অনলাইন ক্লাস কতটুকু শিক্ষা ও শিক্ষার্থী বান্ধব?

, যুক্তিতর্ক

নুসরাত জাহান ডায়না | 2023-09-01 21:03:38

করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাসের বিস্তার ঘটছে অতিদ্রুত গতিতে। প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে অনলাইনে ক্লাস চালু করেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর কাছে বিষয়টি নতুন। তথাপি বিদ্যমান বাস্তবতার কারণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসের দিকে ঝুঁকছেন।   

অনলাইন ক্লাসের কথা এলেই একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। আর তা হলো, অনলাইন ক্লাস কতটুকু শিক্ষা ও শিক্ষার্থী বান্ধব? এর সুবিধা বা অসুবিধার দিকগুলোও স্বাভাবিকভাবে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আলোচনায় স্থান পাচ্ছে।

আসলে অনলাইন ক্লাসের বিষয়টি নতুন, যা বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপের ফলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ  সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অনেক কিছু স্থবির হয়ে আছে। বিশেষত গত ৩/৪ মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে।

এমতাবস্থায় বিকল্প উপায় হিসেবে সরকার এবং দায়িত্বশীল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে টিউটোরিয়াল বা অনলাইনে জুম মিটিং এর মাধ্যমে ক্লাসের উপর জোর দিচ্ছে। তাছাড়া সংসদ টিভিতে নিয়মিত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, করোনাকালের বাস্তবতায় লকডাউন, আইসোলেশন, হোম কোয়ারেন্টাইন, সোশ্যাল ডিস্টেন্স  ইত্যাদি যে শব্দগুলো ও পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল না সেইসব শব্দগুলোকে নিয়ে বিরূপ পরিস্থিতিতে আমরা বসবাস করছি বা করতে বাধ্য হচ্ছি। তাতে যেন শিক্ষা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে না পড়ে, সেটাই সকলের উদ্দেশ্য এবং এজন্যই অনলাইন ক্লাসের গুরুত্ব।

এ তথ্য সবার জানা যে, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহানে উদ্ভূত হয়ে ক্রমশ সারা বিশ্বে ছড়াতে থাকে। এই ভাইরাসের কারণে গত মার্চে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর এপ্রিল পর্যন্ত ঈদসহ নানা ছুটিতে পুরোপুরি বন্ধ থাকে। মে মাস থেকে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পড়ানোর কাজ শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

এরই ধারাবাহিকতায় আমরাও অনলাইন ক্লাসের মতো নতুন একটি বিষয়ে অবহিত ও প্রস্তুত হই। ইতিমধ্যে  আমার কর্মস্থল  চট্টগ্রাম মহানগরের ওমরগণি এম ই এস কলেজ গত এপ্রিল মাস থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অনলাইন ক্লাস শুরু করে। মে মাস থেকে অনার্স, ডিগ্রি শ্রেণির জন্য অনলাইন টিঊটোরিয়াল বা অনলাইন জুম মিটিং ক্লাসের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা আসে মাউশির পক্ষ থেকে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ক্লাস শুরু হয়ে চলমান রয়েছে।

শুধুমাত্র চট্টগ্রাম নয়, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে যশোর, রাজশাহী ও সাতক্ষীরাসহ আরো কয়েকটি অঞ্চলে এ ধরণের কার্যক্রম শুরু করেছে কলেজগুলো। ক্লাসগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে সহজে পৌঁছানোর জন্য কলেজগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কলেজভিত্তিক অনলাইন পেজ খুলেছে। ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে পেজগুলোতে শিক্ষকগণ ক্লাসগুলো আপলোড দিচ্ছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে,  এই ক্লাসগুলো আমরা কতজন শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাতে পারছি এবং কতটুকু শিক্ষা ও শিক্ষার্থী বান্ধব করতে পারছি?  উন্নত বিশ্বের দেশগুলো তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক বেশি সমৃদ্ধ হলেও বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল একটি দেশে সর্বস্তরে ও সর্বজনে  তথ্য-প্রযুক্তিগত সুবিধার বিষয়টি এখনো 'অতিকল্পনা' স্বরূপ। শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। অনেক শিক্ষার্থী এমন আছে যাদের 'দিনে এনে দিনে খায়' অবস্থা।

এসব শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় ডিভাইস, নেট সংযোগ, ডাটা ও এক্সেস সুবিধা ব্যবহার করার মতো আর্থিক ও সামাজিক সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থানে নেই। উপরন্তু    যারা শহরাঞ্চলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী,  তারা তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের কিছুটা অগ্রসর সুবিধা পেলেও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারীরা সেসব সুবিধা থেকে অনেকাংশেই বঞ্চিত।

ফলে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত অনলাইন ক্লাসের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এখনও গ্রাম এবং শহরের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়ে গেছে। শহরে যেখানে ঘরে ঘরে ব্রডব্যান্ড সুবিধা বিদ্যমান সেখানে গ্রামে তথ্য-প্রযুক্তি ততটা প্রসার লাভ করেনি।

এইসব সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতার পাশাপাশি আরো কিছু বিষয়ও অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হচ্ছে। যেমন, দীর্ঘসময় ধরে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করে বলে তাদের চোখের ক্ষতি হতে পারে, চিকিৎসকেরা এমন আশঙ্কা করেছেন। এছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ল্যাপটপ বা ডেক্সটপ কম্পিউটার সুবিধা নেই। তারা পিতা-মাতা বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ক্লাস করছে। এতে ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক হানি ও ভুল বোঝাবুঝির মতো তিক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে। 

এমন পরিস্থিতিতে কেউ জানেনা,  এই পেন্ডেমিক কতদিন চলতে পারে। তাই এমন পরিস্থিতিতে  এই অনলাইন ক্লাসের অন্যতম সুফল হলো, দীর্ঘদিন ঘরবন্ধি থাকা ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশুনার সাথে যুক্ত থাকতে পারছে। বাংলাদেশেও কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত অনলাইনেই ক্লাস, পরীক্ষা, ভাইবা ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির অপ্রতুলতার কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এই ব্যবস্থা চালু করতে পারছে না, এটি একটি সমস্যা।

দেশের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস শুরু করেছে পরীক্ষামূলকভাবে। তবে চলতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো বিভাগ ও ইন্সটিটিউট পুরোদমে ক্লাস শুরু করবে বলে খবরে প্রকাশ। তবে এই অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থীদের কতটুকু যুক্ত করতে পারবে সেই বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন ঢা.বি. পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অন্যসব বিভাগের মত ৭ জুলাইয়ের মধ্যে অনলাইন ক্লাস শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে আমাদের বিজ্ঞান অনুষদে অনলাইন ক্লাস কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, শিক্ষার্থীদের কতটা যুক্ত করতে পারবে তা জানি না।'

সরকারী হিসাবে দেশে প্রায় ৬৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৭ হাজারের মত মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২ হাজার ৫ শত কলেজ রয়েছে, মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৫ কোটি। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে যুক্ত করা একটি বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ। দেশের অনেকগুলো এলাকা ইন্টারনেট এবং টিভির আওতায় নেই। ফলে অনেকে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

তবুও আমরা একটি সুস্থ বিশ্বের, একটি সুস্থ পরিবেশের স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি জ্ঞান ও শিক্ষায় আলোকিত বাংলাদেশের। একসময় করোনার দুঃস্বপ্ন থেমে যাবে যেমনটা ধুয়ে মুছে নিয়ে যায় এক পশলা বৃষ্টি! ততদিন আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে। সেক্ষেত্রে অনেক সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও অনলাইন ক্লাসের দিকে আমাদের ঝুঁকতে হবে এবং এক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা ও অসুবিধাগুলো ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠে অতিদ্রুত অনলাইন ক্লাসকে শিক্ষা ও শিক্ষার্থী বান্ধব করতে হবে।    

নুসরাত জাহান ডায়না: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ওমরগণি এম ই এস কলেজ, চট্টগ্রাম ও এমফিল গবেষক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।     

এ সম্পর্কিত আরও খবর