সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমানোর সিদ্ধান্ত নির্দয় নিষ্ঠুরতা

, অর্থনীতি

আনিসুর বুলবুল | 2023-08-31 19:54:56

'বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের নিরাপদ বিনিয়োগের জায়গা হলো সঞ্চয়পত্র। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর সিদ্ধান্ত দেশের লাখ লাখ মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রবীণ, বিধবা, অবসরপ্রাপ্ত, ছোট চাকুরে পরিবারের প্রতি— মানুষের প্রতি নির্দয় নিষ্ঠুরতা ছাড়া কিছুই না।'

বলছিলেন মানিকগঞ্জের খানবাহাদুর আওলাদ হোসেন খান কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু। বার্তাটোয়েন্টিফোরকে তিনি বলেন, 'ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল, ওষুধের দাম সবই বাড়ছে অথচ প্রতিবছরই অর্থনীতির সুস্থতার নামে সঞ্চয়পত্রে লাভের অংশে খড়গ চালানো হচ্ছে।'

তিনি যোগ করেন, 'অথচ একবারও ভাবা হচ্ছে না এই সঞ্চয়পত্রের আয়ে বৃদ্ধ বয়সের ওষুধ, যে সন্তানটির লেখাপড়া এখনও শেষ হয়নি তার খরচ, বাড়ি ভাড়া, বর্ধিত বিদ্যুৎ বিল, ডাল-ভাতের বাড়তি খরচই মেটে না। সেখানে সঞ্চয়পত্রের লাভ কমিয়ে কমিয়ে এই লাখ লাখ পরিবারের কয়েক কোটি অসহায় মানুষকে বিপন্ন করে ফেলা হচ্ছে।'

সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভর করে যারা সংসার চালান, তাদের জন্য দুঃসংবাদই এটি। সরকার বাংলাদেশের পাঁচ ধরনের সঞ্চয়পত্র ও একটি বন্ডের মুনাফার হার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক রকম হার, ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক রকম হার এবং ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরেক রকম হার করা হয়েছে। তবে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হারে সরকার হাত দেয়নি।

সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, 'দেশের লাখ লাখ পরিবার তাদের জীবনের একমাত্র সম্বল ১৫-২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকে। এসব পরিবারের না আছে অন্য আয়ের উৎস, না পারে এই স্বল্প পূঁজিতে ব্যবসা করতে। কারণ একটা পান-বিড়ির দোকানের পজিশন নিতেও এখন পাঁচ, দশ লাখ টাকার সেলামি লাগে।'

যে পাঁচটি সঞ্চয়পত্র ও একটি বন্ডের মুনাফার হার কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো-পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র,ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক-মেয়াদি হিসাব এবং ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড।

সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু আরো বলেন, 'রাষ্ট্র কত খাতেইতো তো ভর্তুকি দেয়, প্রণোদনা দেয়, গাড়ি বাড়ি কেনার সুদমুক্ত ঋণ দেয়, বাবুর্চি, ড্রাইভার পালবার পয়সা দেয়। অথচ ১৫/২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মানুষদের দিকে ফিরেতো তাকায়ই না, উল্টো লভ্যাংশ কমিয়ে কমিয়ে রাস্তায় বসিয়ে দেবার অবস্থায় টেনে আনছে। এমন সিদ্ধান্ত স্রেফ নির্দয় নিষ্ঠুরতা।'

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) গত মঙ্গলবার এ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। মুনাফার হার নিয়ে আগের প্রজ্ঞাপনটি জারি হয়েছিল ছয় বছর আগে অর্থাৎ ২০১৫ সালের ২৩ মে। নতুন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যারা নতুন করে সঞ্চয়পত্র কিনবেন, শুধু তাদের জন্য পরিবর্তিত হার কার্যকর হবে। এছাড়া আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কেউ পুনর্বিনিয়োগ করলে তখন তার নতুন বিনিয়োগের অংশটুকুর ক্ষেত্রে নতুন মুনাফার হার কার্যকর হবে।

সরকারের এমন সিদ্ধান্তে সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রকৃত নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবন আরো নাস্তানাবুদ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগের বিকল্প কম। বয়স্ক অনেক মানুষ তাদের জীবনযাপনের ব্যয় সঞ্চয়পত্রের আয় থেকে করে থাকেন। অনেক অবসরপ্রাপ্ত ও বয়স্ক নাগরিক আছেন, যাদের দীর্ঘদিনের সঞ্চয় এর চেয়ে বেশি এবং তারা সঞ্চয়পত্রের আয় থেকেই চলেন। তাদের দৈনন্দিন খরচ নির্বাহ করা কঠিন হবে।

সঞ্চয়পত্রের গ্রাহক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা শামসউদ্দিন ইলিয়াস বার্তাটোয়েন্টিফোরকে বলেন, 'এখনো সঞ্চয়পত্র দেশের মানুষের নিরাপদ বিনিয়োগক্ষেত্র। বিশেষ করে আমাদের মতো অবসরভোগীদের। আমাদের আয় কমে যাবে। আমাদের দৈনন্দিন খরচ নির্বাহ করা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।'

মানিকগঞ্জ জজকোর্টের আইনজীবী মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জসিম বার্তাটোয়েন্টিফোরকে বলেন, 'আমাদের দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মানুষ সঞ্চয়পত্র অথবা ব্যাংকিং সেক্টরে ডিপোজিটের লভ্যাংশের ওপর নির্ভরশীল। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর ফলে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির বাজারে সাধারণ মানুষ এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণের ওপর মারাত্বক প্রভাব পড়বে। করোনাকালীন সময়ে দেশের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ বেকার হয়ে গেছে এবং তাদের একটি অংশও সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক ডিপোজিটের মুনাফার ওপর ভিত্তি করে টিকে আছে তাই সরকারের এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা উচিৎ।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'যেখানে পূর্ণাঙ্গ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেই, সর্বজনীন পেনশন নেই, সেখানে নিম্নমধ্যবিত্ত চাকরিজীবীর টিকে থাকার অবলম্বনই হলো সঞ্চয়পত্র। সেখানেও সুদহার কমে গেলে নির্ভরশীল মানুষের ওপর অভিঘাত আসবে। করোনায় এমনিতেই মানুষের আয় কমে গেছে। এক আঘাতের ওপর আরেক আঘাত পড়ল।'

এদিকে যমুনা ব্যাংকের এফএভিপি শামীম আহমেদ বার্তাটোয়েন্টিফোরকে বলেন, 'যেহেতু ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট কমানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের রেট বাড়ানো হলে ব্যাংকের ডিপোজিট কমে যাবে, বিনিয়োগ কমে যাবে। বিনিয়োগ কমে গেলে বেকারত্বের হার বেড়ে যাবে। যদিও অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার জীবনের শেষ সময়ে পেনশনের অর্থ বা জমানো অর্থ দিয়ে তাদের আয় কমে যাবে। তবে দেশের বৃহৎ স্বার্থে আমি মনে করি সঞ্চয়পত্র রেট কমানো যুক্তিসঙ্গত।'

পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। নতুন নিয়মে যাদের এই সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে মুনাফার হার হবে সাড়ে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।

তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১ দশমিক শূন্য চার শতাংশ। সেটি এখন ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কমিয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। আর এই সঞ্চয়পত্রে যাদের বিনিয়োগ ৩০ লাখ টাকার বেশি তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ৯ শতাংশ হারে।

অবসরভোগীদের জন্য নির্ধারিত পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে এতদিন ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যেত। এখন এই সঞ্চয়পত্রে যাদের বিনিয়োগ ১৫ লাখ টাকার বেশি তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে এই হার হবে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

পাঁচ বছর মেয়াদি এই সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। এখন এই সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার কমিয়ে করা হয়েছে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই হার ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ।

ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে তিন বছর মেয়াদি হিসাবে বর্তমানে মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। এখন ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার হবে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে হবে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।

এছাড়া ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের ক্ষেত্রে ২৪ মাস পর কিন্তু ৫ বছরের আগে ১১ দশমিক ২০ শতাংশ মুনাফা প্রযোজ্য। এ বন্ডে বিনিয়োগ ১৫ লাখ টাকার বেশি হলে মুনাফা ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ, ৩০ লাখ টাকার বেশি হলে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ৫০ লাখ টাকার বেশি হলে ৮ দশমিক ৪০ শতাংশে নেমে আসবে।

এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, 'সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর ক্ষেত্রে প্রান্তিক বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনা করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার তুলনামূলকভাবে বেশি থাকায় এর হার কমানো হয়েছে। এর মুনাফার হার বেশি হওয়ায় অর্থনীতির অন্য চালিকাশক্তিগুলো সমস্যায় পড়ছিল। মুনাফার হার কমানোর ফলে সার্বিক অর্থনীতির সুদের হারে একটি ভারসাম্য আসবে।'

তিনি আরও বলেন, 'সঞ্চয়পত্রের যে মুনাফার হার দেওয়া হয়েছে তাতে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এক কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে।'

সুদের হার কমানোর ফলে সরকারের ব্যয় সাশ্রয় হবে কত? এমন প্রশ্নের জবাবে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো জবাব দেননি অর্থমন্ত্রী। তবে তিনি বলেন, 'প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থ দেখা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় হার বাড়ানো বা কমানো একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা কখনো বাড়বে, কখনো কমবে। প্রয়োজনে আবার বাড়তেও পারে।'

এ সম্পর্কিত আরও খবর