রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ এক বছর পিছিয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসবে বলে বার্তা২৪.কম-কে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
যৌথসভার মাধ্যমে নতুন তারিখ চূড়ান্ত করার কথা নিশ্চিত করেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথ সভায় উৎপাদনের নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, সঞ্চালন লাইন নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। আমরা আশা করছি নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হবে। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র রেডি করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ এ প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট এবং দ্বিতীয় ইউনিট থেকে আরও ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ২০২৪ সালে উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে জার্মান প্রতিষ্ঠান সিমেন্স কাজকে জটিল করে তুলেছে। সিমেন্স ২৩৩/৪০০ কেভি জিআইএস সাব স্টেশন সরবরাহ করার কথা ছিল। গত বছর সাব স্টেশন সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানালে নতুন ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছে চীনা কোম্পানিকে। তারা ২০২৩ সালের মধ্যেই সরবরাহ করতে চায়। অন্যদিকে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের গতিও পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়। সঞ্চালন লাইন নির্মাণের তদারক প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারছেন না। বিশেষ করে নদী পারাপারের কাজটি এখনও সেভাবে শুরু করতে পারেনি। অর্থাৎ দুই দিক থেকেই বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ পেছানোর তাগাদা ছিল।
পিজিসিবি সুত্র জানিয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইনের দৈঘ্য ৬৬৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪৬৪ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন ও ২০৫ কিলোমিটার ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন। ২০ কিলোমিটার রয়েছে নদী পারাপার। এর মধ্যে ৪০০ কেভি ১৩ কিলোমিটার ও ৭ কিলোমিটার ২৩০ কেভি লাইন। অনেকগুলো ভাগে ভাগ করে কাজ চলছে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের। পদ্মা ও যমুনার মতো বড় নদী পারাপার রয়েছে। যে কাজটি বেশ জটিল এবং সময় সাপেক্ষ। নদী পারাপার কাজে অর্থায়ন করা হচ্ছে দেশীয় তহবিল থেকে। ডলার সংক্রান্ত জটিলতায় ঠিকাদারকে যথা সময়ে অর্থ দিতে না পারায় কাজটি বিলম্বিত হয়েছে। ফলে প্রকল্পের অন্যান্য কাজ শেষ হলেও নদী পারাপারের কাজ শেষ হতে দেড় থেকে দুই বছর সময় লাগতে পারে।
গত ডিসেম্বরে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কাজের অগ্রগতি সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তখন প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কাজের অগ্রগতি অনেক সন্তোষজনক। করোনার কারণে সঞ্চালন লাইনের কাজ কিছুটা ব্যাহত হয়েছে, যথা সময়ে দরপত্র চূড়ান্ত করা যায়নি। এ কারণে কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে বাণিজ্যিক উৎপাদনে।
রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক শৌকত আকবর বলেছেন, আমরা ২০২৩ সালের মধ্যেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শেষ করে ফেলবো। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষে কাজ করে যাচ্ছি।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্পে সিংহভাগ অর্থায়ন করেছে রাশিয়া। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে রাশিয়ার অর্থায়ন রয়েছে ৯৩ হাজার কোটি টাকা। পৃথিবীর ৩০টি দেশে ৪৪৯টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমাণ মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের প্রায় ১২ শতাংশ। ১৪টি দেশে আরও ৬৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ ২৭টি দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান। এগুলোর মধ্যে ৩০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রই নির্মিত হচ্ছে পরমাণু বিশ্বে নবাগত দেশসমূহে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, পরমাণু বিদ্যুতে সবচেয়ে সুবিধার দিক হচ্ছে ৬০ বছর এর দর কোন ওঠা-নামা করবে না। আমরা একই দরে ৬০ বছর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাবো।
অন্যদিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ এবং গ্যাস ও তেলভিত্তিক বিদ্যুতের দর উঠানামা করে। তুলনামূলক কম হবে পরমাণু বিদ্যুতের দাম। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে গেলে তেলভিত্তিক ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া যাবে।