কঠিন বাস্তবতায় ৪১-এর বিএনপি

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-08-27 18:01:45

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি আজ চল্লিশ পেরিয়ে একচল্লিশে পা দিয়েছে। এই চল্লিশ বছরে বিএনপি এবারই সবচেয়ে বেশি কঠিন সময় পার করছে। দলটির চেয়ারপারসন নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারে একমাত্র বন্দী ও সিনিয়ির যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান দেশ ছাড়া। জিয়া পরিবারের আরেক পুত্র আরাফাত রহমান কোকো মারা গেছেন। রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনে খালেদা জিয়া তথা বিএনপির জন্য এতো কঠিন সময় আর আসেনি।

এদিকে রাজনীতির মাঠে বিএনপির দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচী  নেই। স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি এক অদৃশ্য রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে আছে। যারা কারাগারের বাইরে আছে তারা কোনো মতে ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশ-প্রশাসনের সাথে এক রকম বোঝাপড়া করেই আছে। রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নেয়াতো পরের কথা, মাঠে তাদের কোনো সরব উপস্থিতিও নেই। আর বাকিরা সব কারাগারে। বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী কারান্তরীণ। বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচী বলতে নয়াপল্টনের  কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রুল কবির রিজভীর সংবাদ সম্মেলন আর বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মীর্যা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য পেশ। এর সম্প্রতি যোগ হয়েছে কারাগারে খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে ফিরে আসা। কারণ, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে (কারাবিধি) কারাগারে যাওয়ার চেষ্টা নেই। হয়তো দেখা করা উদ্দেশ্যও না। সংবাদ শিরোনাম হওয়াই উদ্দেশ্য। এতেই রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল হলে দেখা করার আর দরকার কী? কারাফটকে সেলফি তোলাও এক ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচী।

এমনই এক বাস্তবতায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কোনো প্রস্তুতি এখনো দৃশ্যমান না। পর্দার অন্তরালে কোনো কোনো দলের সাথে জোট গঠনের কথা চাউর হচ্ছে বটে, তবে ভোটের মাঠে এই জোটের অংশীদারিত্বের বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। বিদ্যমান ২০ দলীয় জোটের সাথে এক ধরনের রাজনৈতিক ঐক্য থাকলেও আগামী নির্বাচনকে ঘিরে আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে স্বার্থের টানাপোড়েন হলে সে ঐক্য কতদূর যাবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এই ২০ দলীয় জোটের অধীনে কোনো দলই এখন পর্যন্ত কোনো জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এর বাইরে, ‘কামাল হোসেন-বদরুদ্দোজা চৌধুরী জোটের’ সাথে কার্যকর কোনো আলোচনা এখনো হয়নি। তবে কামাল হোসেন ও বদরুদ্দোজা বিএনপির সাথে ঐক্য গড়তে করতে চান এরকম একটি আদর্শিক অবস্থান তারা তুলে ধরেছেন। কিন্তু সেটিকে কার্যকর করার জন্য কোনো কার্যকর আলোচনা এখনো হয়নি।

এর বিপরীতে আওয়ামী লীগের অবস্থান যথেষ্ট শক্ত। তাদের জোটের মধ্যে তেমন টানাপোড়েন নেই। ১৪ দলীয় জোটকে বর্তমান জোটে থেকেই রাজনীতি ও নির্বাচন করতে হবে। এর সাথে হয়তো নতুন কেউ যোগ হলেও হতে পারে। এক্ষেত্রে কাদের সিদ্দিকীর বিষয়টি হয়তো আলোচনায় আছে।

সব মিলিয়ে রাজনীতির মাঠে বিএনপির আজ এক রকমের দেউলিয়া অবস্থাই বলতে হবে। তবে এ অবস্থা কতটা অর্জিত ও কতটা আরোপিত সে প্রশ্ন আছে। ক্ষমতাসীন দলের আমলে রাজনৈতিক কর্মসূচীতো পরের কথা কোনো সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাও প্রায় অসম্ভব। রাজনীতিতে বিরোধীদলের সভা-সমিতিকে এক রকম নিষিদ্ধই ঘোষণা করা হয়েছে। এমন একটা অবস্থায় বিএনপি রাজনীতিতে কতটা সক্রিয় হতে পারতো সে আলোচনা হতেই পারে। তবে, আমাদের দেশে কোনো আমলেই বিরোধী দলের জন্য রাজনীতির পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।

বাস্তবতা হচ্ছে, দুর্ভোগে পড়লে সবাই পরামর্শ দেয়। পারলে দুটি কটু কথাও শোনায়। এটি সহজাত। কিন্তু বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ না করে শুধু বিএনপিকে দোষারোপ করাও এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনা। বিএনপির সংস্কার রাজনীতির সংস্কার থেকে আলাদা করে দেখলে হবে না।

পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান। এ দায়িত্ব তিনি পেয়েছেন নাকি নিয়েছেন সেটি নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্কের অবকাশ আছে। তবে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে তখন এক চরম রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছিল। সেই সাথে রাষ্ট্রের সর্বোস্তরেই চলছিল সামরিকীকরণের এক মহাযজ্ঞ।  জিয়ার ক্ষমতায় আরোহণও ছিল সেই সামরিকীকরণেরই আরেক নমুনা, বলা যায় দেশে সামরিক শাসনের সূচনা। সেই সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতাতেই  পরবর্তীতে এরশাদ আরো নয় বছর তা হালনাগাদ করেন। সব সামরিক শাসকই ডকট্রিন অব নেসেসিটির দোহাই দেন। তারাও তাই করেছেন।

নিয়মমতো সামরিক পোশাক ছেড়ে জিয়া সাফারি ও গেঞ্জি পরার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যা সব সামরিক শাসকই করেন। ফলে, নিয়মমতো তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গঠন করেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল-জাগদল। একই বছর জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট নামে আরেকটি রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়। ১৯৭৮ সালে নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে তিনি জাতীয় ফ্রন্টের প্রার্থী জেনারেল ওসমানীকে হারিয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। নির্বাচিত হয়েই জিয়া ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

উন্নয়ন, উৎপাদন ও গণতন্ত্রই ছিল বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচীর মূল এজেন্ডা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রেখে বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার নীতিই ছিল এর লক্ষ্য। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি গণতন্ত্রের পথ থেকে অনেকটাই বিচ্যূত হয়েছে। তার খেসারতও দিয়েছে কম না। তবে তারপরও দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিএনপির ভূমিকা সমুজ্জ্বল। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির আত্মত্যাগ অস্বীকার করার উপায় নেই। জেল-জুলুম বিএনপির জন্য নতুন কিছু নয়। শুধু বিএনপি কেন, রাজনীতিকদের জন্য জেল খানার ফটক সব সময় খোলাই থাকে। জেল গেটে গ্রেফতার হয়ে জেলে যাওয়া আমাদের রাজনীতির এক প্রচলিত বিধি ব্যবস্থা। সব দলের জন্যই এটি সত্য। 

ক্ষমতায় থাকাকালে অথবা ক্ষমতার বাইরে থাকাকালেও বিএনপি তার সাংগঠিক সংস্কারের পথে পা বাড়ায়নি। এবং সরকারের দমন নীতিকে যতোই দায়ী করা হোক, বিএনপির আজকের রাজনৈতিক সংকটের বড় একটি কারণ এর দূর্বল সাংগঠনিক অবস্থা। ক্ষমতায় থাকলে একটি দল তার রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করতেই পারে। কারণ, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সবই সম্ভব। বিএনপিও তা করেছে। কিন্তু ক্ষমতার বাইরে থেকে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবার মনোবলই হচ্ছে একটি দলের মূল চালিকাশক্তি। এই মনোবল আসে রাজনৈতিক আদর্শ থেকে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা আজ সে আদর্শ থেকে বিচ্যূত। দলে আজ নানা স্বার্থান্বেসী মহলের আনাগোনা। এসব মহলের জনগণের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সামরিক বেসামরিক আমলায় ঠাসা একটি দলের সাথে জনগণের সাথে  দূরত্ব সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। কেন্দ্রে ও স্থানীয় পর্যায়ে একই অবস্থা।

দেশের রাজনীতিতে আজ পূঁজি ও লাভ-লোকসানের হিসাবটাই মূখ্য। বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কেউ এর বাইরে না। তবে পূঁজিবাদী এই চিন্তা বিএনপিতেই বেশি। তৃণমূল রাজনীতি থেকে উঠা আসা রাজনীতিকরা বিএনপিতে আজ বিলুপ্ত প্রায়। যারা আছেন, তারাও যাই-যাই করছেন। সেই সাথে গত এক দশকে ক্ষমতায় না থাকায় দলে কোনো সংস্কারও সম্ভব হয়নি। ক্ষমতায় না আসলে বিদ্যমান পরিস্থতিতে দলে কোনো আশু সংস্কার সম্ভবও না। কারণ, যতো বুড়োই হন না কেন, ক্ষমতা থেকে কেউ সরে যেতে চান না। আর স্থানীয় পর্যায়েও পুরনোরা নতুনদেরকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেন না। ফলে, এই অবস্থা চলতে থাকলে বিএনপির জন্য আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।

বিএনপির নি:সন্দেহে একটি রাজনৈতিক আদর্শ রয়েছে যা দেশের আপামর জনগণ গ্রহণ করেছে এবং শুধু যার ওপর ভিত্তি করেই একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে। ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি নির্বাচন বাদ দিলে দুটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু গদির গরমে অনেকেরই আদর্শ গলে যায়। বিএনপিরও তাই হয়েছিল। হাওয়া ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেশে দ্বৈতশাসন চালু করা হয়েছিল। সে দ্বৈত শাসন আজো চলছে। লন্ডন ও চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে পাশ না হলে কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় না। হালে যোগ হয়েছে কারাগার। কিন্তু এভাবে কি একটি রাজনৈতিক দল চলতে পারে? নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হলে বিএনপিকে নতুন করে ভাবতে হবে। আাগামী নির্বাচনে গদিতে আসতে না পারলে বিএনপির জন্য আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। সে কঠিন সময়ে পথ চলতে হলে তার রসদ এখনই জোগাড় করতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর