গণতন্ত্রের মেজাজ

, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-08-26 19:59:51

 

এক.

ঈদ শেষে রাজধানী আবার দ্রুতই ভরে উঠবে জনভারে, জনচাপে। আবার শুরু হবে জীবনের ইঁদুর দৌড়। বসবাসের জন্য বিশ্বের দ্বিতীয় নিকৃষ্ট বলে র‌্যাংকিংখ্যাত ঢাকায় আবার বাড়বে যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে মানুষ রাজা-উজির মারবে। চলবে রাজনীতির কূটচাল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি পরস্পরকে দোষারোপ করবে নানান উছিলায়। কিন্তু আমাদের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র আদৌ ফুল হয়ে ফুটবে কি না তা নিয়ে চলবে দুশ্চিন্তা।

মেজাজহারা আমাদের গণতন্ত্র দেশের জন্য কি ভবিষ্যত রাখবে তা বরাবরের মতই সবাইকে দুর্ভোগ ও অনিশ্চয়তায় ফেলবে। কেননা সামনের সংসদ নির্বাচন কবে হবে, কীভাবে হবে, কাদের নিয়ে হবে সেসব প্রশ্নের কোনটারই সদুত্তর আমাদের জানা নেই।

বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর অনেক দেশেই গনতন্ত্র ঠিক মত মেজাজ রেখে স্বাভাবিক তালে চলছে না। অনেক জায়গায় জনতুষ্টির ভারে উন্নয়নের বুলি আওড়ে গণতান্ত্রিক আদল নেয়া শাসকরা কর্তৃত্ববাদী  চেহারায় আবির্ভূত হচ্ছে। কেউ কেউ স্বৈরাচারী হয়েও উঠছে,  ভোট ও ব্যালটের মাধ্যমেই। তবুও মানুষের আকাঙ্ক্ষা শতফুল ফুটুক রাজনীতিতে। গনতন্ত্র আসুক ডাল-পালা মেলেই। গণতন্ত্রের জন্য তাই শুভকামনা যেমন থাকবে তেমনি থাকবে আশঙ্কাও।

এখন সেসব টেনশন ঝেড়ে ঈদ ফেরত সুখি মানুষের মত আমরা রাজনীতির কিছু কৌতুক শুনতে পারি। কম্যুনিষ্ট সেভিয়েত আমলকে নিয়ে পশ্চিমাদের তৈরি করা সেসব কৌতুক হয়তো পুরনো কিন্তু তার সমকালীন আবেদন এখনো সচল:

১.

ট্রামের জন্য অপেক্ষমান দুজনের কথোপকথন চলছে।

প্রথমজন

-পাউডার এবং সরকারের মধ্যে কী তফাৎ, আপনি জানেন?

-না।

- পাউডার মুখে মাখে, আর সরকারকে কেউ কোথাও ঠেকাতেও চায় না।

ট্রাম এসে পড়লো। এবারে প্রশ্ন করলো দ্বিতীয় জন:

-  ট্রাম এবং আপনার মধ্যে পার্থক্য কী, আপনি জানেন?

-  না।

-  ট্রাম এখন চলে যাবে নিজের পথে, আর আপনি যাবেন আমার সাথে কেজিবি অফিসে।

 

- কিন্তু আমি তো সরকার বলতে আমেরিকান সরকারকে বোঝাতে চেয়েছি।

-   চাপাবাজি রাখুন।

 যে সরকারকে কোথাও ঠেকাতে ইচ্ছে হয় না, তা নির্ঘাত আমাদেরটা।

২.

বেশ জোরেসোরেই বললো রাভিনোবিচ:

- শালার অভিশপ্ত জীবন!

