ভুল পথে পরিচালিত হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে জ্বালানি খাত, তারপরও ভুল পথেই চলছে। রশিদপুরে (রশিদপুর-৯) গ্যাস ফেলে রেখে ভোলা থেকে চড়াদামে (পরিবহন খরচ) সিএনজি আনার উদ্যোগ প্রসঙ্গে এমন মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রশিদপুর-৯ নম্বর কূপটি ২০১৭ সালে খনন করা হয়। কুপটি থেকে দৈনিক ১৪-১৯ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। শুধুমাত্র ৫ কিলোমিটার পাইপলাইনের অভাবে সেই গ্যাস পড়ে রয়েছে ৫বছর ধরে। যা আমদানিকৃত (১৯ মিলিয়ন) এলএনজির সঙ্গে তুলনা করলে দৈনিক দাম দাঁড়ায় ৫ কোটি ১৩ লাখ টাকার উপরে। বছরে এই টাকার অংক দাঁড়ায় প্রায় ১৮’শ কোটি টাকা। চাইলে ২-৩ মাসের মধ্যে পাইপলাইন নির্মাণ করা সম্ভব। অথচ সেখানে কোন গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না।
সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির যুক্তি হচ্ছে পাইপলাইন নেই কারণে গ্যাস উত্তোলন করা যাচ্ছে না। রশিদপুর-৭ নম্বর কূপ পর্যন্ত পুর্বের যে লাইনটি রয়েছে সেটি ব্যবহার অনুপযোগি। যে কারণে ১৭ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। বার্তা২৪.কম এ একাধিক রিপোর্ট প্রকাশের পর গত বছরের জুলাইয়ে হাইড্রো টেস্ট করে পাইপটি ব্যবহার উপযোগি বলে জানতে পারে। এখন ৭ নম্বর কূপের বিদ্যমান লাইনে হুকিং করে দিলেই (রশিদপুর-৯) উৎপাদনে যেতে পারবে। সেখানেও দীর্ঘসুত্রিতা দেখা গেছে।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, পাইপলাইন নির্মানের জন্য বনের কিছু গাছ কাটতে হবে। গাছ কাটার অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে এক মাসের মধ্যেই কাজ শেষ করতে চাই।
অন্যদিকে গ্যাস সংকট দূর করার কথা বলে ভোলা থেকে সিএনজি আকারে ৫ মিলিয়ন (প্রথমধাপে) গ্যাস আনার বিশাল তোড়জোড় চলছে। সম্প্রতি ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করেছে পেট্রোবাংলা। কোম্পানিটি ভোলা থেকে গ্যাস পরিবহন করে ঢাকার পাশ্বর্বতী এলাকায় সরবরাহ করবে। প্রতি ঘনমিটার গ্যাস পরিবহনের জন্য ৩০.৬০ টাকা দিতে হবে ইন্ট্রাকোকে। শিল্প কারখানায় পাইপলাইনে পাওয়া গ্যাসের জন্য ১৮.০২ টাকা (বৃহৎ শিল্প) পাওয়া গেলেও, এই গ্যাসের মূল্য দিতে হবে ৪৭.৬০ টাকা। খানিকটা খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি প্রবাদের মতো।
অথচ সেই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান মঞ্চে দাঁড়িয়ে পেট্রোবাংলা, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা যেভাবে নিজেদের ক্রেডিট নিয়েছেন, তাতে মনে হবে তারা নতুন কোন গ্রহ আবিস্কার করে ফেলেছেন।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আমি জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাকে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। আমরা কয়েক মাসের মধ্যেই ভোলার গ্যাস আনার বিষয়টি চুড়ান্ত করতে পেরেছি। এ জন্য আমি আমার সহকর্মীদের ধন্যবাদ দিচ্ছি এতো।
অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিষয়টি প্রথম তৌফিক ভাইয়ের (প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা) মাথা থেকে এসেছে। বিষয়টি খুবই অভিনব।
প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা বলেন, সমকালীন সমস্যাকে মিটিয়ে এগিয়ে যাওয়া এটাই সরকারের বড় লক্ষ্য। আমরা যদি যৌথভাবে কাজ করি তাহলে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবো।এটা যদি কনসালটেন্ট নিয়োগ করতাম, তারা অনেকদিন সময় লাগাতো। কিন্তু ইন্ট্রাকো দ্রুত সময়ের মধ্যে করতে পেরেছে। এতে শুধু সরবরাহ বাড়ল না, সংকটও দূর হবে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, গ্যাস সংকটের কথা বলে ভোলা থেকে গ্যাস আনার আগে রশিদপুরের গ্যাস আনা যেতো। এক দুই মাসের মধ্যেই যে কাজটি করা যেতো। ভোলা থেকে গ্যাস আনার মতো এখানে কোন ঝুঁকি নেই, এবং নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ দেওয়া সম্ভব। আবার সেই দামও হতো সাশ্রয়ী। সেই কাজটি কেনো এতোদিনে করা যাচ্ছে না সেটাই বড় বিষ্ময়ের।
ভোলা থেকে প্রথম দফায় আসবে মাত্র ৫ মিলিয়ন, পরে আরও ২০ মিলিয়ন আনার পরিকল্পনা রয়েছে। অথচ এর সিকিভাব প্রচেষ্টা নিলে ১ টাকারও কম মূল্যে রশিদপুর থেকে কয়েকগুন বেশি গ্যাস আসতে পারতো। সেদিকে না পেট্রোবাংলা, না জ্বালানি বিভাগের কোন আগ্রহ দৃশ্যমান।
বাংলাদেশে মোট ২৯টি গ্যাস ফিল্ড আবিস্কৃত হয়েছে। ২১ টি গ্যাস ফিল্ডের ১১৩টি কূপ দিয়ে দৈনিক (৩জুন) ২১৪০ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এক সময় ২৮০০ মিলিয়ন পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত গ্যাসের উৎপাদন কমে আসছে। ঘাটতি সামাল দিতে দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানির জন্য দু’টি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছে। নতুন করে আরও দু’টি ভাসমান টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যা এখনও যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে আটকে রয়েছে। কার্যাদেশ দেওয়ার পর কমপক্ষে ১৮ মাস সময় লাগবে । এছাড়া একটি ল্যান্ড বেজড এলএনজি টার্মিনালের উদ্যোগ রয়েছে, সেই প্রক্রিয়ায় কাগজে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ ২০২৩ ও ২০২৪ সালে বাড়তি গ্যাস আমদানি সুযোগ একেবারেই ক্ষীণ।
তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে স্থবিরতার কারণেই আজকের এই সংকট বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ইউএসজিএস তাদের এক সার্ভে রিপোর্টে বলেছে বাংলাদেশে আরও ৩২ টিসিএফ গ্যাস অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। বর্তমানে বছরে ১ টিসিএফ গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে সে হিসেবে আরও ৩২ বছরের মজুদ রয়েছে। দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম সঠিক গতিতে না হওয়ায় আজকের এই সংকট। অচলাবস্থার কারনেই আজকে চড়াদামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে।
তিনি বলেছেন, দেশীয় গ্যাস তুললে যে লাভ তার চেয়ে না তুললে বেশি লাভ। আমদানি করলে কমিশনের বিষয় থাকতে পারে। এটা শুধু আজকে থেকে নয়, ঐতিহাসিকভাবেই অনুসন্ধানে স্থবিরতা বিদ্যমান। সরকার পরিবর্তন হলে একটা পরিবর্তন আশা করা হয়, কিন্তু সেভাবে পরিবর্তন হয় নি। বরং পুর্বের ধারার সঙ্গে নতুন ধারা আমদানি যুক্ত করা হয়েছে। এই অবস্থা থাকলে ৩০ সালে গ্যাস খাত পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হয়ে পড়বে।
অনেকে ধারণা করেছিলেন সমালোচনা হয়েছে এবার মনে হয় বোধদয় হবে, গুরুত্ব পাবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ খাত। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে গত বছরের তুলনায় অর্ধেক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।