অপরাধ করলে ক্ষমা নাই, নিরপরাধের মুক্তি চাই

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-27 14:31:19

গত সপ্তাহে এই কলামে লিখেছিলাম '২২ ছাত্রকে মুক্তি দিন'। সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, কিন্তু তাদের মুক্তি মেলেনি। বরং বারবার তাদের জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই সময়ে এই তালিকায় যোগ হয়েছে আরো নতুন নাম, নতুন মুখ। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব আন্দোলনের পর থেকে  এখন পর্যন্ত ৫২ মামলায় ৯৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশের গ্রেপ্তার নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। কেউ অপরাধ করলে, আইন ভাঙলে অবশ্যই পুলিশ তাকে বা তাদেরকে গ্রেপ্তার করবে। আইন সবার জন্য সমান, আইন অন্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি আপ্তবাক্য শুনে আসছি যুগ যুগ ধরে। কিন্তু বাংলাদেশে আইন সবার জন্য সমান নয়, আইন অন্ধও নয়। বরং আইন একচোখা। পুলিশ বেছে বেছে একপক্ষের লোকজনকে ধরছে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সরকার চরম ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছে। বারবার অপমানিত হয়েও পুলিশ চুপচাপ বসেছিল। সরকারের এই নীতি দারুণ প্রশংসাও পেয়েছিল। কারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে নয়, সরকার পতনের নয়। তারা নিরাপদ সড়ক চায়। এই চাওয়া দলমত নির্বিশেষে সবার।

শিক্ষার্থীরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। কিন্তু সরকারের এই অহিংস নীতির বাইরে গিয়ে আন্দোলনের পঞ্চম দিনে মিরপুরে যারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করলো তাদের কাউকে কিন্তু পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। ৪ ও ৫ আগস্ট ধানমন্ডি-ঝিগাতলা এলাকায় যারা হেলমেট পড়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করলো, সাংবাদিকদের বেধড়ক পেটালো, ৬ আগস্ট আফতাবনগরে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ওপর যারা হামলা করলো তাদের কাউকেই কিন্তু পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। পুলিশের এই একচোখা আচরণে এটা বিশ্বাস করার কারণ ঘটে যে এসব ঘটনায় যারা হামলাকারী তারা সরকারি দলের সমর্থক। কিন্তু সরকারি দলের সমর্থক হোক আর না হোক, এদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি। কারণ সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে হামলা চালিয়ে সরকারকেই আন্দোলনের প্রতিপক্ষ করে তুলছে। পুলিশও আন্দোলনের পক্ষের লোকজনকে একতরফা গ্রেপ্তার করে সরকারকে আন্দোলনের প্রতিপক্ষ করে তুলছে। অথচ সরকার মোটেই এ আন্দোলনের প্রতিপক্ষ নয়, বরং এ আন্দোলনে সরকারের অনেক সুবিধা হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা মাঠে ছিল বলেই সরকার নিশ্চিন্তে সড়ক পরিবহন আইন পাশ করতে পেরেছে। ট্রাফিক সপ্তাহে যে পুলিশের বিশাল সাফল্য, সেও তো এ আন্দোলনের দেখানো পথ ধরেই।

তবে এটা ঠিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রথম ৫ দিন যেমন সরল ছিল, শেষ তিনদিন তেমন ছিল না। আন্দোলনের আগুনে আলু পুড়ে খেতে মাঠে নেমে যায় একটি পক্ষ। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চেয়েছিল কেউ কেউ। এই ষড়যন্ত্রের নানা খবর ফাঁস হয়েছে। ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে খুন- ধর্ষণের গুজব যারা ছড়িয়েছে, তারা অবশ্যই অন্যায় করেছে।

৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিনতাই করে যারা শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের দিকে গিয়ে সংঘর্ষকে ইনভাইট করেছেন, তারাও ঠিক করেননি। সরকার সব দাবি মেনে নেয়ার পরও যারা চেয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা রাজপথে থাকুক, তাদের উদ্দেশ্যও ভালো ছিল না। যারা গুজব ছড়িয়েছে বা সত্যি সত্যি উসকানি দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিপাকে ফেলতে চেয়েছে; তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হোক। কিন্তু সাধারণ নিরপরাধ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়। কিন্তু হচ্ছে তাই।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর এখন পর্যন্ত ৫২ মামলায় মোট ৯৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৫১ জনই শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে আবার ৪ জন আছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। যদিও বরাবরই সরকারের নির্দেশনা ছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার না করার। সরকারের নির্দেশ অমান্য করে যারা সরকারকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা করছে, তারা অবশ্যই সরকারের বন্ধু নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনার পরও যারা সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করেনি, তারা অবশ্যই সরকারের ভালো চায় না।

আগেই বলেছি যারা গুজব ছড়িয়েছে, সত্যি সত্যি উসকানি দিয়েছে; তাদের গ্রেপ্তার করা হোক। কিন্তু আমরা আন্দোলন আর উসকানিকে গুলিয়ে ফেলছি। সরকারবিরোধিতা আর রাষ্ট্রবিরোধিতা যে এক নয়, তা ভুলে যাচ্ছি। সরকারবিরোধিতা বা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা কিন্তু অপরাধ নয়।

শহীদুল আলমের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাই তার গ্রেপ্তারে আমরা আপত্তি করিনি। না বুঝে হলেও অভিনেত্রী নওশাবা বিপদজনক গুজব ছড়িয়েছিলেন। তার গ্রেপ্তারও অযৌক্তিক নয়। তবে তার সাড়ে ৪ বছরের শিশু, তার অতীত সামাজিক কর্মকাণ্ড, তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নওশাবাকে জামিন দেয়ার বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। বিচার চলুক। কিন্তু গ্রেপ্তার করা ৯৯ জনের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই শহীদুল আলম বা নওশাবার মত সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। অধিকাংশের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া যায়নি। বরং গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের অনেকের পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

৪ আগস্ট মুখে গোলাপি কাপড় পেচিয়ে এত নারী হত্যা-ধর্ষণের গুজব ফেসবুকে প্রচার করেন। ইডেন কলেজের এক শিক্ষার্থী গোলাপি পোশাক বেশি পড়েন। এইটুকু মিলের কারণে তাকে সিরাজগঞ্জের এক চরে গ্রামের বাড়িতে ঘুম থেকে তুলে আনা হয়েছে। আরেক নারী উদ্যোক্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ফেসবুকে দেখা গেছে তিনি আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের খাইয়েছিলেন। আন্দোলনকে সমর্থন করা, তাদের পাশে দাড়ানো, তাদের খাওয়ানো যদি অপরাধ হয়; তাহলে কিন্তু কোটি কোটি মানুষকে গ্রেপ্তার করতে হবে। শাজাহান খান ছাড়া মন্ত্রিসভার সব সদস্য, সরকারি দলের নেতাকর্মী, পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা- সবাই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন এবং আছেন। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। তাই আন্দোলনকারীদের খাওয়ানোর অপরাধে কাউকে গ্রেপ্তার করা অন্যায় এবং স্ববিরোধী।

যে ৯৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের অনেককেই ছাত্রলীগ বা যুবলীগ ধরে পুলিশে দিয়েছে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সুনির্দিষ্ট নয়। ৪ ও ৫ তারিখে ধানমন্ডি-ঝিগাতলা এলাকা থেকে ঢালাওভাবে তরুণ-যুবকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইনের চেতনা হলো, ৫ জন নিরপরাধ ছাড়া পেয়ে যাক, কিন্তু একজন নিরপরাধও যেন সাজা না পায়। কিন্তু এখন চলছে উল্টো। ঢালাও গ্রেপ্তার করো। কিছু না কিছু অপরাধী তো পাওয়া যাবেই। অপরাধ না পেলেও অজ্ঞাতনামা আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বাণিজ্য করা যাবে।

আবারও দাবি জানাচ্ছি, গ্রেপ্তার ৯৯ জনের মধ্যে যারা শিক্ষার্থী, যাদের সামনে পরীক্ষা, যাদের স্রেফ সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের আন্দোলন করার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; তাদের ঈদের আগেই মুক্তি দেয়া হোক। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পক্ষে থাকার অপরাধে যদি কারো ঘরে ঈদের আনন্দ ম্লান হয়ে যায়, তা হবে বড় বেদনার।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমরা জানি, আপনি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সমর্থক। শিক্ষার্থীরা মাঠে নামার অনেক আগে থেকেই আপনি সড়ক নিরাপদ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। তাই সরকার নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রতিপক্ষ; সরকার বা পুলিশের কোনো তৎপরতায়; এমন ভুল ধারণা যেন ছড়াতে না পারে, এখনই তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রেপ্তার ৯৯ জনের মধ্যে যারা নিরপরাধ তাদের মুক্তি দেয়ার মাধ্যমেই ছড়িয়ে দেয়া হোক সঠিক বার্তা। অপরাধ করলে ক্ষমা নাই, নিরপরাধের মুক্তি চাই।

লেখকহেড অব নিউজএটিএন নিউজ 

এ সম্পর্কিত আরও খবর