-সাদা পোশাকের গোয়েন্দা কেজিবি সদস্য এসে বললো তাঁকে:

-আমার সাথে যেতে হবে আপনাকে।

- আমি তো খারাপ কিছু বলিনি। বলছিলাম পশ্চিমা পুঁজিবাদি দেশগুলোর অভিশপ্ত জীবনের কথা।

- আপনি বললেন আর আমরা বিশ্বাস করলাম? অভিশপ্ত জীবন কোথায়, তা ভালো করেই জানা আছে আমাদের।

- চলুন আমার সাথে।

দুই.

সেই সোভিয়েত আমল এখন নেই বটে কিন্তু গণতন্ত্রের দেখা মেলেনি রাশিয়ায়। গণতন্ত্র পথ হারিয়েছে পশ্চিমা ভাবধারা পুষ্ট অনেক দেশেই। আবার এতোসব নেই-এর মধ্যেও পৃথিবীর অনেক দেশেই চলছে গণতন্ত্রের চর্চা। শুধু সরকার তৈরি করতেই নয় রাজনৈতিক দলের মধ্যেও  অবাধ গণতন্ত্রের চর্চা অনেক উত্তেজনারও জন্ম দিচ্ছে। হালের অষ্ট্রেলিয়া তার বড় উদাহরণ।

সম্প্রতি একটা রাজনৈতিক নাটক দেখলো অষ্ট্রেলিয়ার জনগণ। এটাকে নাটক না বলে বরং বলা দরকার গণতন্ত্রের খেলা। কেমন সে খেলা? মাত্র দুদিনেই বদলে গেলো সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার। ঠিক চেয়ার নয়, চেয়ারে বসা মানুষটি। অনেকটা মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো ঘটনা।

অস্ট্রেলিয়ার ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির নেতা যিনি ছিলেন সেদেশের প্রধানমন্ত্রী তার ওপর অনাস্থা আনলো ওই দলেরই কিছু সংসদ সদস্য। ভোটাভুটি হলো ওই দলের মধ্যেই।  প্রধানমন্ত্রী জিতলেন অল্প কিছু ব্যবধানে। তারপরেও তার মন্ত্রিসভার কিছু সদস্য পদত্যাগ করলেন। এর পরে আবার নতুন করে ভোটাভুটি হলো। তিনজন লড়লেন এবার ।  ভোটে জিতে নতুন প্রধানমন্ত্রী শপথ নিলেন।

ঘটনাটি এরকম। দলের প্রধান নেতা পরিবর্তনের দাবি নিয়ে ২১ আগস্ট ২০১৮   প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলকে চ্যালেঞ্জ করেন পিটার ডাটন। অভিবাসন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডাটনের চ্যালেঞ্জ যায় ভোটাভুটিতে।  স্বল্প সময়ের মধ্যেই দলের নির্দিষ্ট সদস্যের ভোট গ্রহণ করা হয়। ৪৮-৩৫ ভোটে জিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল ছিলেন টার্নবুল। হেরে গিয়ে নিজের মন্ত্রিত্ব পদই ছেড়ে দেন ডাটন। এরপর অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন নাটকীয়তার শুরু হয়। ডাটনের পথ ধরে ১৩ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী তাদের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

পরদিন ২২ আগস্ট ২০১৮ সরকার কাঠামো অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে ওঠে। এর সুযোগ নেন ডাটন। আবারও টার্নবুলকে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় টার্নবুলের পক্ষে থাকা অর্থমন্ত্রী ও তার সমর্থকেরাও টার্নবুলের পাশ থেকে সরে দাঁড়ান।

২৩ আগস্ট ২০১৮ লিবারেল পার্টির দলীয় কোন্দল অন্যরকম মোড় নেয়। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব  চ্যালেঞ্জ করা ডাটনের এই উদ্যোগ নেবার যোগ্যতা আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী টার্নবুল।

ডাটন সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য কি না, তাই আগে প্রমাণের দাবি তোলেন টার্নবুল।

ডাটনের দুটি দাতব্য সংস্থা বেআইনিভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা যাচাইয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আইনি প্রক্রিয়া সচল থাকার সুযোগটাই কাজে লাগান টার্নবুল। অস্ট্রেলিয়ার সংবিধান অনুযায়ী ডাটনের বিরুদ্ধে কোনো আইনি জটিলতা রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয় সঙ্গে সঙ্গে।

টার্নবুলের ওই আরজি কাজে লাগেনি। ডাটনের বিরুদ্ধে কোনো সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। ফলে আবার দলীয় নেতা নির্বাচনের ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। এবারের নির্বাচনে আর প্রার্থী হননি প্রধানমন্ত্রী টার্নবুল।

দলীয় নেতা ও প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামেন সদ্য পদত্যাগী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডাটন, সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপ ও টার্নবুলের বিশ্বস্ত সহকর্মী স্কট মরিসন। মরিসন ৪৫-৪০ ভোটের ব্যবধানে পিটার ডাটনকে হারিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদে জয়লাভ করলে তিনি হন অস্ট্রেলিয়ার ৩০তম প্রধানমন্ত্রী। 

গত এক দশকের মধ্যে ম্যালকম টার্নবুলসহ অস্ট্রেলিয়ার মোট চারজন প্রধানমন্ত্রীকে নিজের দলের বিদ্রোহের কারণে পদ হারাতে হয়।

অষ্ট্রেলিয়ার এই গটনা গণতন্ত্র চর্চার একটা বড় উদাহরণ হতে পারে। গনতন্ত্র থাকলে দলের মধ্যে একেশ্বর জন্ম নেবার সুযোগটা কমে যায়। দলের এমপিদের সুযোগ থাকে নতুন এবং পছন্দসই নেতা নির্বাচনের।  একটা দেশে দলীয় ও সংসদীয় গণতন্ত্র থাকলে কি হতে পারে তার উদাহরণ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।

মজার বিষয় হচ্ছে সরকারি দলে এই উথাল পাতাল চলছে, সরকারের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে কিন্তু তার প্রভাব দেশের অর্থনীতিকে ন্যুনতম বিচলিত করে নাই। এই ঘটনা সরকারি প্রশাসন যন্ত্রকেও প্রভাবিত করে নাই। এর কারণ হচ্ছে গণতন্ত্রের চর্চা নিয়মমাফিক ও নিয়মিত থাকায় সেখানে তৈরি হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা। গড়ে উঠেছে ন্যায্য রাষ্ট্রাচার। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিকভাবে নিজেদের ম্যান্ডেট মতো কাজ করতে পেরেছে। সরকারি দল বা সংসদ অন্যায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে নাই। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা থাকায় সেখানকার নিয়মমাফিক যে কোনো পরিবর্তনকেও মেনে নিয়েছে ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠানসহ দলের সবাই।

যিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন তিনিও যেমন রুষ্ট-ক্রুদ্ধ হয়ে দল ভাঙ্গার চেষ্টা করেননি, তেমনি যিনি নতুন দলনেতা হয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনিও পরাজিত প্রার্থিকে নির্মূল করার পদক্ষেপ নেন নাই।

তিন.

অষ্ট্রেলিয়ার সরকারি দলের এই নাটকীয় পরিবর্তন প্রমাণ করে যে ,এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের বিউটি। গনতন্ত্রের আসল সৌন্দর্য্য। গনতান্ত্রিক কাঠামো ঠিক থাকলে শতফুল ফুটতে পারে, বিকশিত হতে পারে রাজনৈতিক গুণাবলী। আমাদের দুর্ভাগ্য সেইরকম শতফুল ফোটার গণতান্ত্রিক আবহ বাংলাদেশে আজও তৈরি হয় নাই। তবে , এটা ঠিক , হয় নাই বলে যে হবে না তাও কেও হলফ করে বলতে পারে না। আমাদের সকলের দায়িত্ব হচ্ছে গণতন্ত্রের মেজাজটা সঠিক রেখে সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরিতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখা।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর