বড়দের ঘুম কি ভাঙবে না?

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-30 08:43:03

ঈদুল আজহা চমৎকার এক ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবের সময় অল্প সময়ের জন্য হলেও মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের সাম্যের পরিবেশ তৈরি হয়। কোরবানির সময় বাংলাদেশের প্রত্যেক মুসলমানের ঘরে মাংস পৌছে যায়। অনেকের ঘরে হয়তো বছরে একবারই মাংস আসে ঈদের বদৌলতে। কিন্তু ইসলামের এই অসাধারণ উৎসবও অন্তত ১০৯টি পরিবারে ম্লান হয়ে গেছে। কারণ ঈদের ছুটির ৭ দিনে বাড়ি যাওয়ার সময় বা ফেরার সময় বা মরণফাঁদ হয়ে ওঠা রাস্তায় চলাচলের সময় ৫২টি দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১০৯ জন মারা গেছেন। তবে ঈদ ম্লান হয়ে যাওয়া পরিবারের সংখ্যা আরো বেশি। কারণ এইসব দুর্ঘটনায় আহত কয়েকশ জনের পরিবারও নিশ্চয়ই ব্যস্ত ছিল স্বজনের চিকিৎসায়-শুশ্রুষায়। এই পরিবারগুলোয় তাই ঈদ আসেনি। আনন্দের বদলে তাদের ঘরে-ঘরে ছিল হাহাকার আর কান্না।

দুই সহপাঠীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে অসাধারণ এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। শেষ দিকে ছিনতাই হয়ে গেলেও সে আন্দোলনটি দেশজুড়ে অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ এ আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিয়েছিল। তাদের মূল দাবি ছিল- নিরাপদ সড়ক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯ দফা দাবির কয়েকটি তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করেন। বাকিগুলো বাস্তবায়নে নির্দেশনা দেন। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো প্রধানমন্ত্রী যত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন, তার পারিষদবর্গ ততই ধীরে তা বাস্তবায়ন করেন। সেটা কি দক্ষতার অভাব, আন্তরিকতার অভাব নাকি শেখ হাসিনাকে ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা? এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাসখানেক আগে গত ২৫ জুন মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে শেখ হাসিনা সড়ক নিরাপদ করতে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ ও সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সিদ্ধান্তগুলো হলো ১. বাসের চালক ও হেলপারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ২. লং রুট বা দীর্ঘ পথে কখনোই একজন চালক ৫ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে বিকল্প ড্রাইভারের ব্যবস্থা করতে হবে। ৩. রাস্তার পাশে চালক ও হেলপারদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণ করতে হবে। যেখানে তারা বিশ্রাম নিতে পারবেন এবং সেখানে তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। ৪. যাত্রীদের অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা পারাপার বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ৫. সড়ক পথের সিগন্যাল শতভাগ মেনে চলাতে হবে। সবাই যাতে সিগন্যাল মেনে চলে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ৬. প্রত্যেক পরিবহনে চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বেঁধে রাখতে হবে। সিটবেল্ট না থাকলে তার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শুধু নির্দেশ দিয়েই বসে থাকেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং নৌ পরিবহনমন্ত্রীকে বসে এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ারও নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দুই মাস পেড়িয়ে গেছে, মাঝখানে শিক্ষার্থীরা মানুষকে জাগিয়ে তোলা, শিখিয়ে দেয়া, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার আন্দোলন করে দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছেন। সবাই ভাবছিলেন, এবার বুঝি কিছু একটা হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। আমাদের মন্ত্রীরা অনেক ব্যস্ত। তারা একসাথে বসারই সময় পাননি, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন তো দূরের কথা। তার মানে চালক-হেলপারের প্রশিক্ষণ হয়নি, টানা ৫ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো বন্ধ হয়নি, বিকল্প চালক হয়নি, চালকদের বিশ্রামের ব্যবস্থা হয়নি। এখনও একজন চালক 'মায়ের দোয়া নিয়ে আল্লাহর নামে চলিলাম' বলে শুরু করেন; তারপর ১০ ঘণ্টা লাগুক, ১২ ঘণ্টা লাগুক তার আর নিস্তার নেই, গন্তব্যে পৌঁছার আগে বিশ্রাম নেই। অবশ্য সবাই গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন না বা যাত্রীদের পৌঁছে দেন চির গন্তব্য। মাঝমধ্যেই দেখা যায়, রাস্তার পাশে বাস উল্টে আছে। ওল্টানোরই কথা; বাসচালক তো মানুষ, রোবট নয়। প্রধানমন্ত্রীর ২৫ জুনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে বা অন্তত বাস্তবায়নের লক্ষণ দেখা গেলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সরকার নৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে থাকতো।

আমার ধারনা ছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রভাবে এবার ঈদে দুর্ঘটনা কম হবে। সবাই সচেতন হবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। দুর্ঘটনা ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে।

শাজাহান খান নৌ পরিবহন মন্ত্রী। কিন্তু নৌ পরিবহনে তার আগ্রহ কম। তার আগ্রহ পরিবহনে, গার্মেন্টসে, ব্যাংকে। মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পরপরই তার পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠন থেকে পদত্যাগ করা উচিত ছিল। স্বার্থের সংঘাত বলে একটা কথা আছে; আমার ধারনা, এ ব্যাপারে তার কোনো ধারনাই নেই। পরিবহন খাত থেকে সরেন তো নাই, উল্টো গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংগঠন করেছেন। নৌপরিবহন মন্ত্রীর বাসা থেকে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট শুরুর ঘোষণা আসে, শেষের ঘোষণাও আসে। কী অবিশ্বাস্য!

তার অনেক অসংবেদনশীল কথা ও আচরণ মানুষকে বেদনার্ত করেছে। তার কথা মানুষের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়। শাজাহান খানের এক হাসিতেই কিন্তু মাঠে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। তার কথা-আচরণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়, অনেক উন্নয়ন হারিয়ে যায়। শাজাহান খান কেন প্রধানমন্ত্রীর শ্রমিকবান্ধব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ত্বড়িৎ পদক্ষেপ নিলেন না, বুঝতে পারছি না।

প্রশিক্ষণ, বিশ্রাম, ৫ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্তে তো শ্রমিকদের খুশি হওয়ার কথা। তবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে মালিকের ব্যয় বাড়বে, শ্রমিকের আয় কমবে; তাই হয়তো যতদিন শাজাহান খান দায়িত্বে, ততদিন এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে না। যে দেশে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় না, সে দেশে সড়ক নিরাপদ হবে কী করে? ব্যাপারটা তো মোটেই এমন নয় যে, প্রধানমন্ত্রী সুইচ টিপলেন আর বললেন, 'সড়ক তুমি নিরাপদ হয়ে যাও'; অমনি সড়ক সুরসুর করে নিরাপদ হয়ে গেল। কথায় কথা বাড়বে, কিন্তু কাজ হবে না। কাজ হতে হলে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

ঈদ উৎসব শেষ হয়, কিন্তু সড়কে মৃত্যুর উৎসব শেষ হয় না। গত ৫৪৮ দিনে, ৪ হাজার ৯৬৬ জন মারা গেছে। ঈদ শেষে সচিবালয়ে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য ধীরগতির ছোট যান দায়ী। এটা কোনো নতুন আবিস্কার নয়। সবাই জানে। ঈদের পরদিন দুই ঘণ্টারও কম সময়ে কুমিল্লা গিয়েছিলাম। তার পরদিন ফেরার সময়ও তেমনই সময় লেগেছে। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালাতে ভালোই লেগেছে। যাওয়ার সময় অন্তত দুটি বাসকে দেখেছি রাস্তার পাশে চিৎপটাং হয়ে আছে। আমিও যে অন্তত তিনটি দুর্ঘটনা না ঘটিয়ে বাসায় ফিরতে পেরেছি, তাতে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিয়েছি। মহাসড়কে ধীরগতির যান রিকশা, লেগুনা, সিএনজি, নসিমন, করিমন, ভটভটি চালানো ঝুকিপূর্ণ। কিন্তু তারচেয়ে বেশি ঝুকিপূর্ণ হলো, এসব যান উল্টো দিক থেকে আসা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অহরহ রংসাইডে রিকশা, সিএনজি চলে। মহাসড়কে যে অরাজকতা দেখেছি, তাতে দুর্ঘটনা অনেক কম হচ্ছে। আরো অনেক বেশি হওয়ার কথা। ভাগ্যগুনে আমরা বেঁচে আছি। আপনি যখন-তখন রাস্তা পাড় হবেন, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে রিকশা-লেগুনা চালাবেন আর দুর্ঘটনা হলে চালককে গণপিটুনি দিবেন, নইলে ফাঁসি চাইবেন; তা তো হবে না। আগে প্রাথিমক শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। চালকের লাইসেন্স আর গাড়ির ফিটনেস তো প্রাথমিক শর্ত। এর জন্য তো আলাদা সিদ্ধান্তের দরকার নেই। প্রতিদিন খাওয়ার জন্য যেমন আপনার সিদ্ধান্ত লাগে না, লাইসেন্স-ফিটনেসও তেমনি। অথচ ঈদের দুদিন পর নাটোরে যে দুর্ঘটনায় ১৫ জন মারা গেল; সেই বাসটি কেনা হয়েছিল ভাঙ্গারি হিসেবে, অবৈধ লেগুনার চালক ফোনে কথা বলছিলেন।

আর সবার মত মন্ত্রীও বুঝেছেন যে ধীরগতির ছোট যানই মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। বুঝে তিনি বসে থাকেননি। পরদিনই সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক করে ধীরগতির যান চলাচল বন্ধসহ ২০টি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ, কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন। তিন মাস পরপর সড়ক পরিষদের বৈঠক হওয়ার কথা। এর আগেরটি হয়েছে ১০ মাস আগে। সে বৈঠকেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কিন্তু কার্যকর হয়নি। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, এবারও কার্যকর হবে না। এর আগে একবার ধীরগতির যান তুলতে গিয়ে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। নির্বাচনের আগে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইবে না। আর নির্বাচনের পরেও এটা সম্ভব নয়। ধীরগতির যান তুলে দিলে মানুষ যাতায়ত করবে কীভাবে? চাহিদা থাকলে যান চলবে, গতি যাই হোক। বিকল্প পরিবহন, ধীরগতির যান চলার জন্য বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করলেই কেবল ধীরগতির যান বন্ধ করা সম্ভব। ততদিন কী করতে হবে? প্রতিদিন বাসা থেকে বিদায় নিয়ে বেরুতে হবে। আর সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটলে হাসিমুখে বরণ করে নিতে হবে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সবাই বলছিলেন, ছোটরা বড়দের শিখিয়ে দিচ্ছে, জাগিয়ে তুলছে। কিন্তু সে আন্দোলন থেকে আমরা কী শিখলাম বুঝতে পারছি না। দুর্ঘটনা তো কমছে না, বরং বাড়ছে; বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। তবে কি আমরা ঘুমের এমন স্তরে পৌঁছে গেছি, যেখান থেকে আমাদেরকে আর জাগানো সম্ভব নয়?

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর