ভিক্ষুকের ঝুলিতেও বিদ্যুতের তোপ

, অর্থনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 20:39:53

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় কৃষি সেচ এবং হতদরিদ্র গ্রাহকদের বিশেষ ছাড় দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। তুলনামূলক ধনিক শ্রেণির ভোক্তাদের দাম বাড়িয়ে ঘাটতি মেটানো হতো, এখন আর কিছুই মানা হচ্ছে না।

এখন আর গবীর-ধনী, ক্ষুদ্র শিল্প, বৃহৎ শিল্প, রাস্তার পান দোকান কিছুই মানা হচ্ছে না। সবকিছু মিলিয়ে একাকার করে ফেলা হচ্ছে নির্বাহী আদেশে। এতে সামাজিক অস্থিরতার শঙ্কা করছেন জ্বালানি সংশ্লিষ্টরা।

হতদরিদ্র গ্রাহকদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য লাইফ লাইন শ্রেণি করা হয়েছিল। যাদের বসতি মূলত এক কক্ষ বিশিষ্ট। সীমিত সময়ের জন্য একটি বাল্ব ও একটি ফ্যান ব্যবহার করে এমন গ্রাহকরা এই সুবিধা পেতেন। সাধারণ শ্রমিক শ্রেণির লোকজন সারাদিন কাজ শেষে রাতে বাসায় ফিরে ফ্যান ছেড়ে ঘুমাতে যান। তাদেরকে সাশ্রয়ী দরে বিদ্যুৎ দিতে লাইফ লাইন গ্রাহক শ্রেণি করা হয়।

সেই লাইফ লাইনে ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ বিল ছিল ৩.৭৫ টাকা। সেই বিল ডিসেম্বরে ১৯ পয়সা বাড়িযে ৩.৯৪ টাকা করা হয়েছিল। এবার আরও ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৪.১৪ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ হতদরিদ্র গ্রাহকের ইউনিট প্রতি খরচ বাড়লো ৩৯ পয়সা। অতীতে ৫০ ইউনিটের নীচে হলেই লাইফ লাইন বিবেচনা করা হলেও এবার সেই সুবিধাও বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ পান দোকানিকেও বাড়তি বিল গুণতে হবে। আতঙ্কের আরেকটি কারণ হচ্ছে এদের অনেকেই পৃথক মিটার ব্যবহার করেন না, অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকেন। বিদ্যুৎ বিল আদায়কারীরা, দাম বৃদ্ধির অজুহাতে কয়েকগুণ বেশি আদায় করে থাকেন।

বিদ্যুতের আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ খাত বিবেচনা করা হয় কৃষি সেচকে। কৃষি উৎপাদন নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে এ খাতে বিদ্যুতের দাম সব সময়েই সাশ্রয়ী রাখার চেষ্টা করা হতো। এবার সেখানেও কোপ পড়তে যাচ্ছে। সার-বীজের দাম বেড়ে যাওয়া আসন্ন বোরো মৌসুম নিয়ে এমনিতেই শঙ্কায় রয়েছে কৃষকরা। তারপর সেচে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৩৭ টাকা করা হয়েছিল, এবার আরও ২২ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৫৯ টাকা করা হয়েছে। কৃষিতে মধ্যমচাপে ফ্ল্যাট রেটে ৫.৫১ টাকা, অফ পীকে ৪.৯৭ টাকা এবং পীকে ৬.৮৯ টাকা করা হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়নি রাস্তার বাতি ও পানির পাম্পের বিলেও। দুই দফায় দাম বাড়িয়ে ৮.৪৯ টাকা করা হয়েছে।

ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য সাশ্রয়ী দরের কোন ব্যবস্থা রাখা হয় নি। ফ্ল্যাট রেটে ৯.৪১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে যা বৃহৎ শিল্পের তুলনায় মাত্র ২ পয়সা কম। বৃহৎ শিল্পে ফ্ল্যাট রেটে দর ধরা হয়েছে ৯.৪৩ টাকা।

ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) সে সব প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে দাম বাড়ানো হতো, সেখানে নানা রকম অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত হতো। সবক্ষেত্রে যে প্রতিপালন করা যেতে সেটা বলবো না, তবে কিছুটা উন্নতি হচ্ছিল। সমাজের পিছিয়ে থাকা বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠিকে সহায়তা করার চেষ্টা থাকত। মূল্যহারের অভিঘাত থেকে হতদরিদ্র গ্রাহক, গ্রামের পান-বিড়ির দোকান, কৃষি সেচকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা হতো। একজন পান দোকানী আর বসুন্ধরা সিটির দোকানীর বিদ্যুতের বিল সমান হতে পারে না। সেই জায়গাগুলো দেখে রাখার চেষ্টা হতো। এখন সেসব চর্চা বন্ধ করে দেওয়া হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। বিইআরসিকে এখন ক্লিনিক্যালি ডেড বলা যায়। এ কুফল অনেক ভয়াবহ হবে।

তিনি আরও বলেন, যে হারে দাম বাড়ানো হচ্ছে এর ফল উল্টো হবে। সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর কৌশল, হিতের বিপরীত হতে পারে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম যতো বাড়বে, ততো ভোগ ব্যয় কমবে। বাজারে পণ্য বিক্রি কমে যাবে, এতে কমে আসবে সরবরাহ। কমে যাবে ভ্যাট-ট্যাক্স থেকে আয়।

এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম যে হারে বাড়ানো হয়েছে, তার কোনই যৌক্তিকতা নেই। আমরা আগেও বলেছি এখনও বলছি দাম না বাড়িয়েও সামাল দেওয়ার অনেক বিকল্প ছিল। অনেকগুলো যাওগায় অপচয় রয়েছে, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চুক্তি করা হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা গণশুনানিতে নিয়মিত অংশ নিতাম। সমাজের ভারসাম্য রক্ষার জন্য পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠিকে বিশেষ ছাড় দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। উন্নত দেশেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, লাইফ লাইন গ্রাহক শ্রেণি করা হয়েছে হতদরিদ্রের জন্য। তারা একটি বাল্ব একটি ফ্যান ব্যবহার করেন। মাসে যার ব্যবহার অনধিক ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ভিক্ষা করে জীবনযাপন করেন। সেই বৃদ্ধা ভিখারিনীর ঘরেও একটি বাল্ব জ্বলে। সেই ভিখারিনীর ঝোলাতে হাত বসাতে চায় বিদ্যুতের কোম্পানিগুলো। অনেকদিন ধরেই তারা এই শ্রেণির গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বাড়াতে তৎপর, কিন্তু বিইআরসিতে ভোক্তাদের চাপের মুখে পিছিয়ে গেছে। নির্বাহী আদেশে গরীবের স্বস্তির জায়গা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর