বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাসের দামও বাড়াতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে সরকার। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিলম্বিত করলে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে দিতে চায় মন্ত্রণালয়।
নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত হলেও, বিদ্যুতের বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাম বৃদ্ধির আবেদনের উপর গত ৮ জানুয়ারি শুনানি নিয়েছে বিইআরসি। দ্রুত সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত দিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। বিদ্যুৎ বিভাগ বিলিং মাস জানুয়ারি থেকেই নতুন দর কার্যকর করতে চায়। আরইবিসহ কোন কোন সংস্থা ১০ জানুয়ারি মধ্যেই বিল তৈরির কাজ শুরু করে। সে সব গ্রাহকের বিল আদায়ে সমস্যা হতে পারে। যে কারণে ১৫ জানুয়ারির পূর্বেই দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শেষ করতে তোড়জোড় চলছে। ফেব্রুয়ারির বিলের সঙ্গে জানুয়ারির বর্ধিত বিল আদায় করতে গেলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ কারণে ১৫ জানুয়ারির আগেই আদেশ দিয়ে বিল আদায়ের জটিলতা এড়তে চায় সরকার।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) নিয়ন্ত্রক (অর্থ ও হিসাব) হোসেন পাটোয়ারী বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, গ্রাহকের শ্রেণিভেদে বিলিং সময়ে ভিন্নতা রয়েছে। মোট গ্রাহকের ৯১ শতাংশ আবাসিক, বিপুল সংখ্যাক গ্রাহকদের বিলের ব্যবস্থাপনার জন্য মাসের ৬ থেকেই রিডিং গ্রহণ এবং বিল প্রদান শুরু করে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত চলমান থাকে। মাসের মাঝামাঝি সময়ে দাম বাড়লে সমস্যা নেই, পরের মাসে বিলের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
তিনি বলেন, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ এবং অফগ্রিড এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে গিয়ে আরইবির ব্যয় বেড়ে গেছে। পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগেই ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫২৪ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে লোকসান হবে ১১২৭ কোটি টাকা। পাইকারি বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় ডিসেম্বর মাস থেকে বাড়তি বিল দিতে হবে। এ খাতে বছরে ৪৭৪০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে যাবে।
বিইআরসি সূত্র জানিয়েছে, তাদের দিক থেকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার কোনই সুযোগ নেই। আইন অনুযায়ী শুনানির পর সম্পূরক প্রস্তাব (যদি থাকে) দেওয়ার জন্য ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। ওই তারিখের পর ছাড়া সিদ্ধান্ত দিতে চায় না বিইআরসি। তবে মাসের মাঝামাঝি কিংবা শেষার্ধে হলেও বিলিং মাস জানুয়ারিই থাকছে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
বিইআরসি গত ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১৯.৯২ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি ইউনিট ৫.১৭ টাকা বাড়িয়ে ৬.২০ টাকা নির্ধারণ করেছে। তারপরেই বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবেদন জমা দেয়। শুনানিতে বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি গড় ১৫.৪৩ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। বেশি ডিপিডিসির ১৬.৭১ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম আরইবির ১৪.৭৪ শতাংশ দাম বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৫.৭৭ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। এবার ১০ থেকে ১৪ শতাংশ দাম বাড়ানোর জোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে গত জুনে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের (এলএনজি) দাম বৃদ্ধির ধোয়া তুলে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ দাম বাড়িয়ে দেয় বিইআরসি। সার উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ২৫৯ শতাংশ, শিল্পে ১১.৯৬ শতাংশ, বিদ্যুতে ১২ শতাংশ, ক্যাপটিভে ১৫.৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। আবাসিকে একচুলার দর ৯৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৮০ টাকা করা হয়। প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের ইউনিট প্রতি দর ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা, সার উৎপাদনে ঘনমিটার ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়।
ওই দাম বাড়ানোর কিছুদিন পরেই স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার। এলএনজি আমদানি কমিয়ে দিলে বেড়ে যায় গ্যাস সংকট, এতে শিল্প মালিকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তারা উৎপাদন অব্যাহত রাখতে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস চান। মন্ত্রালয়ের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে তার দাম বাড়িয়ে হলে নিবচ্ছিন্ন গ্যাসের দাবি করেন। সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই গ্যাসের দাম বাড়াতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। গ্যাসের দাম বাড়ানো সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পেট্রোবাংলা ঘুরে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর খবর পাওয়া গেছে। যে কোন দিন ঘোষণা আসতে পারে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ব্যবসায়ীরা নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস চান। তারা আন্তর্জাতিক বাজার দরে বিল দিতে আগ্রহে দেখিয়েছে। সরকারের তাদের প্রস্তাবের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে। গ্যাস সরবরাহে শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ২০২৫ সালে শিল্পে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ আবু ফারুক বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, পোস্ট সাবমিশনের জন্য ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। তারপর সিদ্ধান্ত দিতে চাই।
অন্যদিকে ৮ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির শুনানি শেষে বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেছিলেন, আমাদের কমিশনের (বর্তমান) মেয়াদ রয়েছে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত। তার মধ্যেই বিদ্যুতের দামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে চাই। সবাইকে খুশি করা কঠিন, তবে ভোক্তাও যাতে ক্ষুব্ধ না হয়, আবার বিতরণ কোম্পানিগুলো যাতে চলতে পারে সেভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।
তিনি দাবি করেছিলেন এখন পর্যন্ত বিইআরসির আদেশে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি, হয়তো মুনাফা কিছুটা কমেছে। কমিশনের দেওয়া আদেশে এখনও কেউ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। তারা মেনে নিয়েছে আদেশ।