টানা নয় দিনের আন্দোলনের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে চা শিল্প। চা বাগানগুলোতে চা নারী পুরুষ চা শ্রমিকদের প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা আর নেই। সেখানে এখন চলছে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ। ৩শ’ টাকা মজুরি দাবিতে শ্রমিকরা টানা ৯ দিন ধরে কর্মবিরতি পালন করে আসছে। আর এতে করে দেশের অন্যতম আর্থিক শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে।
সরেজমিন শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগান, জেরিন চা বাগান, জঙ্গলবাড়ি চা বাগান, হুসেনাবাদ চা বাগানের কারখানাগুলো ঘুরে দেখা গেছে- কর্মমুখর চা কারখানাগুলোতে এখন সুনসান নিরবতা বিরাজ করছে। শ্রমিক কাজে না যাওয়ায় প্লাকিং করা সম্ভব হয়নি। কচি চা পাতাগুলি আজ বেড়ে ১৮ থেকে ২০ ইঞ্চি বড় হয়ে নষ্ট হচ্ছে। ভরা মৌসুমে প্লাকিং করার অভাবে বাগানে এক পাতার উপর অন্য পাতা গজিঁয়ে উঠার কারণে নষ্ট হচ্ছে নতুন কুঁড়ি। অনেক সবুজ পাতা-কুঁড়ি বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ টাকার চা পাতা।
চা সংসদের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, দেশের চায়ের মোট আর্থিক বাজার প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির এক ভাগ। আর মোট উৎপাদিত চায়ের ৯০ ভাগ যোগান আসে শ্রীমঙ্গল তথা সিলেট অঞ্চল থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, টানা এই কর্মবিরতির কারণে শুধু সিলেট ও চট্টগ্রামে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে প্রায় ২০ কোটি টাকার চা পাতা।
আন্দোলনরত চা শ্রমিকরা বলেছেন, বর্তমান বাজারে ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে চলা যায় না। তারা ৩শ’ টাকা মজুরি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে রোববারও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। এর মধ্যে শ্রীমঙ্গলের কেজুরিছড়া চা বাগানে বড় ধরণের বিক্ষোভ সমাবেশ করেন চা শ্রমিকরা। তারা ১৪৫ টাকা মজুরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এসময় সাধারণ শ্রমিকরা এ সিদ্ধান্তে সম্মত হওয়ায় শ্রমিক নেতৃবৃন্দের কঠোর সমালোচনা করে তাদের মালিক পক্ষের ‘দালাল’ হিসেবে আখ্যা দেয়। এরপর থেকে শ্রমিকরা আন্দোলনে ফিরে গেলে শ্রমিক নেতৃবৃন্দ সুর বদলিয়ে ফের ৩শ’ টাকার মজুরি দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেন।
শ্রীমঙ্গলে এক বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার চানপুর চা বাগানের শ্রমিক বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সংগঠনের সভাপতি খায়রুন আক্তার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ১০-১২ দিন হলে আমারা ৩শ’ টাকা মজুরি বৃদ্ধিও আন্দোলন করছি। আমাদেও চেহারার দিকে চেয়ে দেখুন-সাধে তো ঘর থেকে এতদূর আসিনি। তিনি বলেন, শনিবার নেতারা সমঝোতা করে ১৪৫ টাকায় রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু আমরা তা মানিনা। শ্রমিক নেতাদের ‘দালাল’ অবিহিত করে এই নারী নেত্রী বলেন, ১৪৫ টাকা মজুরির প্রস্তাব মেনে নেয়ার আগে সাধারণ শ্রমিকদের সাথে কোন আলোচনা করেনি। আমরা শুধু এই সিদ্ধন্তই না প্রয়োজনে ওইসব শ্রমিক নেতাদেরও প্রত্যাখ্যান করবো।
গত শনিবার (১৯ আগস্ট) শ্রীমঙ্গলস্থ বিভাগীয় শ্রম দপ্তরে এক বৈঠকে সরকারের হস্তক্ষেপে বাগান মালিক পক্ষে ১২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করে দেয়া হয়। দফায় দফায় বৈঠক শেষে শ্রমিক নেতৃবৃন্দরা ১শ’৪৫ টাকার প্রস্তাব মেনে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। রোববার থেকে কাজে যোগ দেয়ারও ঘোষণা দেন শ্রমিক নেতারা। ১শ’ ৪৫ টাকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আবারো আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা। ‘৩শ’ টাকার স্থলে ১শ’৪৫ টাকায় সমঝোতা ও শ্রমিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ মেনে নিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের’ ঘোষণা জানজানি হলে মাঠ পর্যায়ের সাধারণ চা শ্রমিকদের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
শ্রীমঙ্গলের জঙ্গলবাড়ি চা বাগানের ব্যবস্থাপক মাহবুব আলম মিজবাহ বলেন, চলতি বছর ৩শ’ ২ হেক্টর আয়তনের এ বাগানে চা উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ লাখ কেজি, কিন্তু চা শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যহত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে লক্ষমাত্র অর্জন করা কোন ভাবেই সম্ভব হবে না।
মহসিন টি হোল্ডিং (শ্রী গোবিন্দ্রপুর চা বাগান) এর মালিক শ্রীমঙ্গল পৌর মেয়র মহসিন মিয়া মধু বলেন, চা শ্রমিকদের টানা কর্ম বিরতির কারণে চা শিল্পের ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন আরও বাড়বে। চা শ্রমিকদের দাবি তাদের মজুরি কম- এমন এক প্রশ্নের জবাব বলেন, ১ শ’ ২০ টাকা নয়। একজন শ্রমিক আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা, প্লাকিং বোনাস, অসুস্থজনিত ছুটি, উৎসব ছুটি, ভবিষ্যৎ তহবিলে চাঁদা, উৎসব ভাতা, ভর্তুকি মুল্যে রেশন, অবসর ভাতা ইত্যাদি মিলে একজন চা শ্রমিকের গড়ে সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ ২ টাকা পান। শ্রমিক মজুরি ও অন্যান্য খরচ নির্বাহ করে মুনাফা করা এখন কষ্টকর হয়ে পড়েছে।