বেশি দামে এলপিজি বিক্রি করায় ইউনাইটেড এলপিজি লিমিটেড ও টোটাল গ্যাসকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ১২ কেজির সিলিন্ডার ডিলার পর্যায়ে ৯২৪ টাকা দরে বিক্রি করার নির্দেশনা থাকলেও ইউনাইটেড এলপিজি ১০৭৪ টাকা, টোটাল গ্যাস ১০১৯ টাকা দরে বিক্রি করেছে।
দুই কোম্পানিকে কারণ দর্শানোর বিষয়ে বার্তা২৪.কমকে নিশ্চিত করেছেন বিইআরসি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন। তিনি বলেছেন, টোটাল এলপিজি চাঁদপুরের তাদের একজন ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে ১২ কেজির সিলিন্ডার ১০১৯ টাকা দরে বিক্রি করেছে। সেই তথ্য চাঁদপুরের একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। সে বিষয়ে টোটাল গ্যাসকে কারণ দর্শাইতে বলা হয়েছে।
বিইআরসি চেয়ারম্যান আরও বলেন,মানিকগঞ্জে বাজার মনিটরিংয়ে গিয়েছিলাম আমি নিজে। আমরা ইউনাইটেড এলপিজি লিমিটেডের ডিস্ট্রিবিউটর মিলেনিয়াম ট্রেডার্সের সঙ্গে কথা হলে তারা বেশি দামে কেনার চালানপত্র দেখায়। ১২ কেজির সিলিন্ডার ১০৭৪ টাকা কিনেছে মিলেনিয়াম ট্রেডার্স । ইউনাইটেড এলপিজির ৫ জুলাই ইস্যু করা চালানপত্রে বিক্রয়মূল্য ১০৭৪ টাকা দেখা গেছে। বিইআরসি নির্ধারিত দর অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৯২৪ টাকা নেওয়ার কথা। সে কারণে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
বিইআরসি কর্তৃক ১১ জুলাই ইস্যু করা কারণ দর্শানোর নোটিশ ইউনাইটেড এলপিজি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে মিলেনিয়াম ট্রেডার্সকে যে চালানপত্র দেওয়া হয়েছে। তাতে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত দরের চেয়ে ১৫০ টাকা বেশি নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা কমিশনে প্রেরণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হলো।
উল্লেখ্য, বিইআরসি ঘোষিত জুলাই মাসের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৯৯৯ টাকার মধ্যে ডিলারের কমিশন ৩৪ টাকা এবং খুচরা বিক্রেতার ৩৮ টাকা রয়েছে। সে হিসেবে ডিস্ট্রিবিউটর পর্যায়ে ৯২৪ টাকা দরে বিক্রি করার কথা।
ইউনাইটেড এলপিজি লিমিটেডের এজিএম রাইসা বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, মিলেনিয়াম ট্রেডার্স নামে আমাদের কোন ডিস্ট্রিবিউটর নেই। তাদের কাছে পাওয়া কোম্পানির চালানপত্রের বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দায় চাপান বিইআরসির উপর। তিনি বলেন, বিইআরসি দর নির্ধারণ করেছে ৩ তারিখে, সিস্টেম আপডেটের বিষয় রয়েছে। আমরা কি ততদিন পর্যন্ত বিক্রি বন্ধ রাখবো?
বিইআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী ৩ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা থেকে নতুন দর কার্যকর হওয়ার কথা। চালানপত্রটি ৫ তারিখের, যুক্তির খাতিরে যদি আগের মাসের দরও ধরে নিই তাতেও গড়মিল হয়। আগের মাসে (জুন) ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে বিক্রি করার কথা ১০০২ টাকায়। আর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ছিল ১০৭৪ টাকা। তাহলে কি ডিস্ট্রিবিউটর ও খুচরা বিক্রেতার কমিশন কখনই দিচ্ছে না ইউনাইটেড এলপিজি। এমন প্রশ্ন করা হলে বলেন, আমি ফোনে আর সময় দিতে পারছি না, আপনার আরও কোন জানার থাকলে অফিসে আসতে হবে।
এলপিজি আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে দাম বেশি নেওয়ার অভিযোগ অনেক পুরনো। তারা কখনই বিইআরসি নির্ধারিত দরে বিক্রি করছে না। এতোদিন বিইআরসি শুধু খুচরা বিক্রেতার উপর খড়গহস্ত ছিলেন। কমিশনে নতুন চেয়ারম্যান যোগদানের পর এবারেই প্রথম এলপিজি কোম্পানির উপর নজর দিয়েছে। তার তাতেই বেরিয়ে আসছে অবাক করার মতো সব তথ্য।
এর আগেও কোম্পানিগুলো বেশিদামে নেওয়ার বিষয়ে বিইআরসির নজরে এসেছিল। কোম্পানিগুলোর বক্তব্য ছিল আমরা ডিস্ট্রিবিউটরকে চালান ইস্যু করার সময় তাদের কমিশন যুক্ত দর উল্লেখ করি। তারা পুরো টাকা জমা দেয়, পরের দফায় গ্যাস নিতে এলে পুর্বের কমিশনের টাকা সমন্বয় করা হয়। এই বলে এতোদিন চালাকি করে আসছিল কোম্পানিগুলো। এবার দেখা গেলো খুচরা বিক্রেতার ৩৮ টাকাও তারা পকেটে ভরছে।
অন্যদিকে জুলাই মাসের এলপিজির দর সমন্বয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বিইআরসি বলেছে, কোন অবস্থাতেই নির্ধারিত মূল্যের বেশি দর নেওয়া যাবে না। ডিস্ট্রিবিউটরের মার্জিন বাদ দিয়ে চালান ইস্যু করতে হবে। বিইআরসির সেই আদেশকেও মানতে চাইছে না এলপিজি কোম্পানিগুলো।
বিইআরসির বিগত একাধিক দর ঘোষণার সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হয়ে এলপিজি ডিস্ট্রিবিউটরদের সংগঠনের সভাপতি মোঃ সেলিম খান এর প্রতিকার চেয়ে আসছেন। গত ২ এপ্রিল বিইআরসি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দর ২৪৪ টাকা কমিয়ে ১১৭৮ টাকা নির্ধারণ করে। সেলিম খান ওই সাংবাদিক সম্মেলনেই প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আপনারা নতুন দর ঘোষণা করলেন। কিন্তু আমদানিকারকরা আজকে (২ এপ্রিল) মিল গেটে ১২ কেজির দর ঘোষণা করেছে ১২০০ টাকা। বিইআরসির হিসেব অনুযায়ী আমাদের (ডিস্ট্রিবিউটর) পাওয়ার কথা ১১০৬ টাকা দরে। এরপর আমাদের কমিশন ৩৪ টাকা এবং খুচরা বিক্রেতার কমিশন ৩৮ টাকা ধরে ভোক্তা পর্যায়ে ১১৭৮ টাকা হওয়ার কথা। অথচ আমাদেক ৯৪ টাকা বেশি দরে কিনতে হচ্ছে।
জবাবে বিইআরসির চেয়ারম্যান নুরুল আমিন সেদিন বলেছিলেন, আমরা বিষয়টি দেখবো। মালিকদের সঙ্গে বসে নির্ধারিত দরে বিক্রির বিষয়ে নিশ্চিত করা হবে। যদি কোন মালিক কথা শুনতে না চায় তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিইআরসি চেয়ারম্যান তার কথা রেখেছেন। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, বেশি দর নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমরা আজকে (৫ জুলাই) সব জেলা প্রশাসক ও ভোক্তা অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য। আমরাও অভিযান পরিচালনা শুরু করেছি।
২০২১ সালের ১২ এপ্রিল প্রথম এলপি গ্যাসের দর ঘোষণা করে বিইআরসি। তখন এলপিজি আমদানিকারক, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার জন্য ১২ কেজির সিলিন্ডারে মোট ৩৫৯ দশমিক ৪০ টাকা কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছিল। দর ঘোষণার দিনেই কমিশনের পরিমাণ নিয়ে আপত্তি তোলেন লোয়াব (এলপিজি আমদানিকারকদের সংগঠন)। এরপর থেকে বিইআরসির সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয় লোয়াবের। তারা প্রতিমাসের দর ঘোষণাও বর্জণ করে বিভিন্নভাবে বিইআরসির উপর চাপ তৈরি করে। এমনকি এলপিজি আমদানিবন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয় লোয়াবের সভাপতি আজম জে চৌধুরী। বিইআরসি অনেকটা বাধ্য হয়ে ৭ মাসের মাথায় ১০ অক্টোবর ৩৫৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৪১ টাকা করেন। তারপরও কোম্পানিগুলো বেশি দাম আদায় করে যাচ্ছে।