স্থবিরতা কাটছে না বুড়িমারী স্থলবন্দরের, নেই অবকাঠামো

ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি

রেজাউল করিম মানিক, ডিস্ট্রিক করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 21:53:20

লালমনিরহাট: দেশের তৃতীয় বৃহত্তম ও সম্ভাবনাময় স্থলবন্দর বুড়িমারী। কিন্তু উত্তরের সীমান্ত জেলা লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরের স্থবিরতা কিছুতেই কাটছে না। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি না থাকায় ক্রমেই ঝিমিয়ে পড়ছে এ স্থলবন্দরটি। বন্দর চালুর পর থেকেই গড়ে উঠেনি তেমন কোনো অবকাঠামো, বন্দরের যাতায়াতকারী একমাত্র রাস্তাটি এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। এছাড়া গড়ে ওঠেনি উন্নতমানের আবাসিক হোটেল, মানি এক্সচেঞ্জ, ডে কোচ সার্ভিস। ফলে যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা রয়েছে চরম ভোগান্তিতে।

এতো কিছু সত্ত্বেও দেশের এই বৃহত্তম স্থলবন্দরটিতে বেড়েছে রাজস্ব আয়। এই বন্দরটির রাজস্ব কর্মকর্তা মোসফিকুর রহমান চৌধুরী জানান, এই বন্দর নিয়ে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ কোটি টাকা। রাজস্ব অর্জিত হয়েছে ৬৮ কোটি ৫৬ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮ কোটি বেশি। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯৪ কোটি ৪১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। গত ২ মাসে অর্জিত হয়েছে ৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, এ বন্দরে প্রতিদিন ভারত ও ভুটানের প্রায় ৪০০ ট্রাক বিভিন্ন প্রকার পণ্য নিয়ে প্রবেশ করে। এ বন্দর ব্যবহার করে প্রতিদিন প্রায় ৪শ পর্যটক। অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে এ বন্দরটি একটি রোল মডেল হিসেবে দাঁড় হতে পারে।

জানা গেছে, বিগত সরকারগুলোর আমলে এ বন্দরে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ১/১১ এর সরকারের সময় থেকে অধিকাংশ আমদানি, রফতানিকারক ও কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট মালিকরা নিজেদের গুটিয়ে নেন।
বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বন্দরের সামান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাটা কাটেনি। এ অবস্থা কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নামধারী কতিপয় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, আমদানি ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিকের কারণে এ বন্দরে একে অপরের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক পাল্টা অভিযোগ করে ব্যবসায়ীদের মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি করা হয়েছে।

এ কারণে অধিকাংশ আমদানি ও রফতানিকারক বুড়িমারী স্থলবন্দর ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। কেউ কেউ পেশা পরিবর্তন করেছেন। এরমধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন- বিএনপির সাবেক সাংসদ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়াডিং অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি হাসান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী হাসানুজ্জামান হাসানসহ অনেকেই। এছাড়া আমদানি ও রফতানিকারকদের মধ্যেও অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে বসে আছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক শ্রেণির আমদানিকারক, রফতানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ীর অনিয়ম, দুর্নীতি ও হয়রানিমূলক আচরণের কারণে বুড়িমারী স্থলবন্দর ছেড়ে অন্য স্থলবন্দর দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করছেন।

জানা গেছে, ১৯৮৮ সালের ২১ এপ্রিল ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের লক্ষ্যে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী সীমান্তে প্রথম পর্যায়ে শুল্ক স্টেশন ট্রানজিট রুটটি চালু করে তৎকালীন এরশাদ সরকার। ভুটানের ফুল সিলিং সীমান্ত হয়ে ভারতের চ্যাংরাবান্ধা দিয়ে বাংলাদেশের বুড়িমারীর জিরো পয়েন্টে শুল্ক স্টেশনটির ট্রানজিট রুট রয়েছে। এ রুট দিয়ে পরবর্তীতে ভুটানের সঙ্গে ব্যবসায়িক গণ্ডি পেরিয়ে ভারতের সঙ্গেও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ট্রানজিট চালু হয়।

এছাড়া নেপালের সঙ্গে ট্রানজিট রুট চালু হলেও এ বন্দর দিয়ে নেপাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো পণ্য আমদানি বা রফতানি হয়নি বলে বন্দর সূত্রে জানা গেছে। তবে নেপালের ৬০ জন শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়াশোনা করার কারণে এই রুটের ইমিগ্রেশন হয়ে চলাচল করে থাকেন।

বন্দর সূত্র জানায়, প্রতিবছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বন্দরটিতে সরকারি রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে। এদিকে সরাসরি বুড়িমারি কিংবা পাটগ্রাম থেকে ডে কোচ সার্ভিস না থাকায় পর্যটকরাও এ বন্দর দিয়ে যাতায়াতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। লালমনিরহাট বাসমালিক সমিতির বাধার কারণে ডে কোচ সার্ভিস চালু হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে জেলা শ্রমিকলীগের একাধিক নেতা।

কয়েকজন পর্যটক অভিযোগ করেন, লাগেজ বহনের নেই কোনো ট্রলি। অসুস্থ রোগীদের জন্য নেই কোনো হুইল চেয়ার। আসা-যাওয়ার পথে নেই কোনো যাত্রী ছাউনি। বৃষ্টি হলে ভিজেই যাতায়াত করতে হয়। নেই ভালো মানের আবাসিক হোটেল। উন্নত খাবারের রেস্টুরেন্ট নেই বললেই চলে। এ ব্যাপারে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

এদিকে বুড়িমারী জিরো পয়েন্ট থেকে পাটগ্রাম পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশে কয়েকশ পাথর ক্র্যাশিং মেশিনের বিকট শব্দ এবং পাথরের ধুলায় অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছে এই বন্দর এলাকা। পর্যটকরা এই বন্দরে ঢুকেই একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মুখোমুখি হয়ে পড়েন। এই পাথর ধুলা নাক-মুখ দিয়ে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করলে ভয়ানক সিলিকোসিস রোগ হতে পারে। তাই অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসন বার বার ব্যবসায়ীদের সতর্ক করেছেন।

এ ব্যাপারে পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল করীম জানান, পাথর ক্র্যাশিং ব্যবসায়ীদের মহাসড়ক এবং ক্র্যাশিং মেশিন এলাকায় পানি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দুই একদিন দেয়, তারপর আর তারা দেয় না। সবচেয়ে ভালো হয় এই এলাকায় একটি ক্র্যাশিং মেশিন জোন করতে পারলে। সেই চেষ্টাও চলছে। দেশের অপার সম্ভাবনাময় এ বন্দরকে গতিশীল করতে সব ধরনের উদ্যোগই নেওয়া হবে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন বাবুল জানান, বুড়িমারী স্থলবন্দরে সরকারের আরও বেশি সুদৃষ্টি দেওয়া উচিত। এতে সরকার যেমন জাতীয় রাজস্ব পাবে, তেমনি এর সুফল ভোগ করবে লালমনিরহাট।

এদিকে বুড়িমারি স্থলবন্দরে এখন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় কিছু চাঁদাবাজ ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মি এ স্থলবন্দর। সরকার দলীয় ক্যাডাররাও জিম্মি করে রেখেছে এই বন্দরটি। এ কারণে অনেক আমদানি-রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অনেকেই অন্য বন্দর দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। এ ব্যাপারে প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ চান সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, এ অবস্থা চলতে থাকলে বন্দরটির কার্যক্রম এক সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া ঢিমেতালে চলছে বন্দরের উন্নয়ন কাজ। ২০১০ সালে এ শুল্ক স্টেশনটিকে স্থলবন্দর ঘোষণা করা হলেও পূর্ণাঙ্গতা পায়নি এখনও। বরং স্থলবন্দর ঘোষণার পর থেকে পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে খরচ আরও বেড়েছে।

এ কারণে ব্যবসায়ীরা বন্দরটি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এটিও একটি প্রধান কারণ বলে নিশাত হোসেন নামের এক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ী দাবি করেন।

তার মতে, স্থলবন্দরটি দেশের অন্যান্য স্থলবন্দরের তুলনায় দ্বিতীয় সারির হওয়া সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে সে রকম কোনো সুযোগ সুবিধা না থাকায় ব্যবসায়ীরা বন্দরটি ব্যবহারে আগ্রহ হারাচ্ছে।ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বিবেচনা করে সরকারের তরফ থেকে বন্দরটির অগ্রগতির জন্য বিশেষভাবে ব্যবসায়ীদের সুযোগ সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি দাবি করেন।

এ ব্যাপারে বুড়িমারী স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী মুছা আলী জানান, এ স্থলবন্দর মূলত ভুটানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নিভর্রশীল। ভারত থেকেও কিছু কিছু পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে ভারতের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশের মার্কেটে কম দামে বিক্রি করতে হয়। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এ কারণে আগের তুলনায় আমদানি কমে গেছে।

এ ব্যাপারে বুড়িমারী স্থলবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার (এসি) এস এম খায়রুল বাশার জানান, বুড়িমারী স্থলবন্দরটি আমদানি ও রফতানিকারকদের জন্য ব্যাপক সম্ভাবনাময় একটি রুট। কিন্তু ব্যবসায়ীদের মধ্যে বন্দরটি সম্পর্কে তেমন বেশি ধারণা না থাকার কারণে ভাটা পড়েছে। তবে ভুটান থেকে আগের তুলনায় পণ্য আমদানি বেশি হলেও তা শুল্কমুক্ত হওয়ায় রাজস্ব আয় কমেছে।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সূত্র জানায়, বুড়িমারী স্থলবন্দরের অধিকাংশ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের প্রায় ১২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এ কারণে অধিকাংশ লাইসেন্সের কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। চূড়ান্তভাবে এসব লাইসেন্স বাতিল করে নতুন লাইসেন্স দেওয়া হলে বন্দরটির ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসবে। এছাড়া ১৯টির বেশি পণ্য আমদানি-রফতানির নিষেধাজ্ঞা থাকায় ঝিমিয়ে পড়েছে এ বন্দরটি।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ জানান, বুড়িমারি স্থলবন্দর একটি সম্ভাবনাময় বন্দর। ভৌগোলিকভাবে অন্যান্য স্থলবন্দর থেকে এটি সব ক্ষেত্রেই আলাদা। ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে সীমিত আকারের বাণিজ্য চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই বন্দর দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই বন্দরের অবকাঠামোর উন্নয়ন করা প্রয়োজন। সেই চেষ্টাও চলছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর