‘রেডি ফ্ল্যাট’ শোনা মাত্রই মনে হয়, বসবাসের জন্য সব সুবিধা রয়েছে যেখানে। কিন্তু ঢাকার মত জনবহুল শহরে স্বল্প আয়ের মানুষের বসবাস উপযোগী বাসস্থান এক প্রকার স্বপ্নই বলা যায়। সেইসাথে, মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত যোগ হয়েছে আবাসন শিল্পের নির্মাণ সামগ্রীর আকাশ ছোঁয়া দাম। নির্মাণের অন্যতম প্রধান উপকরণ রড।
২০২২ এর জানুয়ারিতে প্রতিটন রড এর দাম ছিল ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা, যা বছরের মাঝামাঝিতে এসে দাঁড়িয়েছে ৮৫ থেকে ৮৯ হাজার টাকায়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ দাম আরেক দফা দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ থেকে ৯১ হাজার টাকা। রডের মত একইভাবে বেড়েছে ইট, সিমেন্ট ও বালি সহ অন্যান্য নির্মাণ উপকরণের দাম।
এর ফলে, নির্মাণ খরচ বাবদ নতুন নির্মিত ফ্ল্যাটগুলোর মূল্য বর্তমানে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। রিহ্যাবের তথ্য অনুসারে, গত ১৭ বছরে ফ্ল্যাট এর দাম বেড়েছে সাত গুণেরও বেশি। ২০০৫ সালে একটি মানসম্মত ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের মূল্য ছিল মাত্র ৪০০০ টাকা। বর্তমানে সেই একই ফ্ল্যাটের জন্য বর্গফুট প্রতি বিক্রেতাদের গুণতে হচ্ছে ২৫০০০-৩০০০০ টাকা।
২০২১ সালে লালমাটিয়ায় যে ফ্ল্যাটের দাম প্রতি বর্গফুট ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা ছিল, ২০২২-এ তা বেড়ে হয়েছে ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা। ২০২১ সালে ধানমন্ডিতে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের গড় দাম ছিল ১৮ হাজার টাকা। যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২০ হাজার টাকা বা তারও বেশি দামে। এমনকি মিরপুরেও যে ফ্ল্যাট প্রতি বর্গফুট ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে, মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে তা এখন ৬ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে ।
সদ্য সমাপ্ত আবাসন মেলা ২০২২ এ কথা হচ্ছিলো আদনান রহমান এর সাথে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে ‘ভাড়া বাসায় থাকছি গত ১৫ বছর ধরে। এই সময় এসে চিন্তা করছি ভাড়া বাসায় না থেকে নিজেদের একটি ফ্ল্যাট কেনার। মেলায় এসে ঘুরে দেখছি ৮০ লাখ টাকার মধ্যে আফতাবনগরে কোন রেডি ফ্ল্যাট পাওয়া যায় কিনা। আমরা রেডি ফ্ল্যাট ছাড়া নেব না।
রেডি ফ্ল্যাটই কেন কিনবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্মাণ কোম্পানিগুলোর উপরে কোন আস্থা নেই আমাদের । তাছাড়া ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে অনেকদিন সময় নেয় আবার ঠিক সময়ে ফ্ল্যাট না বুঝিয়ে দিলে ব্যাংক লোনের সাথে সাথে বাসা ভাড়াও গুণতে হয় , যা আমাদের জন্য বাড়তি বোঝা।
আদনান রহমান এর মত, আরও অনেকে বাজেট এবং বাড়তি ঝামেলা এড়াতে রেডি ফ্ল্যাট অর্থ্যাৎ ব্যবহৃত ফ্ল্যাটের দিকে ঝুঁকছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রিয়েল এস্টেট সেবা প্রদানকারী কোম্পানি বিপ্রপার্টি এর তথ্যমতে, গত বছর প্রথম তিন মাসে সেকেন্ডারি মার্কেটে ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে ১২০০ থেকে ১৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি, ২৭.২৩ শতাংশ। এরপরই রয়েছে ১০০০ থেকে ১২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, যার চাহিদা ছিল ২১.৫০ শতাংশ। ৮০০ থেকে ১০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের খোঁজ করেছেন ১৬.৭৯ শতাংশ ক্রেতা।
তবে চলতি বছরে, ৮০০ বর্গফুট বা তার চেয়ে ছোট ফ্ল্যাটের চাহিদা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। গত বছর যেখানে এ ধরনের ফ্ল্যাটের চাহিদা ছিল ১৩.৮৪ শতাংশ, এ বছর তা ১৪.৫৫ শতাংশ।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য আরও বলছে, এলাকাভিত্তিক চাহিদার ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি মিরপুরে, ২৪ শতাংশ। এরপর রয়েছে উত্তরা (১৮ শতাংশ), ধানমন্ডি (১৭ শতাংশ), বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা (১৪ শতাংশ), ও মোহাম্মদপুর (১১ শতাংশ)।
সেকেন্ডারি মার্কেটের সম্ভাবনা নিয়ে কথা হচ্ছিলো প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং) মাহ্জাবীন চৌধুরীর সাথে । তিনি বলেন, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে রেডিমেড ফ্ল্যাটের চাহিদা বেশি। বাজেটের মধ্যে চাহিদা অনুযায়ী ফ্ল্যাট কিনতে তারা আগ্রহী হচ্ছেন ছোট ও মাঝারি রেডি ফ্ল্যাটগুলোতে, কারণ এই ফ্ল্যাটের মূল্য যেকোনো নতুন ফ্ল্যাটের তুলনায় বেশ কম। ফলে আবাসন খাতে সেকেন্ডারি মার্কেট দিনে দিনে হয়ে উঠছে আরও বেশি সম্ভাবনাময়।
রেডি ফ্ল্যাটের চাহিদা বৃদ্ধির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, রেজিস্ট্রেশন ফি এর খরচ কমে যাওয়া। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, প্রপার্টি কেনার সময় প্রপার্টির রেজিস্ট্রেশন খরচ ১৪% থেকে কমে তা বর্তমানে ১০% -এ এসে থেমেছে। যার ফলে ক্রেতাদের জন্য রেডি ফ্ল্যাট কেনা আরও বেশী সাশ্রয়ী হয়েছে। এছাড়া, সেকেন্ডারি বা রেডি প্রপার্টির ক্ষেত্রে হোম লোন পেতে আবেদনকারীকে খুব একটা ধকল পোহাতে হয় না। ফলে, রেডি ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহজ হোমলোন প্রক্রিয়াও আরও বেশি সম্ভাবনাময় করে তুলেছে এই খাতটিকে।