হংকং ইস্যুতে চীন-মার্কিন সম্পর্ক!

, যুক্তিতর্ক

ড. মো. কামাল উদ্দিন | 2023-08-31 13:13:51

হংকংয়ের সরকারী নাম- হংকং স্পেশাল প্রশাসনিক অঞ্চল যা  চীনের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে একটি শহর-অঞ্চল নিয়ে গঠিত একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল।বছরের পর বছর ধরে একটি স্বাধীন আইনসভা নিয়ে হংকং এক ধরনের স্বাধীনতা উপভোগ করে আসছিলো। এই শহরটি ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ১৫০ বছর ব্রিটিশের অধীনে ছিল। ১৯৯৭ সালে চীন-ব্রিটিশ যুগ্ম ঘোষণাপত্র ও হংকংয়ের বেসিক আইন অনুসারে বেইজিংয়ে কাছে স্থানান্তরিত হয়েছিলো ।তখন নগররাষ্ট্রটিকে ‘এক দেশ, দুই নীতির আওতায় বিশেষ স্বাধীনতার পাশাপাশি বিচারিক ও আইনি স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা হয়।

হংকংয়ের এ বিশেষ মর্যাদা বেসিক আইন অনুসারে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত সুরক্ষিত থাকার কথা। স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ব্যবসার জন্য বিশ্বের শীর্ষস্থানে রূপান্তরিত হয়েছে এ নগর রাষ্ট্রটি।

কয়েক বছর ধরে হংকংয়ের এই বিশেষ মর্যাদা খর্ব করার জন্য বেইজিং সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ পদক্ষেপের একটি অন্যতম বিষয় ছিল হংকংয়ের পার্লামেন্টের ক্ষমতা খর্ব করা ও নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন করা যা হংকংয়ের জনগণ কোনোভাবেই মেনে নিতে রাজি নয়। এজন্য হংকংয়ের ছাত্র সমাজ ও গণতন্ত্র পন্থীরা ২০১৪ ও ২০১৯ সালে ব্যাপক আন্দোলনে লিপ্ত হয়। হংকং এর স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার এ আন্দোলন বিশ্ববাসীর নজর কাড়লেও নিজের শক্ত অবস্থান পরিবর্তন করেনি বেইজিং সরকার। যেকোনো মূল্যে হংকংকে আরো বেশি নিয়ন্ত্রণের নিয়ে শাসন করায় যেন বেইজিং সরকারের মূল লক্ষ্য।

এর ধারাবাহিকতায় আন্দোলনকারীদেরকে স্তিমিত করার জন্য ও ভবিষ্যতে চায়নার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে যেন কোন আন্দোলন করতে না পারে সেই জন্য সামনে নিয়ে আসে একটি বিতর্কিত আইন যা হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন, হংকংয়ের বেসিক আইন ও হংকংকে দেয়া বিশেষ মর্যাদার পরিপন্থী। আর এ আইনের নাম হলো 'জাতীয় সুরক্ষা আইন'।মূলত চীন সরকার ঘোষণা দিয়েছিল যে হংকংয়ে সহিংসতা ও অস্থিরতা নিরসনে তারা জাতীয় নিরাপত্তা আইন জারি করবে। অবশেষে গত ১ জুলাই ২০২০  আইনটি পাস করা হয়। চীন সরকারতবে পাসকৃত এ আইনে কী কী বিষয় রয়েছে, তা হংকংয়ের জনগণের কাছে এখনো পরিষ্কার করা হয়নি। ফলে আইনটি নিয়ে একদিকে হংকংয়ের জনগণের মধ্যে ভীতি অন্যদিকে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ।এ আইনের আওতায় হংকংয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম, কেন্দ্রীয় সরকারের অবমাননা, সন্ত্রাসবাদ ও বিদেশি শক্তির সঙ্গে আঁতাত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। আর এসব অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

এ আইনের ফলে হংকংয়ের জনগণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিশ্বও নড়েচড়ে বসে। ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক বিশ্ব এটিকে হংকংয়ের এক দেশ দুই নীতি এর পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং হংকংয়ের দীর্ঘদিনের ভোগ করা স্বাধীনতার জন্য চরম হুমকি ও হংকং দীর্ঘদিন ধরে যে অধিকার ভোগ করে আসছিলো তার চরম লংঘন হিসেবে দেখছে।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে বিবৃতি দিয়েছে। তারা একটি যৌথ বিবৃতিতে দাবি করেছেন যে এই আইনটির সাথে চীন-ব্রিটিশ যৌথ ঘোষণার নীতিমালা, হংকং এর বেসিক আইন ও জাতিসংঘ নিবন্ধিত আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হংকং এর সম্পর্ক খুবই গভীর। দীর্ঘদিন ধরে হংকং একাধারে মার্কিন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে সমন্বয় করে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে। কিন্তু বিতর্কিত এই আইন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হংকং এর সম্পর্কের ঘাটতি শুরু হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে এ আইন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন হ্রাসের সাথে জড়িত। তিনি আরও যোগ করেছেন যে তিনি হংকংয়ের উপর ভ্রমণ ঝুঁকি সংক্রান্ত সতর্কতা বাড়াবেন। অন্যদিকে চীন দাবি করেছে যে এ‌ আইন চীন ও হংকং এর জাতীয় সুরক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং হংকং এর স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক বিষয়ে এ আইন কোন বাধা সৃষ্টি করবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো হংকং একটি মুক্ত সমাজ হিসাবে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ছিলো, কিন্তু বেইজিংয়ের এই সিদ্ধান্ত সব কিছুই উলটপালট করে দিবে বলে মনে হচ্ছে। বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এ শক্তিশালী ব্যবস্থা সাধারণত রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট উভয়ই সমর্থন করেন, যারা বেইজিং থেকে হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসনের স্বীকৃতি দেওয়ার আইন ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে বেজিং সরকারকে দেখছেন। এইজন্য বেইজিং সরকারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য তারা একমত প্রকাশ করেন। বাস্তবেও চীনের জাতীয় সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে  হংকংয়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উপর বেইজিংয়ের দীর্ঘকালীন আক্রমণকে নির্লজ্জভাবে ত্বরান্বিত করবে বলে ধারণা করেন বিশ্লেষকগণ।

অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের পদক্ষেপকে আমলে নিচ্ছে না বেইজিং সরকার। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক বনি গ্লেজার দাবি করেছেন যে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপগুলি বেইজিংয়ের উপর খুব কম প্রভাব ফেলবে কিন্তু খুব সরাসরি প্রভাব ফেলবে হংকংয়ের বাসিন্দাদের উপর। হংকংয়ের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত অনেক পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে হংকংয়ের মানুষকে আঘাত করবে  ঠিকই কিন্তু বেইজিংকে জাতীয় সুরক্ষা আইন কার্যকর করতে তেমন বাধা দেবে না। অন্যদিকে বেইজিংপন্থী হংকং সরকার এক প্রতিক্রিয়ায় জানান যে  ট্রাম্পের এই অঞ্চলটিতে বিধিনিষেধ আরোপের প্রচেষ্টা যে দ্বি-দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য "দ্বি-তরোয়াল" হবে বলে মন্তব্য করেছে। ট্রাম্প সরকারের নীতি  কেবল হংকংয়ের স্বার্থকেই ক্ষতিগ্রস্থ করবে না‌ বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ হবে। অন্য কোনও জায়গার নীতিতে হস্তক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞার হুমকি আন্তর্জাতিক আইন এবং আন্তর্জাতিক অনুশীলনের লঙ্ঘন বলেও দাবি করে হংকং সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার পর কোন অংশে পিছিয়ে নেই চীন সরকার। চীনা কর্মকর্তারা দাবি করেন যে ট্রাম্প বেইজিং ও হংকংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এগিয়ে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন তারা।

পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, হংকং ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক আরো অবনতি হবে। ইতিমধ্যেই সারাবিশ্বে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে চীন সরকারের অব্যবস্থাপনার জন্য চীনকে দায়ী করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। করোনাভাইরাস ইস্যুতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এমনিতেই শীতল রয়েছে। আসলে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে মার্কিন-চীন সম্পর্কের নিম্নমুখী অবস্থান অব্যাহত রয়েছে।  অন্যদিকে ১৫০ বছর শাসনের অবসান করে ৫০ বছরের জন্য চুক্তিতে চীনের কাছে ফেরত দেয়া হংকংয়ের জনগণের স্বাধীনতার জন্য  জাতীয় সুরক্ষা আইনকে মারাত্মক বাধা হিসেবে দেখছেন যুক্তরাজ্য সরকার। হংকংকে ফেরত দেয়ার চুক্তির পরিপন্থী হিসেবেও গণ্য করছেন এ আইনকে। হংকংয়ের ৩০ লক্ষ নাগরিককে যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব দেয়ার প্রস্তাব করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ।

হংকং ইস্যুতে চাইনা নীতির পরিবর্তন, চীনের বিভিন্ন পদক্ষেপ, ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া, করোনাভাইরাস মহামারীর উৎপত্তি এই সব মিলে চীন-মার্কিন সম্পর্কের ঘাটতি আরও বাড়িয়ে তুলবে। কারণ অতিতে হংকংয়ের বিশেষ মর্যাদা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে উপকৃত হয়েছে তা আর নাও হতে পারে চীনের হস্তক্ষেপের কারণে।  আসলে এখানে চীন তাদের নীতিতে অটল। হংকংকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও ব্যবসাকে আরো নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টার একটি অংশ এ নতুন আইন। বর্তমানে চীন-মার্কিন সম্পর্ক,চীন-ভারত ও হংকং ইস্যু সব মিলিয়ে পরাশক্তিগুলো ক্ষমতার লড়াই দৃশ্যমান। আর লড়াইয়ে অস্বস্তিতে পড়বে বাংলাদেশ হংকংসহ অসংখ্য ছোট ছোট রাষ্ট্র এবং এর শেষ কোথায় গিয়ে ঠেকে তা এখন একটি বড় প্রশ্ন!

. মো. কামাল উদ্দিন, প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।       

এ সম্পর্কিত আরও খবর