বাকি মানে ফাঁকি ও একটি প্রস্তাবনা

, যুক্তিতর্ক

রিপন কুমার পাল | 2023-09-01 23:32:04

বাংলাদেশে ব্যবসা করতে গেলে সবচেয়ে বড় বাধা কি বললে সবাই এক বাক্যে বলবে আইন শৃঙ্খলার কথা। কিন্তু আমার মনে হয় সবচেয়ে বড় বাধা হলো “বাকি”- সময় মতো পেমেন্ট না পাওয়া অথবা একেবারেই না পাওয়া। অনেকে ক্রেতা সেজে বিক্রেতাকে ঠকাচ্ছে, আবার অনেকে বিক্রেতা সেজে ক্রেতাকে ঠকাচ্ছে। কিন্তু ঘটনা যেটাই ঘটুক না কেন, বেশিরভাগ সময়ই ঠগবাজরা অপরপক্ষের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঠগবাজরা বরাবরই অন্যদের তুলনায় চালাক আর কূটবুদ্ধিসম্পন্ন হয়। তাই সাধারণ মানুষরা যুগ যুগ ধরে প্রতারিত হয়ে আসছে। কেউ জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিচ্ছে। কিন্তু এখান থেকে মুক্তির যেন কোনো পথ নেই! আর কতদিন এই সাধারণ মানুষেরা ঠগবাজদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে? কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার করেই একটা সমাধানের কথা প্রস্তাবনা করবো।

ঠগবাজ ক্রেতা

এই ধরনের লোকেরা দুইভাবে প্রতারণা করে - ১) নিজে ২) কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে। এই ধরনের লোকরা সাধারণত লোভী হয় এবং সবসময় শান্তি ও তৃপ্তির অভাবে ভোগে। এরা শিকার হিসেবে সাধারণত নতুন ব্যবসায়ী অথবা দোকানদেরকে লক্ষ্য করে, যেখান থেকে ঘটনা পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কম হবে। বিক্রেতার সামর্থ্যের বিষয়টা মাথায় রেখে অল্প মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে।

অল্পমেয়াদি পরিকল্পনা

এরা পরিচিত অথবা স্বল্প পরিচিত বিক্রেতার কাছে থেকে পণ্য ক্রয় করে আংশিক অথবা পূর্ণ বাকিতে শুধু আশ্বাস দিয়ে - এখন টাকা নাই জিনিষটা/গুলো দাও টাকা এখনই দিয়ে দিচ্ছি। বাসা থেকে আসি অথবা আমি অমুকের কাছে টাকা পাবো, ওর কাছ থেকে নিয়েই দিয়ে যাচ্ছি। একবার চোখের আড়াল হতে পারলে, আর এরা ঐমুখো হয় না সাধারণত। এরা টাকা দিলেও অল্প অল্প করে দিতে থাকে আর বাকির পাহাড় বড় করতে থাকে। এক সময় হঠাৎ করে এলাকা ছেড়ে দেয় আর নতুন এলাকায় গিয়ে একইভাবে প্রতারণার জাল বিস্তার করে। এখন বিক্রেতার যদি এই ক্ষতি (এক বা একাধিক) সামাল দেয়ার সক্ষমতা থাকে, তাহলে টিকে থাকে তা না হলে সর্বস্ব খুইয়ে বসে |

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

এরা সাধারণত প্রভাবশালী হয় অথবা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় কাজ করে। এরা বেশিরভাগ সময় ব্যবসার অন্তরালে থেকে কলকাঠি নাড়ে। এদের খপ্পরে পড়েনি এমন নতুন ব্যবসায়ী মনে হয় বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এরা রক্তচোষার মতো - যতসময় বিক্রেতার সামর্থ্য আছে বলে মনে করে, ততসময় এরা খুব সুচারুভাবে এদেরকে ব্যবহার করতে থাকে বিভিন্ন লোভ দিয়ে, ভালো ব্যবহার করে, নিজেদের গুণগান (টাকা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদি) করে।

এরা প্রথমদিকে ভালো দাম (বাজার দামের চেয়ে বেশিও দিতে পারে), আংশিক পেমেন্ট করলেও, সহসাই আসল রূপ বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন অজুহাতে পেমেন্ট করতে দেরি করে এবং একসময় আর পেমেন্ট দেয় না। তখন বিক্রেতার আর কিছুই করার থাকে না অফিসে ঘোরাঘুরি করা ছাড়া। কিন্তু আসলে কি এইটা হওয়ার কথা ছিল, না হওয়া উচিত? যারা নতুন ব্যবসায়ী তারা অনেকে ঋণের জালে জড়িয়ে পরে আর পরিবার, আত্মীয় স্বজনকে পর্যন্ত নিঃস্ব করে ফেলে। অন্যদিকে সেই ঠগবাজ ক্রেতা অন্য কাউকে নিঃস্ব করার ছক প্রস্তুত করে আর সেই টাকাতে নিজেরা আরও ধনী হয় অমানবিকভাবে।

তবে এর মধ্যেও কিছু ক্রেতা আছে যারা নিজেরা ঠগবাজ না, কিন্তু পরিস্থিতির শিকার হয়ে অন্যকে নিঃস্ব করে ফেলে। আসলে ব্যবসা তো একটা বৃত্তের মতো চলে। এখানে একদল মানুষ উৎপাদন করে, আর একদল বাজারজাত করে হাট অথবা পাইকারি বাজারে, সেখান থেকে খুচরা বাজার, তারপর ভোক্তার কাছে যাই অথবা কাঁচামাল হিসেবে আবার উৎপাদকের কাছে যাই। এই বৃত্তের কোথাও এক জায়গায় ছন্দপতন হলেই পুরা বৃত্তের ওপরে প্রভাব ফেলে। এইভাবে বৃত্তের মাঝখানে কেউ যদি নিজে পেমেন্ট না পায়, সে তখন তার সরবরাহকারীকে পেমেন্ট করতে পারে না, অথবা ঋণের জালে জড়িয়ে পরে ব্যবসা থেকে ছিটকে পরে।

এতো বললাম ক্রেতার কথা। বিক্রেতাও টাকা নিয়ে পরে পণ্য ডেলিভারি দিতে গড়িমসি করতে পারে অথবা অস্বীকার করতে পারে। এই ঘটনা বেশি ঘটে যখন পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে। তখন বিক্রেতারা অগ্রিম পেমেন্ট নিয়ে নেই কিন্তু পণ্য ঠিকমতো বুঝিয়ে দেয় না সময় মতো। এতে যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিদারুণভাবে। কারণ তারা ব্যবসার সময়টা মিস করে আবার যখন পণ্য পায় তখন চাহিদা থাকে না। তাদের কাছে একজনকে পেমেন্ট করার পরে সমতুল্য কোনো পণ্য কেনার মতো টাকাও থাকে না। এইভাবে আম-ছালা দুটোই হারায়।

তবে শুধু শুধু সমস্যা বলেই তো আর শেষ করা ঠিক না। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমার একটা প্রস্তাবনা আছে। এটা মোটেও নতুন কিছু না। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই আবশ্যক করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।

সকল ব্যবসায়িক লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে হতে হবে। সেক্ষেত্রে কোনো পণ্য / সেবা ক্রয় করার আগে ক্রেতাকে সমপরিমাণ (সেবার ক্ষেত্রে অন্তত এক বিলিং সাইকেল) টাকা একাউন্টে জমা রাখতে হবে যেটা লক হয়ে থাকবে এবং ক্রেতা চাইলেও অন্য কোনো উদ্দেশ্যে খরচ করতে পারবে না। তবে ব্যাংকের ইন্টারেস্ট অথবা লভ্যাংশ সে পেতে থাকবে কারণ টাকাটা ক্রেতার হিসাবেই থাকবে। আর সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ফান্ড প্রাপ্তির একটা কনফার্মেশন দেবে বিক্রেতাকে। এরপরে বিক্রেতা পণ্য বা সেবা ডেলিভারি করার পরে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ইনফর্ম করবে ক্রেতার প্রাপ্তি স্বীকার দলিলসহ ও তার পছন্দের ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিয়ে। এরপর ক্রেতার সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ক্রেতার কাছে ভেরিফিকেশন নিয়ে সেই টাকাটা বিক্রেতার ব্যাংক হিসাবে ট্রান্সফার করবে। অগ্রিম পেমেন্টের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে বিক্রেতার হিসাবে টাকাটা থাকবে কিন্তু বিক্রেতা সেই টাকা ব্যবহার করতে পারবে না পণ্য বা সেবা সন্তোষজনকভাবে ডেলিভারি করার আগে পর্যন্ত।

যদি বিক্রেতার পণ্য বা সেবা ডেলিভারির ক্ষেত্রে অথবা ক্রেতা পণ্য বা সেবা ডেলিভারি বুঝে নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ঝামেলা হয়, সেক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতার উভয় ব্যাংকের আরবিট্রেশন দল, দুই পক্ষের মধ্যে আরবিট্রেশনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পক্ষ টাকা মুক্ত করতে পারবে। যে পক্ষ দোষী প্রমাণিত হবে, সেই পক্ষ ব্যাংক এর আরবিট্রেশন খরচ বহন করবে। এতে করে কোনো পক্ষই শুধু শুধু ঝামেলায় জড়াতে চাইবে না আশা করা যায়।

যেকোনো ধরনের অনলাইন পেমেন্ট (মোবাইল মানি, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি) এর ক্ষেত্রেও "On Hold" বলে একটা অপশন থাকবে যেখানে বিক্রেতার ডিটেলস ও অর্ডারকৃত পণ্য বা সেবার বিস্তারিত বিবরণ থাকবে ভবিষ্যৎ রেফারেন্সের জন্য। বিক্রেতা যত সময় সংশ্লিষ্ট পণ্য বা সেবা ক্রেতার কাছে না পৌঁছাবে ততসময় টাকাটা ব্যবহার করতে পারবে না।

লাভ-ক্ষতি

ক্রেতা-বিক্রেতা: এই পদ্ধতিতে সৎ ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। একইভাবে সাধারণ ক্রেতাদের স্বার্থও সুরক্ষিত হবে বলে বিশ্বাস করি। কারণ ক্রেতা টাকা ফেরত (আংশিক বা পূর্ণ) পেতে পারে যদি বিক্রেতা ক্রেতার চাহিদা মতো পণ্য বা সেবা সরবরাহ করতে না পারে (ব্যাংকের আরবিটেশন লাগবে)।

সমাজ: সমাজে শান্তি আসবে কেননা আজকে যারা বেকার আছে তারা সবাই কম বেশি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উপায় খুঁজে পাবে। যার যতটুকু সামর্থ্য আছে সে ততটুকু দিয়েই ব্যবসা চালনা করতে পারবে। বিশেষ করে আর্থিক প্রতারণার কারণে সমাজে যে বিশৃঙ্খলা দেখা যায় সেটা অনেকাংশে কমে আসবে বলে বিশ্বাস করি।

ব্যাংক: পেমেন্ট স্থিতিকালীন সময়টাই ব্যাংক ফান্ডটা অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারবে। ব্যাংক একটা সার্ভিস চার্জ ধরতে পারে যেটা ব্যাংকের সরাসরি ইনকাম হিসেবে পরিগণিত হবে। সেক্ষেত্রে চার্জটা যত কম হয় ততই মঙ্গল। তা না হলে কেউ এই ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে উৎসাহ পাবে না।

আরবিট্রেশনের চার্জের টাকাটা তো আছেই। নিজস্ব গ্রাহকের (ক্রেতা) সুবিধার্থে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক "Locked" টাকা থেকে কিছু টাকা জামানত হিসেবে রেখে অবশিষ্ট টাকা "লোন" হিসেবে ক্রেতাকে ব্যবহারের সুযোগ দিতে পারে। সেক্ষেত্রে, বিক্রেতাকে পেমেন্ট করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকই দায়ী থাকবে। এতে ক্রেতার সুযোগ থাকবে টাকা পরিচালনা করার আবার ব্যাংকও অল্পমেয়াদী লোন দিয়ে উপার্জন বাড়াতে পারবে।

সরকার বা রাষ্ট্র: উপরের সব সুবিধাভোগীই রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ। সবাই ভালো থাকলে সরকার ভালো থাকবে। উপরন্তু, সরকারের ফিস- ভ্যাট, ট্যাক্স ইত্যাদি নিশ্চিত হবে।

পরিশেষে বলতে হয়, আমাদের দেশের মানুষদের অনেকেই সচেতন নয়। অনেকেই ভ্যাট, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য এই পদ্ধতিতে উৎসাহী হবে না। আর অসৎ, ঠগবাজরা তো এটার বিপক্ষে কথা বলবে। তাই সরকার এবং রাষ্ট্রের কাছে সবিনয় অনুরোধ আপনারা ঠিকমতো যাচাই বাছাই করে এই প্রস্তাবনাটা সবার জন্য অবশ্য পালনীয় করে আইন জারি করুন যাতে আর কেউ ঠগবাজদের দ্বারা নিজের অজান্তেই নিঃস্ব না হয়ে দেশ, সমাজ ও পরিবারের বোঝা না হয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটা করার কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য এখন অনেকটাই নিরাপদ। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে এই পদ্ধতি চালু করলে এটাও নিরাপদ হবে।

রিপন কুমার পাল: প্রকৌশলী ও কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর