অর্থনীতির সূচকে সমন্বয়হীনতা: ডলারের বাজার ও প্রকৃত মূল্যে অস্বাভাবিক ব্যবধান

, অর্থনীতি

আসিফ শওকত কল্লোল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 13:03:39

ডলারের সঙ্গে টাকার বাজার দর ও প্রকৃত দরের মধ্যে ব্যবধান অস্বাভাবিক রূপ নিয়েছে। গত ৮ বছরে কখনো স্বাভাবিক পর্যায়ে নামেনি ডলারের দাম। এ নিয়ে অনুসন্ধান করেও কারণ খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বিষয়টি নিয়ে রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, অর্থনীতির সূচকগুলোতে কোথাও বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা আছে। যার কারণে ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এ জন্যই প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের সক্ষমতার বিষয়টি সুনিপুনভাবে শনাক্ত করার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও এই ব্যবধানের কারণে বাজারে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টাকার বিপরীতে ডলারের প্রকৃত মূল্য ছিল ১০০ টাকা ৭৮ পয়সা, কিন্তু বাজার মূল্য ছিল ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা। দুই মূল্যের ব্যবধান হচ্ছে ১৭ টাকা ৩ পয়সা। তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, এইব্যবধান সর্বোচ্চ ৫-৭ টাকা হতে পারে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এই ব্যবধান ছিল সর্বোচ্চ ৭ টাকা ৩১ পয়সা। এরপর থেকেএই ব্যবধান ওঠা নামা করছে।

জানা গেছে, বর্তমানে প্রতি ডলার ওভার ড্রাফট আকারে (রফতানি বিল) বিক্রি হচ্ছে ৮৩ টাকা ৭৫-৮৫ পয়সা দরে। নগদডলার বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা ৫০-৮০ পয়সা দরে। গ্রাহকদের কাছে বা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে ডলারের এই দামের সরাসরি ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে এই দর নির্ধারিত হয়। যাকে বলা হয়নমিনাল এক্সচেঞ্জ রেট বা নিয়ার। এর বাইরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জনে অর্থনীতির মূল তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ডলারের বিপরীতে টাকার আরো এক ধরনের বিনিময় হার প্রনয়ন করা হয়। একে বলা হয় ডলারের প্রকৃত মূল্যবা রিয়াল এক্সচেঞ্জ রেট বা রিয়ার। এ হিসাব নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক তৈরি করে, যা বিভিন্ন গবেষণায় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাজারে এর সরাসরি কোন প্রয়োগ নেই। যে কারণে গ্রাহকদের মধ্যে এই বিনিময় হারেরও কোনো প্রভাব নেই। তবে অর্থনীতিকে পরিচালিত করত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছ, অর্থনীতির সূচকগুলোর কোনো একটি পর্যায়ে সমন্বয়হীনতার কারণে এই খাতের ব্যবধান অস্বাভাবিক রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে রফতানি আয়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ, আমদানি ব্যয়,বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়, মূল্যস্ফীতির হারে সমন্বয়হীনতা আছে।

ডলারের বিপরীতে টাকার প্রকৃত বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হয় একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে। যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো, পণ্য আমদানি রফতানি বেশি, অর্থনীতির মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে এমন সব দেশের রপ্তানি,আমদানি, মূল্যস্ফীতি, পণ্যমূল্য, উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি তথ্য বিবেচনায় নিয়ে এই মূল্য বের করা হয়। এমন ১০টি দেশেরমুদ্রা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি বাস্কেট তৈরি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলার, যুক্তরাজ্যের পাউন্ডস্টারলিং, কানাডিয়ান ডলার, মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, ভারতের রুপি, চিনের ইউয়ান, জাপানের ইয়েন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউরো, কোরিয়ান ইয়েন ও শ্রীলংকার ডলার। এসব দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হচ্ছে। একারণে এগুলোর মুদ্রার সঙ্গে তুলনায় করে প্রকৃত বিনিময় হার বের করা হচ্ছে।

২০১৩ সালের জুলাই মাসে ডলারের প্রকৃত মূল্য ছিল ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা, বাজারমূল্য ছিল ৭৭ টাকা এবং ব্যবদান ছিল ১০টাকা ৯০ পয়সা। ২০১৪ সালের অক্টোবরে প্রকৃত মূল্য ৯৫ টাকা ১৪ পয়সা, বাজার মূল্য ৭৭ টাকা ৪০ পয়সা এবং ব্যবধান ছিল ১৭ টাকা ৭৪ পয়সা। ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকৃত মূল্য ছিল ১০৭ টাকা ৮৭ পয়সা, বাজার মূল্য ছিল ৭৭ টাকা ৮০ পয়সা এবং ব্যবধান ছিল ৩০ টাকা ৭ পয়সা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকৃত মূল্য ছিল ১৫০ টাকা ১ পয়সা, বাজার মূল্য ছিল ৭৮টাকা ৭০ পয়সা এবং ব্যবধান ছিল ৭১ টাকা ৩১ পয়সা। এটাই ছিল সর্বোচ্চ ব্যবধান। এরপর থেকে এই ব্যবধান কমে আসছে।তবে কমার মধ্যেও আবার বেড়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকৃত মূল্য ১০২ টাকা ৮৯ পয়সা, বাজার মূল্য ৮২ টাকা ৭০পয়সা এবং ব্যবধান ছিল ১৮ টাকা ১৯ পয়সা।

গত জুনে প্রকৃত মূল্যছিল ১০০ টাকা ৬৫ পয়সা, বাজার দর ছিল ৮৩ টাকা ৭০ পয়সা এবং ব্যবধান ছিল ১৬ টাকা ৯৫ পয়সা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অর্থনীতির সূচকগুলোর কোনো একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। যে কারণে এমনটি হচ্ছে। তবে এখন ব্যবধান অনেক কমে এসেছে। এটি আরো কমবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই ব্যবধান আগে ৬-৮ টাকার মধ্যে ছিল। তখন প্রকৃত দরের চেয়ে বাজার দরবেশি ছিল। কেননা এর মাধ্যমে বিশেষ করে রফতানিকারক ও প্রবাসীদের একটু বাড়তি সুবিধা দেয়া হতো। এখন রফতানি কারক ও প্রবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আমদানিকরা লাভবান হচ্ছে।

২০০২ সালের আগে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই প্রকৃত মূল্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। তখন প্রকৃত মূল্যের ওঠা নামার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান বাড়াতো বা কমাতো। ২০০২সালের ২ মে থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান বাজার ভিত্তিক করা হয়। তখন থেকে বাজারই টাকার মান নির্ধারণ করে আসছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর