিবেশ-বান্ধব এবং নগরায়ণকে সুশৃংখল করার দুরদর্শী নীতি কৌশলের প্রতি এখন থেকেই মনোযোগী হতে হবে।

বারো. এতসব উন্নয়ন করতে হলে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ ছাড়া কোনো উপায় নেই। মাথাপিছু আয় যে হারে বাড়ছে আমাদের করদাতার সংখ্যা সে হারে কিন্তু বাড়ছে না। মাত্র ২১ লক্ষ করদাতা নিয়ে আমরা কেন সন্তুষ্ট থাকব? এ সংখ্যা কেন এক কোটিতে উন্নীত করা যাবে না? স্বদেশপ্রেমের অংশ হিসেবে আনন্দঘন পরিবেশে নির্ভয়ে কর দেবার সংস্কৃতি গড়ে তোলার নীতিকে অগ্রাধিকারসহ বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।

তেরো. তাছাড়া ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের জন্য শুধু ব্যাংকের ওপর নির্ভর না করে সবার জন্যে পেনশন ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি চালু করে একদিকে সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ বাড়ানো এবং অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদি অর্থায়নের টেকসই ভিত্তি তৈরি করা সম্ভব হবে। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন যোগাড়ের আরেকটি উৎস হতে পারে সিএসআর খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে সামাজিক দায়বোধের অংশ হিসেবে ভালো অংকের সিএসআর সমর্থন দিতে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করা সম্ভব হয়েছিল। এ ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি প্রত্যেক বড় উদ্যোক্তাকে তাদের ট্যাক্স-পূর্ব আয়ের দুই শতাংশ সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যয় (৫০:৫০) করার আইনগত বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। ভারত তা করেছে। এই ব্যয় তাদের নিজস্ব অলাভজনক ফাউন্ডেশন অথবা রেজিস্টার্ড অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করতে হবে। এ জন্যে উপযুক্ত মনিটরিং এর জন্য হিসেব নীরিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে সংশ্লিষ্ট রেগুলেটর কাজে লাগাতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ কাজে খানিকটা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। সেই আলোকে একটি জাতীয় আইন ও বাস্তবায়ন নীতি প্রচলন করা যেতে পারে। এটা করা গেলে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট অনেকটাই কমে আসবে। ভারত এ বিষয়ে আইন করেছে এবং ‘করপোরেট অ্যাফায়ার্স’ নামের আলাদা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের কাছ থেকেও শেখা যেতে পারে।

প্রস্তাবনা আর বাড়াতে চাই না। উপরের এসব নীতি কৌশল জনগণের কল্যাণে কাজে লাগাতে হলে সকল খাতেই স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। বিশেষ করে আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা খুবই জরুরি। যেভাবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম উদ্যোক্তা হতে চাইছে এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করছে তাতে মনে হয় বাংলাদেশ তার উন্নয়ন অভিযাত্রাকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাবেই। তাদের জন্য উপযুক্ত অর্থায়নের সুযোগ ও প্রণোদনা কাঠামো তৈরি করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিখাত, সরকারি খাত ও অলাভজনক সামাজিক খাত মিলে মিশেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জনে মনোযোগী থাকবে সেই প্রত্যাশাই করছি।

নাগরিক জীবনের কোলাহল, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বার্থের হানাহানি, ভণ্ডামি থেকে অনেক দূরে ছায়াঘেরা শান্তশীতল গ্রামীণ এক পরিবেশে তিনি এখন শায়িত। যাঁদের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, তাঁরাই তাঁকে সাধারণের বেশে পরম আদরে শুইয়ে রেখেছেন। আজ তাই আমাদের একান্ত প্রচেষ্টা হওয়া উচিত কী করে আমাদের নীতিতে ও কর্মে তাঁর আজীবনের স্বপ্ন-সাধারণের কল্যাণ-ভাবনাকে যুক্ত করা যায়। কী করে আমাদের উন্নয়ন-ভাবনায় মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে আরো গভীরভাবে যুক্ত করা যায় সেটিই এখন সময়ে দাবি। অনুসরণ করতে হবে তাঁরই দেওয়া উন্নয়ন নীতিমালার নানা বৈশিষ্ট্য। উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের সমকালীন উন্নয়ন নীতি কৌশলকে কী করে বঙ্গবন্ধুর ভাবনাপ্রসূত সাংবিধানিক অঙ্গীকার-নির্ভর জনকল্যাণধর্মী, কৃষক ও  শ্রমিকদের জন্য আরো মঙ্গলাশ্রয়ী করা যায়। সেলক্ষ্যে আমাদের ফিরে আসতেই হবে। মুষ্টিমেয় কল্যাণের ঘোর বিরোধী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সর্বসাধারণের মঙ্গল-ভাবনায় সবসময় নিমগ্ন থাকা ছিল তাঁর স্বভাবের অন্তর্গত। তাই আজ আমরা যদি সত্যি তাঁর আদর্শের রূপায়ণ চাই, তাহলে আমাদের স্বতন্ত্র স্বদেশচিন্তায় উদ্ভাসিত উন্নয়ন-কৌশলকে আরো গরিবহিতৈষী ও লক্ষ্যভেদী করতে হবে। একই সঙ্গে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আগামীর উন্নয়ননীতিকে আরো উদ্যোক্তা-বান্ধব করতে হবে।

২০২০ সালে আমরা যেন সমৃদ্ধ বাংলাদেশেই সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালির জন্মশতবর্ষ মাথা উঁচু করে উদযাপন করতে পারি সেই প্রত্যাশা করছি। তার পরের বছরই স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স হবে পঞ্চাশ। বঙ্গবন্ধুর গরিবহিতৈষী উন্নয়ন কৌশলকে বাস্তবে রূপায়ণে ব্রতী হয়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে চাই। ।

ড. আতিউর রহমান
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গর্ভনর, বাংলাদেশ ব্যাংক

এ সম্পর্কিত আরও খবর