করোনাবেদনায় ঈদানন্দ!

, যুক্তিতর্ক

মাহমুদ মেনন | 2023-08-28 08:15:55

এমন একটি ঈদ আসবে জীবনে তা হয়তো কারোই জানা ছিলো না। কিন্তু ঈদতো এমনও নয় যে, সকলের জন্য সববছরই পরমানন্দের হয়ে ধরা দেয়। আমাদের জীবনে আসে জরা, আসে দুঃখ, আসে বেদনা। সে আসাটা খুব যে বলে কয়ে আসে তাও তো নয়। ঈদ-চান্দ দেখেও আসে না।

‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ।

মুমূর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’

কাজী নজরুলের তুলে আনা সে প্রশ্নের উত্তর আজো জানা হয়নি। কেউ দিতেও পারেনি। দেওয়ার সাহসও করেনি।

সুতরাং ঈদ সবার হয় না। সব বছর হয়না। সবার একইভাবে হয়না।

এই যে একেকটা ঈদ আসে হরবছর, সে সব ঈদে আনন্দধারা আমরা যতটা মাপতে পেরেছি, কষতে পেরেছি ঈদানন্দের অংক তার চেয়ে অশ্রুধারা যে কম মেপেছি তা কিন্তু নয়।

ঈদে ঘরমুখো মানুষ মরেছে বেঘোরে, বেপরোয়া গাড়ির তলায়-ধাক্কায়। অধিক বোঝাই যাত্রীর লঞ্চ-ট্রলার ডুবিতে হয়েছে অনেক সলিল সমাধি লাভ। ঈদের বোনাস না পেয়েছে কেঁদেছে পিতা- মন খারাপের দৃশ্যপটে কেটেছে পরিবারের দিন। পকেটমারের হাতে স্বর্বস্ব হারিয়ে, পথপাশে ব্যাকুল যুবকের হাতপাতা দেখেছি। অজ্ঞানপার্টির মলমে চোখ লাল করে ঘরে ফিরেছে অনেক ‘বেকুব’ বাবা এমনই সব ঈদের সকালে। তাদের কী ঈদ হয়েছে? হয়নি। ঈদ যেমন হয়নি। প্রতিকারও হয়নি। ফলে এমন সব ঈদানুসঙ্গ লেগেইতো ছিলো আমাদের জীবনে।

এবার না হয় সেসবের পরিবর্তে করোনা এসেছে। এ এক অদৃশ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু। কেউ আমরা জানিনা কে কোথায় কিভাবে বহন করছি। আগে আপনার ঈদানন্দ বানচালে যারা দায়ী ছিলো তাদের চিহ্নিত করা যেত- বেপরোয়া চালক, পকেটমার, বাটপার কিংবা সন্ত্রাসী। কিন্তু এখন আপনি নিজেই হতে পারেন নিজের ঈদানন্দ মাটি করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

এ এক করোনাবেদনাকাল। এ বেদনায় সামিল সবাই। করোনাই সবাইকে নামিয়ে এনেছে এক কাতারে। ধনী-গরিবের ফারাক নাই।

‘হিন্দু নাকি মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন।

কাণ্ডারি বলো মরিছে মানুষ- সন্তান মোর মা’র।’

কত মায়ের সন্তান যাচ্ছে কবরে-চিতায়। তাদের জন্য কিচ্ছুটি করার নেই। প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। হাসপাতালগুলোর আইসিইউতে আর একটি বেডও ফাঁকা নেই। সামান্য অক্সিজেন সাপোর্টটুকু দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে অনেক হাসপাতালকে। তার ওপর যখন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা তখন ভবিষ্যৎ কোথায় তা সহজেই বুঝে নেয়া যায়।

এই যদি হয় অবস্থা- তখন সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে ওঠে সেই বাক্য যা রবি ঠাকুর বলে গেছেন- ‘আপনা মাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়’। ‘সেল্ফ হেল্প ইজ দ্য বেস্ট হেল্প’ এই ইংরেজি আপ্তবাক্য মেনে নিয়ে ভাবতে হবে- এই যুদ্ধে আসলে আমরা সকলেই সৈনিক। যারা আক্রান্ত হয়ে গেছেন, তাদের সারিয়ে তুলতে একদল সম্মুখ সারিতে যুদ্ধ করছেন বটে কিন্তু একজন যোদ্ধা হিসেবে আপনি তো নিজেই নিজেকে পারেন সামলে রাখতে। নিজের বর্ম নিজেই সৃষ্টি করতে পারেন। এই যুদ্ধাবস্থায় নিজে সামান্য বর্মচ্যুত হয়েছেন তো মরেছেন। এটাই হোক শিক্ষা- এটাই হোক চিন্তা।

ঈদ এসেছে তো কি হয়েছে? এই ঈদটা অতিমাত্রায় উপভোগ না করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করুন। এখন বেঁচে থাকাটাই সবচেয় বড় লড়াই। বেঁচে থাকতে পারাটাই সবচেয়ে বড় জয়, সবচেয়ে আনন্দেরও বটে।

ঈদানন্দ স্বজনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে যে নিজের বাড়ি ছুটছেন লকডাউনে সরকারের সামান্য শিথিলতার সুযোগ নিয়ে- সেটাই হয়ে উঠতে পারে আপনার জন্য হরিষে-বিষাদ ডেকে আনার কারণ। কারণ আপনি মোটেই শতভাগ নিশ্চিত নন, এই চলার পথে আপনি ভাইরাসটিতে এক্সপোজড হয়ে যাচ্ছেন কি না। কিংবা এর আগেই ভাইরাসটি আপনার শরীরের কোনও একটি রন্ধ্রে ঘাপটি মেরে বসেছে কি না। যদি তেমন কিছু হয়ে থাকে, তাহলে যে বৃদ্ধ বাবা-মা কিংবা প্রিয় শিশুটির সঙ্গে ঈদ করবেন বলে ছুটলেন তার জন্যই বয়ে নিয়ে গেলেন সমূহ বিপদ। যা সর্বোতভাবে হবে এক অনুচিত কাজ। আনন্দের নামে ছুটে নিরানন্দ ডেকে আনবেন না।

করোনাকাল কাটবেই। আজ, নয় কাল, নয়তো পরশু। তখন না হয় দ্বিগুণ আনন্দ করে নেবেন। করোনাবেদনায় ঈদানন্দ মোটেই প্রত্যাশিত নয়। ঘরে থাকুন। নিরাপদে থাকুন। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

লেখক:মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর