আওয়ামী লীগকে পারতেই হবে

, যুক্তিতর্ক

বিভুরঞ্জন সরকার | 2023-09-01 17:58:52

এ বছর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। কিন্তু দেশ করোনা আক্রান্ত হয়ে ধুঁকছে। অন্য সময় হলে ক্ষমতাসীন দলের জন্মদিন ঘটা করে, জৌলুশের সঙ্গেই পালন করা হতো। গত বছরও তাই হয়েছে। এবার করোনার কারণে কারো মন ভালো নেই। মানুষ আনন্দ উৎসবের মেজাজে নেই। সরকারের এবং সরকারি দলের সব মনোযোগও এখন করোনাকেন্দ্রিক। ফলে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হচ্ছে ‘করতে হয়, তাই করা' ধাঁচের।

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেওয়ার পর থেকে দলটি এ দেশের মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক লড়াইয়ে নিয়োজিত রয়েছে। এই দলের বিরুদ্ধে, দলের রাজনৈতিক অবস্থান ও কৌশলের বিরোধিতা করেছে প্রতিষ্ঠিত অন্য প্রায় সব দল। দেশের মানুষ অবশ্য আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছে, বিশেষ করে পাকিস্তান কালপর্বে।

আওয়ামী লীগকে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত অবদান সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাকে যতই জনগণের সামনে শত্রু বা ভিলেন বানানোর চেষ্টা করেছে, তাকে বারবার কারাগারে নিয়েছে, বিনা বিচারে আটক রেখেছে, দেশের মানুষ ততই তাকে আপনজন ভেবেছে, নায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছে।

যারা শেখ মুজিবকে গুরুত্বহীন করে তোলার চেষ্টা করেছে, মানুষের কাছে তারাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। শেখ মুজিবের হাত ধরেই আওয়ামী লীগের উত্থান হয়েছে, আবার আওয়ামী লীগও দলগতভাবে শেখ মুজিবকে সহযোগিতা দিয়েছে, বড় করে তুলেছে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়া, বঙ্গবন্ধু হওয়া, সত্তরের নির্বাচনে অভূতপূর্ব জয় এবং তারপর একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান – সবই সম্ভব করে তুলেছেন এদেশের মানুষ। বঙ্গবন্ধু যেমন মানুষের অনিঃশেষ ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি তিনিও দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন, একটু বেশিই ভালোবেসেছেন। মানুষকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে তিনি রাজনীতির হিসাব-নিকাশ করেননি। রাজনীতি ছিল যার জীবন তিনি মানুষকে বিশ্বাস-ভালোবাসার বেলায় থাকলেন বেহিসাবি। ইতিহাসের কী মারাত্মক স্ববিরোধ!

শেখ মুজিবকে জীবন দিতে হয়েছে তিনি যে দেশটি স্বাধীন করলেন সেই স্বাধীন দেশে একদল বিশ্বাসঘাতকের হাতে। তার কি কোনো বড় ভুল ছিল? তিনি কি বুঝতে পারেননি যে দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষছেন? তিনি বুঝতেন, জানতেনও। কারা তার শত্রু, কারা গোপনে অস্ত্র শান দিচ্ছে,, সেসব তিনি জানতেন। বিশ্বাস করতে চাইতেন না। ভাবতেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।

সব ঠিক হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে  সপরিবারে হত্যা করা হলো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলো। দেশের রাজনীতি চলে গেল একাত্তর-পূর্ব ধারায়।

মুজিববিহীন দেশে আওয়ামী লীগের দিশেহারা অবস্থায় আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন তারই কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। যে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছিল পঁচাত্তরের খুনি চক্র, মুজিব হত্যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি জিয়াউর রহমান, সেই আওয়ামী লীগ কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যারা দম্ভ করে বলতো, আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, তাদের দম্ভ চূর্ণ হয়েছে। তাদের ক্ষমতায় ফেরার আশা প্রায় দুরাশায় পরিণত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের উত্থান-পতনের সঙ্গে বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িত। এই দল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় নিশ্চিত করছে। আবার বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশের নতুন উন্নয়নযাত্রা। বাংলাদেশকে আজ আর বিশ্বসম্প্রদায় দুর্যোগ-দুর্বিপাক এবং ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দেশ মনে করে না। বাংলাদেশ আজ আত্মশক্তিতে বলীয়ান মর্যাদা সম্পন্ন একটি দেশ। উন্নয়ন সহায়ক দেশ ও প্রতিষ্ঠানের অন্যায় চাপ, পরামর্শ উপেক্ষা করার সাহসও বাংলাদেশ অর্জন করেছে। পদ্মাসেতু যে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, তা কার্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম বাংলাদেশেরই ছবি।

তারমানে কী বাংলাদেশের কোনো সমস্যা নেই? আওয়ামী লীগ যা করছে, সব ভালো? না, তা অবশ্যই নয়। আওয়ামী লীগে নানা সংকট আছে। সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে আদর্শের সংকট। আওয়ামী লীগ যে গণতন্ত্র ও উদারতার জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, অন্যদের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল করে তুলেছে, সেখানে এখন তৈরি হয়েছে ফাটল। আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতাই এখন প্রধান।

এ কথা ঠিক, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে দেশ ও দেশের মানুষের দুর্দশা-দুর্গতি বাড়ে। সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদী রাজনীতি ফণা তোলে, আবার এটাও অসত্য নয় যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য যে নীতিহীন আপসকামী ভূমিকা নিচ্ছে, সেটা আসলে দেশের আত্মশক্তি দুর্বল করার কাজও করছে। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতি-অনৈতিকতা শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের ভাবমূর্তিতে কালিপা লেপন করছে। মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস জনগণ। তাই যেকোনো মূল্যে জনগণের মধ্যে আস্থা ধরে রাখার কাজে আওয়ামী লীগকে সফল হতেই হবে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আর আমি পাইছি চোরের খনি'। সেই চোরাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এখন তো তাদের বারবাড়ন্ত অবস্থা। শেখ হাসিনাকে শক্ত হতেই হবে। সৎ ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে দল এবং সরকারকে ঢেলে সাজাতে হবে।

আওয়ামী লীগ বাহাত্তরে পা দিচ্ছে। এটা আশার কথা। আবার আশঙ্কারও কথা। বাংলা ভাষায় ‘বাহাত্তুরে পাওয়া' বলে একটা কথা আছে। এর অর্থ ইতিবাচক নয়। আভিধানিক অর্থ হলো : বার্ধক্যহেতু দৈহিক শক্তি ও বূদ্ধি লোপ পেয়েছে এমন, অথবা ভীমরতিগ্রস্ত।

আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে এখনও বয়সের ভারে নত হয়নি। সময়ের দাবি বা প্রয়োজন পূরনে আওয়ামী লীগ কখনো ব্যর্থ হয়নি। দেশের যেকোনো সংকটকালে যখনই প্রশ্ন এসেছে, আওয়ামী লীগ সংকট মোকাবিলায় সক্ষমতা দেখাতে পারবে তো?

আওয়ামী লীগ কিন্তু পেরেছে। আওয়ামী লীগ পেরেছে বলেই অন্যরা হেরেছে। অন্যরা হেরেছে বলে দেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। দেশের হৃদপিণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগ। হৃদপিণ্ড উপড়ে নিলে যেমন মানুষ বাঁচে না, তেমনি আওয়ামী লীগও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হেলাফেলা করলে বাংলাদেশেরও কার্যত নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।

তাই আওয়ামী লীগকে পারতেই হবে। দলের মধ্যে যেসব প্রাণঘাতি ভাইরাস ঢুকেছে, তাদের পরাস্ত করতে হবে। করোনাভাইরাস অদৃশ্য শক্তি, আওয়ামী লীগের ভাইরাস দৃশ্যমান, সহজে শনাক্ত করা সম্ভব।

প্রতিষ্ঠার দিনে আওয়ামী লীগকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।

বিভুরঞ্জন সরকার: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর