রায়ট, পেন্ডেমিক: আমেরিকান মডেল

, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-08-31 14:39:09

‘হোয়েইন দ্য লুটিং স্টার্টস, দ্য শুটিং স্টার্টস’- লুট শুরু হলে গুলিও চলবে, ২৯ মে ২০২০ তারিখে দেয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার কথা রেখেছেন। আমেরিকার সর্বব্যাপী পাবলিক প্রোটেস্ট থামেনি, মার্কিন প্রেসিডেন্টও থামেন নাই।

জনতার আক্রোশ থেকে বাঁচতে তাকে হোয়াইট হাউজের বাঙ্কারে লুকাতে হলেও শেষাবধি তিনি রায়ট রুখতে সেনাবাহিনী নামিয়েছেন। পুলিশি পাহারায় বাইবেল হাতে প্রেসিডেন্ট গির্জার সামনে মহড়াও দিয়েছেন। শক্তির বদলা হিসেবে তিনি শুধু শক্তিই প্রয়োগ করেননি, ইতোমধ্যে ধর্ম ও বিভাজনের নীতি ব্যবহার করে, আমেরিকার এই জনবিক্ষোভ থেকে সুবিধা নেবার মতলব আঁটছেন।

উল্লেখ্য, আমেরিকার মিনোসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনোপলিস শহরের পুলিশ অফিসার সাদা আমেরিকান ডেরেক শোভেন তার তিনজন সহযোগীকে নিয়ে এক কালো আফ্রিকান-আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডকে হাঁটুতে চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। ফ্লয়েডের বিরুদ্ধে অভিযোগ এক দোকানে বিল মেটানোর সময় তিনি ২০ ডলারের একটি জাল নোট দিয়েছিলেন।

এই অভিযোগ ফ্লয়েড অস্বীকার করলেও সাদা আমেরিকান পুলিশ তা শুনতে রাজী হয় নাই। বরং সাদা আমেরিকান পুলিশের হাঁটুতে আটকে থাকা কালো আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েড, ‘ প্লিজ আই ক্যান নট ব্রিথ, ডোন্ট কিল মি’ -এসব অনুরোধ করা সত্ত্বেও তার কথা কেও শুনে নাই। প্রকাশ্য রাজপথে ঘটে এই বর্বরোচিত ঘটনা। ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের এই পুলিশি বর্বরতায় মস্তিস্কে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে মারা যান জর্জ ফ্লয়েড।

এই হত্যার পরও আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তারা কোন ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করেন। পরে এই ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হলে বিক্ষুব্ধ জনতা রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ক্রমশ এ বিক্ষোভ গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং তা সহিংস আকার ধারণ করে। সহিংস বিক্ষোভের মাঝে একসময় অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, লুটপাটের ঘটনাও ঘটতে থাকে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এইসব ঘটনায় কট্টর বামপন্থিদের দায়ী করে উত্তেজিত মন্তব্য করতে থাকেন। ফলে বিক্ষোভের মাত্রা কমার বদলে তা বাড়তেই থাকে। বলা হচ্ছে ১৯৬০ সালের পর এরকম বৃহত্তম জনবিক্ষোভ আমেরিকা দেখে নাই।

এখন, প্রশ্ন হচ্ছে, করোনা কালের এই বিভীষিকার মধ্যে, আমেরিকার জনগণ এত রুষ্ট হোল কেন? আর আমেরিকার কট্টর জাতীয়তাবাদী প্রেসিডেন্ট এই বিক্ষোভ থামানোর বদলে তা উসকে দিতে এতো মরিয়াই বা কেন?

২.
এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমাদের দেখা দরকার মার্টিন লুথার কিংয়ের জনআন্দোলনের পরও আমেরিকায় কালো সাদা বিভেদ কি মিটেছে? জর্জ ফ্লয়েড কে নিয়ে যা হোল তা কী বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি, আমেরিকার অন্তর জুড়ে চাপা আছে এই কালো-সাদা বিদ্বেষের ছাই।

বলা ভালো ,এতো বছর পরও আমেরিকাতে সেখানকার অধিবাসীদের বলা হয় ‘আফ্রিকান আমেরিকান’, ‘এশিয়ান আমেরিকান’, ‘মেক্সিকান আমেরিকান’ ইত্যাদি। অর্থাৎ আফ্রিকা , আমেরিকা, মেক্সিকো.. ইত্যাদি বিভিন্ন মহাদেশ বা দেশ থেকে আসা আমেরিকার অভিবাসীরা যারা পুরুষানুক্রমে সেদেশের নাগরিক তারা এখনো সাদাদের চোখে খাঁটি ‘আমেরিকান’ হয়ে উঠতে পারে নাই।এই ‘আফ্রিকান’ বা ‘এশিয়ান’ আমেরিকান বলার মধ্য দিয়ে সাদা আমেরিকানদের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যে তাদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে খুব গভীরে প্রোথিত তা বলাই যায়। আমেরিকার কথিত উদার গণতন্ত্র এবং প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্রনীতিও রাষ্ট্রিক মনোজগতের এই গভীর অন্ধকার দূর করতে পারে নাই।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার মধ্য দিয়ে এটা সুস্পষ্ট হয়েছে মুখে মুখে যতই মানবিকতা আর সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হোক না কেন, শ্বেতাঙ্গ কট্টরপন্থী আর অভিবাসীদের ঘৃণা করা উগ্র ‘হোয়াইট সুপ্রিমিষ্ট’ জনগোষ্ঠীর একটা বাড় বাড়ন্ত ঘটেছে গোটা আমেরিকা জুড়েই। এবং সেটার সাংগঠনিক শক্তিও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকান ফার্স্ট’ নীতির মধ্যে এক ধরণের উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা লুকিয়ে আছে, যার মূলকথা হচ্ছে আমরাই সেরা, অন্যরা নয়।এই ভাবনা আমেরিকার ‘হোয়াইট সুপ্রিমিষ্ট’ ভাবনারই একটা বর্ধিত রূপ।

অন্যত্র, আমেরিকার সর্বত্র ট্রাম্প যে অভিবাসন বিরোধী নীতি নিয়েছেন তার মূলকথাও এটা যে, আমেরিকাতে সাদা আমেরিকান ছাড়া আর কারও জায়গা হবে না। ট্রাম্পের এই রাষ্ট্রিক নীতি আমেরিকার বুকের ভেতরে থাকা ঘৃণা, বর্ণবাদ আর জাতিবিদ্বেষকে আরও শক্তিমান করেছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মধ্যে থাকা হোয়াইট সুপ্রিমিষ্ট সদস্যরাও তাতে আলোড়িত, অনুরণিত এবং শক্তিমন্ত হয়েছে। ফলে ডেরেক শভেনের মতো একজন সাদা চামড়ার পুলিশ সদস্য ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড ধরে জর্জ ফ্লয়েডের মতো আফ্রিকান আমেরিকানকে ঠান্ডা মাথায় শ্বাসরোধ করে প্রকাশ্য দিবালোকে বর্বরোচিত ভাবে খুন করতে দ্বিধা করে নাই।

আমেরিকার সমাজে সাদা চামড়ার আমেরিকানদের মনজুড়ে বর্ণবাদি ঘৃণা যে কতটা বেড়েছে তার প্রমাণ মিলেছে নানা সমীক্ষাতেও। একটা সমীক্ষা বলছে, শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে ৩ গুণ বেশি কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হয় পুলিশ হেফাজতে। আবার এইসব পুলিশি হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং খুনিদের শাস্তি দেবার ব্যাপারেও আমেরিকার বিচারব্যবস্থা শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের পক্ষ নিতেই স্বস্তিবোধ করে।ফলে, হত্যাকাণ্ডের শিকার কালো আফ্রিকান-আমেরিকান, অশ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা ‘হোয়াইট প্রিভিলেজ’ বা ‘শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদিতার’ সপক্ষে বিচারের একটা সংস্কৃতির মধ্যেই দিনাতিপাত করছে বহু বছর ধরেই।

মনে করা হয়, আমেরিকাতে রিপাবলিকান শিবিরেই হয়তো এই বর্ণবাদি ভাবনার বিস্তার হয়েছে বেশি। কিন্তু ডেমোক্রেট শিবিরেও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, নেতৃত্বে তারাই আসে , যারা অনেক বেশি ‘হোয়াইট প্রবণ’।

এবারও ডেমোক্রেট শিবিরে প্রেসিডেন্ট পদে ঝড় তুললেও তুলনামূলক সাম্যবাদী অর্থনীতির সমর্থক, তুলনামূলক সব মানুষের সমান অধিকারের সমর্থক, চিন্তাচেতনায় কিছুটা বামপন্থি বার্নি স্যান্ডার্স শেষাবধি হালে পানি পান নাই। জো বাইডেনকেই পদ ছেড়ে মাঝপথেই হাল ছাড়তে হয়েছে বার্নি স্যান্ডার্সকে। মুখে যতই সাম্যের কথা বলুক, মানবাধিকারের কথা বলুক, যতই ট্রাম্পের নীতির সমালোচনা করুক না কেন ডেমোক্রেট শিবিরের অন্তর এখনো মানুষের গায়ের রংয়ের ‘কালো’, ‘সাদা’ প্রশ্নে ততটা পরিষ্কার হয় নাই।

৩.
আমেরিকার অন্তর জুড়ে বর্ণবাদী ভাবনার শিকার আমেরিকানদের মনে যে কষ্ট এতদিন ঘুমিয়ে ছিল, হঠাৎ তা এই সময়ে এত বড় অগ্নুৎপাত ঘটালো কেন , সেটা একটা প্রশ্নও বটে। করোনাকালীন পেন্ডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারি হয়তো তার একটা বড় কারণ। কেননা, আমেরিকার বর্তমান জনভাবনা করোনার খুনে রংয়ে ভরা। করোনা মহামারি তাদের জীবনকে যেভাবে অসহায় মৃত্যুর দিকে ঠেলেছে, তাতে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদারি অন্তর দারুণভাবে নাড়া খেয়েছে।

করোনায় তারাই সবচাইতে, ভয়াবহভাবে মৃত্যুর মুখে পড়েছে। আমেরিকার ডানপন্থী, হোয়াইট সুপ্রিমিষ্ট ভাবনার প্রেসিডেন্ট মুখে যতই করোনা ভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে পরিহাস করুন না কেন , আমেরিকার ১লাখ ০৮ হাজার ৫৯ জন মানুষ মারা গেছে (০২ জুন ২০২০ তারিখের তথ্য) এই ভাইরাসে। যেদিন সারা আমেরিকাজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ চলছে সেদিনও(০২ জুন) ২১ হাজারেরও বেশি নতুন রোগী সংক্রমণের খবর এসেছে, মারা গেছে ১,১৩৪ জন। করোনা সংক্রমণেই শুধু নয় মৃত্যুহারে আমেরিকা পৃথিবীর সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের হিসাবে গোটা পৃথিবীর ২৯.০৬% করোনা রোগই হচ্ছে খোদ আমেরিকার।

এই করোনা মহামারি আমেরিকার অর্থনীতি, বেকারত্ব, স্বাস্থ্য পরিসেবা, বিনিয়োগ ভাবনা সর্বত্রই দারুণতর নেগেটিভ প্রভাব ফেলেছে। বেকারত্ব যেমন বেড়েছে, চাকরিচ্যুত ও কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও তেমন বেড়েছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তাও তেমনি ভয়ানক হয়ে উঠেছে। আবার স্বাস্থ্য পরিসেবার বেহাল অবস্থাও মানুষকে ভয়ার্ত করে তুলেছে।ফলে, মানুষ ক্রুদ্ধ-ক্ষুব্ধ থেকেছে। সেটাই এই জনবিক্ষোভকে পুষ্ট করে তুলতে সহায়তা দিয়েছে।

এই জনবিক্ষোভে সামিল হয়েছে উদার শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা। আবার অভিযোগ আছে, এই জনবিক্ষোভে লুটতরাজ-অগ্নিসংযোগ করে এর সহিংস চেহারা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে কট্টর ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গদের সংগঠনগুলো।

ডোনাল্ড ট্রাম্প, করোনা মোকাবিলায় যারপর নাই ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে, এই জনবিক্ষোভ তাকে করোনাকালিন ব্যর্থতা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর একটা সুযোগও দিয়েছে।

মানুষের মনে যে ক্ষোভ বা দুঃখ এই বিক্ষোভের কারণ তা দূর করার চাইতে, এর মধ্যে ‘আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব বিনষ্টকারী’ খুঁজে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আবিষ্কার করে, আগাম নির্বাচনে তার সুফল নেবার চেষ্টা করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মুনাফা অর্জনকারী একজন সফল ব্যবসায়ী হিসাবে ট্রাম্প, এই রায়টের মধ্যেও কট্টর জাতীয়তাবাদী চেতনার আগুন জ্বালিয়ে তার হারিয়ে ফেলা জনপ্রিয়তার আগুনে তা দিচ্ছেন। বলা ভালো ট্রাম্পের এই মডেল পৃথিবীর অনেক দেশের স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী শাসকের জন্যে প্রেরণার উৎসও হয়ে উঠতে পারে।

এখন দেখার বিষয়, করোনাকালিন এই বৈশ্বিক মহামারিযুগে ‘ট্রাম্প-মডেল’ খোদ আমেরিকাতেই শেষাবধি কতটা সফল হয়!

শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর