দেশের বেসরকারি খাতের এখন পর্যন্ত ৩২টি লাইফ (জীবন) বিমা কোম্পানি রয়েছে। তার মধ্যে ১৬টিতেই নেই মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। ফলে শীর্ষ এ পদটিতে কোন কোম্পানি ভারপ্রাপ্ত অথবা কোনো কোম্পানি চলতি দায়িত্ব দিয়ে পরিচালিত করছে। বিমা কোম্পানিগুলোতে এ অবস্থা চলছে সর্বনিন্ম ৬ মাস থেকে ৭ বছরর পর্যন্ত।
আরও মজার বিষয় হচ্ছে এসব কোম্পানির মধ্যে ২০১৩ সালে নিবন্ধন পাওয়া কোনো কোনো কোম্পানিতে এখনো মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দেয়া হয়নি। অথচ মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ সর্বোচ্চ ৬ মাস শূন্য থাকলে প্রশাসক নিয়োগের বিধানরাখা হয়েছে বীমা আইন ২০১০ এ। তবে মুখ্যনির্বাহীর পদে ৭ বছর শূন্য থাকার নজির থাকলেও প্রশাসক নিয়োগের কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিইওরাই হলো বিমা কোম্পানির চালিকাশক্তি। কোম্পানির সর্বোচ্চ এ পদশূন্য রাখা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে আইনের যে বিধান রয়েছে তা পরিপালন না করাও আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিমা খাতে শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের স্বার্থে কোনো কোম্পানি ৬ মাসের মধ্যে মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দিতে নাপারলে বিমা আইন অনুসারে তাদের বিরুদ্ধেব্যবস্থা নেয়া উচিত।
অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানির কার্যক্রম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও অনৈতিক সুবিধা হাতিয়ে নিতে নিজেদের পছন্দের লোককেই মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে চায় পরিচালনা পর্ষদ। তাই তারা নিজেদের পছন্দের লোকদের মধ্য থেকে মুখ্য নির্বাহী পদের যোগ্যতা সম্পন্ন লোক না পাওয়ায় অযোগ্য লোকদেরকে নানা কৌশলে চলতি দায়িত্ব দিয়ে কোম্পানি পরিচালনা করে। আর তাতে বছরের পর বছর বিমা দাবি নিয়ে কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে এজেন্ট ও গ্রাহকরা।
কোম্পানিগুলো হচ্ছে-আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বেস্ট, চার্টার্ড, গোল্ডেন, যমুনা, প্রটেক্টিভ ইসলামী, পদ্মা ইসলামী, ন্যাশনাল, এনআরবি গ্লোবাল, সানলাইফ, স্বদেশলাইফ, ট্রাস্ট ইসলামী, সোনালী, মার্কেন্টাইল ইসলামী, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং আস্থা লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
আইডিআরএ সূত্র মতে, প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে সিইওছাড়াই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেএনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকমোহাম্মদ আবু মুসা সিদ্দিকী বর্তমানে ভারপ্রাপ্তমুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে চলতি দায়িত্বপালন করছেন।
২০১৭ সালের ১১ মার্চ এনআরবি গ্লোবাল লাইফের মুখ্য নির্বাহী পদ থেকে অব্যহতি নেন অমল কান্তি দাস। এরপর থেকেই মুখ্য নির্বাহী শূন্য হয়ে পড়ে বেসরকারি এই লাইফ বিমা কোম্পানির। এরপর ২০১৮ সালের ১৯ মে তাকে ৩ বছরের জন্য সিইও নিয়োগে আইডিআরএ’র অনুমোদন চায় কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। তবে অদ্যবধি তিনি অনুমোদন পাননি।
এদিকে এনআরবি গ্লোবাল লাইফ কর্তৃপক্ষ মোহাম্মদ আবু মুসা সিদ্দিকীকে নিয়োগ দেয় দু’বছরের চুক্তিতে। চলতি বছরের জুনে সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও কোম্পানির ওয়েবসাইটে মোহাম্মদ আবু মুসা সিদ্দিকীকেই মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দেখাচ্ছে এনআরবি গ্লোবাল লাইফ কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে আবু মুসা সিদ্দিকী জানিয়েছেন, এনআরবি গ্লোবাল লাইফ আমাকে দু’বছরের চুক্তিতে নিয়োগ করেছিল। গত জুনে সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন আমি কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর দায়িত্বে নেই। তবে পরামর্শক হিসেবে এখনো প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আছি। নতুন মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।
২০১৩ সালের ৩০ জুলাই অনুমোদন লাভের পরথেকেই মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়া বিমা ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স। বর্তমানে কোম্পানিটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম জিয়াউল হক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল তিনি কোম্পানিটিতে যোগদান করে এই দায়িত্ব নেন।
এর আগে কোম্পানিটির ডিএমডি এমদাদ উল্লাহ মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যক্রম চালিয়ে নেন। আর ২০১৫ সাল থেকে মুখ্য নির্বাহীর চলতি দায়িত্বে ছিলেন শহিদুল ইসলাম। মুখ্য নির্বাহী নিয়োগের সব শর্ত পূরণ না করায় তিনি অনুমোদন পাননি।
২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে যোগদান করেন কামরুল হাসান। তবে কিছু দিন পর তিনি কোম্পানিটি থেকে পদত্যাগ করেন।
ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদ শূন্য হয়েছে চলতি বছরের মার্চে। এর আগে ২০১৭ সালের এপ্রিলে বিমা কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে অনুমোদন লাভ করেন মো. মাহফুজুল বারী চৌধুরী। চলতি বছরের মার্চে তার মেয়াদ শেষ হয়েছে।
বর্তমানে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। চলতি বছরের ২০ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন মজুমদার। এরপর থেকেই শূন্য রয়েছে বিমা কোম্পানিটির এই শীর্ষ পদ।
মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য চলতি দায়িত্বে রয়েছেন কোম্পানিটির ডিএমডি মোহাম্মদ সাইদুল আমিন। ২৭ জুলাই থেকে তাকে সিইও’র চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফের হেড অব এইচআর সালাহ উদ্দিন।
ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জামাল এম এ নাসের মৃত্যুবরণ করেন চলতি বছরের ২১ জুন। এরপর থেকেই শূন্য রয়েছে বিমা কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী পদ। বর্তমানে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কোম্পানিটির ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর (ডিএমডি) মোহাম্মদ কাজিম উদ্দিন।
আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদ শূন্য হয়েছে ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট। কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আপেল মাহমুদ চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রাইম ইসলামী লাইফে যোগদান করলে শূন্য হয়ে পড়ে সিইও পদ।
গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্বে রয়েছেন কোম্পানিটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এডি.এমডি) আমজাদ হোসেন খান চৌধুরী। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ শূন্য রয়েছে।
২০১৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মো. জাকির হোসেন পদত্যাগ করলে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শূন্য হয়ে পড়ে স্বদেশ লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এরপর কোম্পানিটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল মান্নানকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়।
এরপর কোম্পানির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. ইখতিয়ার উদ্দিন শাহিনকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়। আর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইখতিয়ার উদ্দিন শাহীনকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। পরবর্তীতে তাকে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিতে আইডিআরএ’র কাছে আবেদন জানায় স্বদেশ লাইফ।
সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সামছুল আলম পদত্যাগ করেন ২০২০ সালের ১৪ মার্চ। এরপর কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব পালন রফিক আহমেদ।
২০১৯ সালের ২ অক্টোবর পদত্যাগ করেন বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা একরামুল আমিন। এরপর থেকেই মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শূন্য হয়ে পড়েছে বিমা কোম্পানিটি। সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম শরিফুল ইসলামের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের ৩ জুন। এরপর থেকেই শূন্য পড়ে আছে বিমা কোম্পানিটির শীর্ষ এ পদ।
যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের ৭ এপ্রিল। এরপর থেকে মুখ্য নির্বাহী শূন্য হয়ে আছে বেসরকারি এ বিমা প্রতিষ্ঠান। পদ্মা ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মো. ওয়াসিউদ্দিন পদত্যাগ করেন ২০১৯ সালের ৩০ মে। এরপর থেকে মুখ্য নির্বাহী শূন্য রয়েছে বিমা কোম্পানিটি।
প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ডা. কিশোর বিশ্বাস। চলতি বছরের ২১ জুন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিমা কোম্পানিটির ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত চন্দ্র আইচের মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের জুনে। আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের নব প্রতিষ্ঠিত জীবন বিমা কোম্পানি আস্থা লাইফ ইন্স্যুরেন্স আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে চলতি বছরের ২৩ জুন। এছাড়াও নতুন এ কোম্পানিটিতেও এখন পর্যন্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্ত নিয়োগ দেয়া হয়নি।