শিক্ষা না ব্যবসা, কোন পথে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়? [পর্ব ১]

, যুক্তিতর্ক

মো. জাকির হোসেন | 2023-08-30 01:02:14

অনুমান করতে কষ্ট হয়না শিরোণাম পড়েই পাঠকগণ অন্ততঃ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাবেন। একভাগ সমর্থন যোগাবেন, অন্যভাগ মুণ্ডুপাত করতে ছাড়বেন না। তবে একটা বিষয় প্রথমেই খোলাসা করে নেই, আমার এ লেখা সকল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য নয়। একথা সর্বজনবিদিত যে, মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের র‌্যাংকিংয়ে পৃথিবীর প্রথম দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের দেশেও হাতেগোনা কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান ও মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি-র বক্তব্য ও অতিসম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আলটিমেটাম দিয়ে প্রেরিত পত্র আমাকে এ কলাম লিখতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। অধ্যাপক আবদুল মান্নান ক্লান্তিহীনভাবে বলে যাচ্ছেন কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকান্ডে স্বচ্ছতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অভিযোগ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে বিধিবহির্ভূতভাবে ব্যয় হচ্ছে, ভর্তি বাণিজ্য, অর্থের বিনিময়ে অনুমোদিত শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তিসহ আরও নানাবিধ নীতিবিরোধী কর্মকান্ড করছে এ সব বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কার্পন্য করবে না। তিনি হামেশাই সতর্ক করছেন যে, অচিরেই কমিশন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম সনাক্ত করতে অডিট কর্মসূচি শুরু করবে এবং আইন ও বিধিবহির্ভূত অনিয়ম সনাক্ত হলে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করার পরামর্শ দিবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেশের একটি প্রথম সারির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আছে। প্রতিটি সেমিস্টারে এক-তৃতীয়াংশ ছাত্রছাত্রীই লাখ লাখ টাকার লেনদেনে ভর্তি হচ্ছে। এ কারণে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মেধাবীরা। তবে এ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তিবাণিজ্যে কোনো রাখঢাক নেই। পরিচালনা পর্ষদ নিজেদের প্রার্থীদের বিশেষ বিবেচনায় ভর্তির সিদ্ধান্ত বোর্ডসভায় অনুমোদন করিয়ে নেন। মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে একাধিকবার বলেছেন, যে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সফল হতে পারে নি, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার পরিবেশ ও নির্ধারিত শর্তপূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যারা মুনাফার লক্ষ্য নিয়ে চলতে চান, যারা নিজস্ব ক্যাম্পাসে এখনো যান নি, যারা একাধিক ক্যাম্পাসে পাঠদান পরিচালনা করছেন তাদের বিরুদ্ধে অব্যাহত চাপ রেখেও সঠিক ধারায় আনা কঠিন হয়ে পড়েছে। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া তারা আর কোন পথ খোলা রাখেন নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক অনিয়ম ঠেকাতে কয়েক দিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আলটিমেটাম দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক হওয়ার পরও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা প্রতিষ্ঠানের অর্থ নানাভাবে আত্মসাৎ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি থেকে বার বার নির্দেশনা দেয়ার পরও বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট জমা দেয়নি। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ও আচার্যের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে কতিপয় নির্দেশনা সম্বলিত এ পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। নির্দেশনা অমান্য করলে এবার কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে পত্রে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।

ইউজিসি বলছে, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখতে তেমন কোনও কার্যক্রম পরিচালনা করে না। গবেষণার জন্য নেই তেমন অর্থ বরাদ্দ, লাইব্রেরিতে নেই পর্যাপ্ত বই, নেই ল্যাব সুবিধা, ক্লাসরুমের সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। এতে করে শিক্ষার মান নিশ্চিত হচ্ছে না। তা সত্ত্বেও একের পর এক অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ বছরের শুরু থেকে গত পাঁচ মাসে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জানুয়ারির শেষের দিকে অনুমোদন পেয়েছে জেডএনআরএফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস। এপ্রিলে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে ১৭ এপ্রিল খুলনায় খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহীতে আহছানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২৮ এপ্রিল অনুমোদন পায় বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহ মাখদুম ম্যানেজমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়। ৩ জুন বরিশালের ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি এবং রাজধানারী মহাখালীতে কার্যক্রমের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটিকে।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর দেশে যখন একটি বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্তের উদ্ভব ঘটলো এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চ শিক্ষার বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে পারছিলো না তখনই বিদেশমুখী প্রবণতা রোধের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯২ সালে দেশে যাত্রা শুরু হয়েছিল শিক্ষার নতুন এক ধারা যার নাম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্বেও শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে, ব্যবসা ভালো হবে এ বিবেচনায় আরও ১২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন জমা পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মাত্র ১০টির ‘মান ভালো’। ১৬টির মান ‘মোটামুটি’, আর অনেকগুলোর মান ‘খুব খারাপ’ এমন চিত্রই উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক জরিপের তথ্যে। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কয়েক বছর সঠিক পথেই হাঁটছিলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যায় থেকে অল্প ও ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগে প্রচুর মুনাফা করার মানসিকতা নিয়ে ‘ব্যাঙের ছাতার মতো’ গজিয়ে উঠতে শুরু করে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা না ব্যবসা এ সমস্যার শুরুও তখন থেকেই। প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায় শিক্ষার অনুরাগ থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় খুব কমই হয়েছে। এত যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন, তা শিক্ষা বিস্তারের অনুপ্রেরণার জন্য নেওয়া হচ্ছে না। এর অনুপ্রেরণা হচ্ছে বাণিজ্যের। এটি বিপজ্জনক কথা। বাণিজ্যের সুযোগ রয়েছে বলেই ছাত্রসহ ক্যাম্পাস বিক্রি করতে পেরেছে তিনটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জমি না কিনে মালিক বা ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্যদের নামে জমি কিনছে। শিক্ষার সঙ্গে ব্যবসা যুক্ত হওয়ার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা মালিক বনে যান। আর তখন প্রাইভেট এর আভিধানিক অর্থ ‘বেসরকারী’ থেকে ‘ব্যক্তিগত’ রুপ নেয়।

অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, বাবা, মা, ভাই, বোন, শ্বশুর, শ্বাশুরী ট্রাস্টি বোর্ড থেকে শুরু করে নানা পদে অধিষ্ঠিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পারিবারিক লিমিটেড কোম্পানীতে! পরিণত করে ফেলেছেন। বাণিজ্যের দিকটি প্রবল হয়ে ওঠায় অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে ব্যাপক লুকোচুরি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে পরিচালকরা প্রতিমাসেই বেতনসহ নানা খরচ দেখিয়ে একেকজন হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। লক্ষ্য থাকছে না শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ, অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক হলেও এর সাথে সংশ্লিষ্টরা এগুলোকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। শিক্ষার মান উন্নয়ন করা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরিবর্তে অর্থ বাড়ানোতেই তাদের বেশি নজর থাকে। ভালো মানের কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের একটি বৈঠকে যোগ দেয়ার জন্য ট্রাস্টিরা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত সিটিং আ্যালাউন্স নিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। তবে এর বিপরীতে বিরল চিত্রও রয়েছে যা উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে, যেমন, চিটাগং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের কোন সদস্য সিটিং আ্যালাউন্স নেয়া দূরে থাক তাঁরা ভ্রমণ ভাতা পর্যন্তও নেন না।

যেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন ও জটিল কাজ সেখানে দেশের নানা প্রান্তে শতাধিক ‘মিনি বিশ্ববিদ্যালয়’ তথা আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনা করার পিছনে সার্টিফিকেট বাণিজ্য ছাড়া আর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪০টি পর্যন্ত আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনা করার তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও তাদের ক্যাম্পাস পরিচালিত হয়েছে। নতুন পাস হওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী আউটার ক্যাম্পাস ও দূরশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা ও এ বিষয়ে কোন ধরনের বিজ্ঞাপন বা প্রচারণা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকা সত্বেও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করে তাদের বানিজ্য ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। নানা সময়ে মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক গঠিত কমিটি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ও খুঁজে পেয়েছেন, যেখানে ছাত্র-শিক্ষক কাউকেই পাওয়া যায় নি। এরা শুধু সার্টিফিকেট বিক্রয় করতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সনদ বাণিজ্যের কারণে কিংবা এসব বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ায় তাদের মধ্যে কোনো কোনোটি দখল-পাল্টা দখলের কবলেও পড়েছে। এর পাশাপাশি মালিকানার দ্বন্দ্ব, উপাচার্য পদ নিয়ে মালিকদের রেষারেষি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মাদকের বেপরোয়া বিস্তার, নির্বিচারে সনদ বিক্রি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানিসহ নানা অবাঞ্ছিত কারণে কমপক্ষে তিন ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম হোঁচট খাচ্ছে বলে নানা সময় পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে।

যাত্রা শুরুর দীর্ঘ ২৫ বছর পরেও অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সওদাগরি মানসিকতার বলি হচ্ছে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীরা। ২০১৬ সনে টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংস সাপ্লিমেন্টে প্রকাশিত ডেভিড ম্যাথুসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের করুণ চিত্র ফুটে ওঠেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বের কোথাও যদি অরাজক, অনিয়ন্ত্রিত এবং শোষণমূলক বেসরকারি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা থেকে থাকে, তবে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার গবেষক ম্যাট হুসেইন সেটা খুঁজে পেয়েছেন। ম্যাট হুসেইন রাজধানী ঢাকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের ওপর ছয় সপ্তাহব্যাপি একটি গবেষণা চালিয়ে যে চিত্র দেখতে পেয়েছেন তা এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ম্যাট হুসেইনের গবেষণা নিবন্ধের শিরোনাম ‘জম্বি গ্র্যাজুয়েটস ড্রিভেন বাই রিকশা ফ্যাকাল্টি এ কোয়ালিটেটিভ কেস স্টাডি : প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ ইন বাংলাদেশ’। ম্যাট হুসেইন তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করেছেন ১০ জনের ৯ জনই স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে কাজ করেন। বয়সে তারা সাধারণত তরুণ। আপাতত উপার্জনের পথ খুঁজছেন এমন ব্যক্তিদেরই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের বেতন অতি সামান্য। যথেষ্ট রোজগারের জন্য তাদের এক ক্যাম্পাস থেকে আরেক ক্যাম্পাসে প্রতিদিনই ছুটতে হয়। রিকশা আরোহী এমন শিক্ষকদের ‘রিকশা ফ্যাকাল্টি’ অভিহিত করে তিনি বলেছেন, প্রতিটি ক্লাসে এত দ্রুত ছুটে যেতে হয় যে, সবসময় তারা নিজেদের ছাত্র-ছাত্রীদের নামও জানতে পারেন না। প্রভাষকরা ‘প্রায় যান্ত্রিক’ হয়ে পড়েন। তরুন এসব শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। হতে পারে সংখ্যায় প্রাইভেট বিশ্বদ্যিালয় বেশি হওয়ায় এবং যোগ্য শিক্ষকের যোগান কম হওয়ায় এমন অবস্থা। কিংবা অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এত কম বেতন দেয় যে, যোগ্যরা শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করতে চায় না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নবীন শিক্ষকের যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে ৫টি কোর্সে পাঠদান বাধ্যতামূলক করে দেন। তদুপরি কম বেতন দিয়ে মূলা ঝুলিয়ে দেয়া হয় ৫টি কোর্সের অতিরিক্ত পড়ালে তার জন্য কোর্স প্রতি ওপরি ইনকাম।

ফলে কোন কোন শিক্ষককে শিক্ষকতা জীবনের শুরুতেই ৭-৮টি কোর্সে পাঠদান করতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৭-৮টি কোর্স পড়ালে শিক্ষার যা হবার তাই হয়েছে। এত কোর্স পড়াতে হলে শিক্ষকের নিজের প্রস্তুতির সময় কোথায়? শিক্ষকের পদোন্নতি বোর্ডে এমনও দেখেছি, পদোন্নতির ইংরেজি আবেদনে একটি বাক্যও শুদ্ধ নেই। আরেক পদোন্নতি বোর্ডের অভিজ্ঞতা হলো প্রার্থী সাংধানিক আইন পড়ালেও সাংবিধানিক আইনের মৌলিক জ্ঞানও তার নেই। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নামীদামি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকার ১৮ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখা ছিলো: ‘Every year I am forgeted my birthday but my son, he is not forgeted. 19 October he give me. Birthday gift. Jear. Melaire brand watch. Feeling happiness.’ সকল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ইচ্ছা করেই অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ দেন না এটি পুরো সত্যি নয়। অনেক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ শিক্ষকের যথেষ্ট অপ্রতুলতাও রয়েছে। উদাহরণস্বরুপ, চট্টগ্রামে ৩/৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর মতো অভিজ্ঞ লোকবল না থাকলেও সরকার অনুমোদন দিয়েছেন ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে, প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে ধার করা এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ শিক্ষকের উপর নির্ভর করেই। (চলবে…)

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: zhossain@justice.com

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর