করোনাক্রান্তির 'জুন' কতটা বিপজ্জনক?

, যুক্তিতর্ক

রাজীব নন্দী | 2023-08-30 15:35:54

পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে লকডাউন তুলে নেয়া হচ্ছে। আমরাও কি সেই শিথিল অবস্থার দিকে যাচ্ছি? দেশের চলমান করোনা পরিস্থিতিতে সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারি ছুটি আর বাড়ছে না। ফলে ৩১ মে থেকেই খুলছে অফিস। পার্শ্ববর্তী ভারতও বিমান পরিষেবা উন্মুক্ত করেছে। কিন্তু কিছু প্রেক্ষিত বিবেচনায় না রাখলে এই ক্রুশিয়াল সময়টা ভয়ঙ্কর হতে পারে। যেমন? বাংলাদেশে গত দুই মাসে লকডাউনের নামে আমরা যা করেছি তা ছিলো অপরিকল্পিত যথেচ্ছাচারিতা! মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরা হোম কোয়ারেন্টিন মানলেও হতদরিদ্র এবং নিম্নবিত্তের পক্ষে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ছিলো অসম্ভব। ফলে পৃথিবীর অনেক দেশের সাথে বাংলাদেশের করোনাক্রান্তির দশা মেলানো ভুল।

করোনাভাইরাসের কারণে প্রথম দফায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি দেওয়া হয়েছিল। এরপর ছুটি বাড়িয়ে তা ১১ এপ্রিল করা হয়। ছুটি তৃতীয় দফা বাড়িয়ে করা হয় ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। চতুর্থ দফায় ছুটি বাড়ানো হয় ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত। পঞ্চম ধাপে ২৬ এপ্রিল থেকে ০৫ মে পর্যন্ত ও ষষ্ঠ দফায় ৬ মে থেকে ১৬ মে পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়। আর সর্বশেষ ১৭ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়।

মহামারির অদৃশ্য অণুজীব বিশ্বায়ন ঘটিয়ে বাংলাদেশে আগমনের আগে পর্যন্ত যেসব দেশ বিধ্বস্ত হয়েছিলো সেসব দেশে আজকের শিথিলতার সাথে আমাদের আজকের পরিস্থিতির তুলনা দেয়া বোকামি। এটা অনেকটা 'খোঁড়া মানুষ'কে দৌঁড় প্রতিযোগিতায় নামানো।

ঢাকা এবং চট্টগ্রামে এখন করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ভয়াবহতম দিন কাটছে। ঠিক এই সময়ে 'শিথিল' হয়ে পড়া রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা বরং সংক্রমণ বাড়াবে। সুইডেন লকডাউন করেনি, ফলে আত্মঘাতী হয়েছে। ফিনল্যান্ড সব ওপেন করেছে। ওখানে সামার, লোকজনের গৃহবন্দীত্ব এমনিতেই এসময় শেষ হয়। জার্মানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করছে। স্পেন এবং রাশিয়া জুলাই থেকে ফ্লাইটের টিকিট বিক্রি শুরু করেছে।

সারা বিশ্ব এখন পোস্ট করোনা নিউ নর্মাল লাইফের দিকে মোড় নিচ্ছে। বিশ্বের জন্য এই মোড় নেয়ার সময়টা 'মে' মাস হলেও; এই মে মাসটিই আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি আতঙ্কজনক। কারণ এপ্রিলে যেভাবে আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঘরে-বাইরে টানাহেচড়া করেছিলাম এখন দিচ্ছি তার খেসারত। মে মাসের খেসারত দিবো জুন মাসে! কেন?

কারণ, এই লেখাটি লিখছি এমন এক চট্টগ্রামে বসে, যেখানে গতকাল ২৯শে মে তারিখে আরো ২২৯ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত একদিনে এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যাক করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ঘটনা। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের প্রায় একমাস পরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামে। কিছুটা দেরিতে সংক্রমণ শুরু হলেও চট্টগ্রামে অল্প সময়ে ঘটেছে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন। চট্টগ্রামে প্রথম সংক্রমণের ৪৮ দিনের মাথায় এসে শনাক্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছিল ১ হাজারের বেশি। তবে পরবর্তী মাত্র ৭ দিনে চট্টগ্রামে শনাক্তের সংখ্যা ছাড়ালো ২ হাজারের ঘর! চট্টগ্রাম কেন ব্যর্থ হলো, সেটার কারণ অনুসন্ধান করছি। আমাদের ভাগ্যে ভারতের কেরালা, লাদাখ, ভুবনেশ্বরের মতো পোস্ট করোনা লকডাউন পিরিয়ড উদযাপন করার মতো পরিস্থিতি নেই। ওরা পেরেছে রাজ্যভিত্তিক পৃথক পৃথক মডেল অনুসরণে। আমরা পারছি না রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার কারণে।

স্টার জলসা-র জনপ্রিয় একটি ধারাবাহিকের নাম ‘শ্রীময়ী’। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা টেলিভিশনে একটা অসামান্য জার্নি তৈরি করেছে এই সিরিয়াল। আগামী জুন মাস আমাদের জন্য ভারতীয় সিরিয়াল শ্রীময়ীর 'জুন আন্টি' হিসেবেই আসছে। যে জুন আন্টি মানে 'অনিচ্ছা সত্ত্বেও বদ মহিলার সাথে সংসার করতে গিয়ে পরিবার ভেঙে তছনছ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা'। আর হতবিহ্বল মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিচ্ছবি হলো 'অনিন্দ্য দা'।

টিভিতে কোন সিরিয়ালে নতুন চরিত্র এলে রেটিং বাড়ে না কমে সেটা নির্ভর করছে গল্প কোনদিকে টার্ন নিচ্ছে সেটা দেখে। শ্রীময়ী সিরিয়ালে ঊষশীর অভিনয়ে জুন আন্টির চরিত্র এতটাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে যে মধ্যবিত্ত রুচিবোধ তাড়িত শ্লাঘায় ভোগা মানুষদের কাছে এখন 'খারাপ মেয়ে' আর 'জুন আন্টি' সমার্থক শব্দ। 'জুন' আন্টি কতটা 'বিপদজনক' সেটা আমাকে বলে দিতে হবে না। জুন এতটাই বিপদজনক যে, পুরো মে মাসের হোম কোয়ারেন্টিনকে আমার 'করুণাময়ী রাণী রাসমণি’র ইয়ার্কি ফাজলামি মনে হচ্ছে। সিরিয়ালে শ্রীময়ী তার 'আত্মমর্যাদা'র প্রশ্নে একটা গন্তব্যে পৌঁছেছিলো। একটি অসুখী দাম্পত্য থেকে বেরিয়ে, একা মাথা উঁচু করে বাঁচার অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু হারতে হয়েছে জুনের কাছে। আমরাও কি তবে নিঃশব্দ আততায়ী 'জুন' আন্টির অপেক্ষায়? উত্তর:- WHO (world health organization) knows?

রাজীব নন্দী: সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

কনসাল্টিং এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর