অনিয়ম-দুর্নীতি, ব্যর্থতার পরও শীর্ষ পদে আতাউর রহমান প্রধান!

ব্যাংক বীমা, অর্থনীতি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 21:02:42

আতাউর রহমান প্রধান। ৩৭ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে বর্তমানে তিনি সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে ঋণ পাইয়ে দেওয়া, অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এরপরও প্রভাবশালীদের ধরে ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ পদে রয়েছেন আতাউর রহমান।

আতাউর রহমান প্রধান তিন বছর সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন। তার সময়ে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতি আর পরিচালন ব্যর্থতায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি। আগামী ১৬ আগস্ট বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের মালিকানার একমাত্র ব্যাংকটি বন্ধ হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ থাকার পরও একজন ব্যক্তিকে কিভাবে পদন্নোতি দিয়ে শীর্ষ পদে রাখা হয় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট মহল। তারা বলছেন, দেশের আর্থিক খাতের প্রভাবশালী একটি অংশের আশীর্বাদে আতাউর রহমান প্রধান তিরস্কৃত হওয়ার পরিবর্তে পুরস্কৃত হয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রের ক্ষতি করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন।

আতাউর রহমান ও সোনালী ব্যাংক ইউকে নিয়ে সোমবার  একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক বণিক বার্তা। প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকটির ২০১২ সালের মার্চ থেকে ২০১৫ সালের মে পর্যন্ত শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন আতাউর রহমান প্রধান। ওই সময় একের পর এক দুর্ঘটনা ও আর্থিক অপরাধ সংঘটিত হয় ব্যাংকটিতে।

জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২ জুন ব্যাংকটির ওল্ডহ্যাম শাখা থেকে সুইফট কোড জালিয়াতির মাধ্যমে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার হাতিয়ে নেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর শাখাটি বন্ধ করে দেয় ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। ২০১৭ সাল থেকে চালু আছে শুধু লন্ডন ও বার্মিংহাম শাখা। ২০১০ সালের ২০ আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের ২১ জুলাই সময়ে অর্থ পাচার প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডকে ৩২ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড জরিমানা করে যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি (এফসিএ)। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩৫ কোটি টাকারও বেশি। বন্ধ করে দেয় নতুন হিসাব খোলা। শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্বে অবহেলা, সুপারভাইজরি ঘাটতি ও অন্যান্য কারণে ৭৬ হাজার ৪০০ পাউন্ড জরিমানার মুখে পড়েন আতাউর রহমান প্রধানও।

এছাড়া সোনালী ব্যাংক ইউকের মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ বিভাগের প্রধান স্টিভেন স্মিথকে এ ধরনের চাকরিতে নিষিদ্ধ ও ১৮ হাজার পাউন্ড জরিমানা করা হয়। জরিমানার ৩২ লাখ পাউন্ড অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগার থেকেই পরিশোধ করতে হয়।

যুক্তরাজ্যের এফসিএ কর্তৃক জরিমানার মুখে পড়ার বিষয়টি প্রায় ২ বছর পর ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রকাশ করা হয়। তবে এত ঘটলেও ২০১৯ সালে আতাউর রহমান প্রধান পদোন্নতি পেয়ে রূপালী ব্যাংক থেকে সোনালী ব্যাংকের এমডি হয়েছেন। বিনিময়ে তিনি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রায়ত্ত এ দুটি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রজ্ঞাপন অনুসারে, কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক ব্যাংক কর্মকর্তা শাস্তিপ্রাপ্ত হলে তিনি শীর্ষ নির্বাহী হতে পারবেন না। এই বিধি সত্ত্বেও আতাউর রহমান প্রধান কীভাবে রূপালী ও সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী হলেন সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাজ্যের ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আতাউর রহমান প্রধান আপিল করেছেন। আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ায় তাকে এমডি পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই আতাউর রহমান প্রধান দুটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর পদে মেয়াদ শেষ করতে চলেছেন।

আতাউর রহমান প্রধানকে শাস্তি না দিয়ে পদোন্নতি দেওয়াকে দুর্নীতিবাজ পুরস্কৃত করা হয়েছে বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি)।  সংস্থাটি মনে করে, দুর্নীতিবাজকে শাস্তি না দিয়ে পদোন্নতি দেওয়া দুর্নীতি উৎসাহ দেওয়ার সমান। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড কর্তৃক সোনালী ব্যাংক ইউকে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের বিষয়ে বহির্বিশ্বে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবে।

বাংলাদেশ সরকার ও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের জোগান দেয়া মূলধনে প্রতিষ্ঠিত হয় সোনালী ব্যাংক ইউকে। এর মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মালিকানা রয়েছে ৫১ শতাংশ। বাকি ৪৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক সোনালী ব্যাংক লিমিটেড। ২০০১ সালে পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক হিসেবে যুক্তরাজ্যে কার্যক্রম শুরু করে ব্যাংকটি। প্রতিষ্ঠার পর কয়েক দফায় দেশ থেকে মূলধন জোগান দেয়ায় এখন সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডের মূলধনের পরিমাণ ৬ কোটি ৩৮ লাখ পাউন্ড। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৬ কোটি ডলার ঋণও দেয়া হয়।

যদিও শেষ পর্যন্ত বন্ধ করা হচ্ছে বিদেশের মাটিতে একমাত্র বাংলাদেশি মালিকানার ব্যাংকটি। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রুডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটি (পিআরএ) এবং ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটির (এফসিএ) সিদ্ধান্তে বন্ধ হচ্ছে সোনালী ব্যাংক ইউকে। গত ২৭ জানুয়ারি বিষয়টি সোনালী ব্যাংক ইউকে-কে জানিয়েও দেয়া হয়েছে।  

তবে যুক্তরাজ্যে অবস্থিত ব্যাংকটিকে বাঁচাতে তত্পর হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এজন্য সোনালী ব্যাংক ইউকের পরিবর্তে যুক্তরাজ্যে দুটি অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। মোট চারটি প্রস্তাব দিয়ে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠাচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

এ সব বিষয়ে আতাউর রহমান প্রধানের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে নিষেধাজ্ঞা আছে বলে জানিয়েছেন। কারণ তিনি তার বিরুদ্ধে এফসিএর জরিমানা করার বিষয়টি নিয়ে আপিল করেছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর