বঙ্গবন্ধু সেদিন মাত্র ১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকায় তিতাস (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), বাখরাবাদ (কুমিল্লা), হবিগঞ্জ, রশিদপুর ও কৈলাশটিলা (হবিগঞ্জ) গ্যাসফিল্ড কিনে নিয়েছিলেন। সেই ৫টি গ্যাস ফিল্ড থেকে জুন পর্যন্ত উৎপাদিত (১০.২৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাসের আর্থিক মূল্য (বর্তমান বাজার দরে) ৬ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা।
৪৮ বছর ব্যবহারের পরেও (জুলাই, ২০২৩) মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে ৫ দশমিক ২৩ টিসিএফ, যার বর্তমান আর্থিক মূল্য প্রায় ৩ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো। তার ওই দূরদর্শী সিদ্ধান্তের এখন সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী।
১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট ছিল শনিবার, বঙ্গবন্ধু অফিসে এসে বলেছিলেন আজ বাঙালির অন্যতম মুক্তির সনদে সই করবো। তারপর গ্যাসক্ষেত্র ৫টি কেনার ফাইলে সই করেন। সেদিনের সেই ঘটনার সাক্ষী বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন একান্ত সচিব ড. ফরাসউদ্দিন এমন তথ্য জানিয়েছেন।
ফরাসউদ্দিন বলেছেন, বহুজাতিক কোম্পানি শেল ওয়েল কিন্তু দিতে আগ্রহী ছিল না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দেখো তোমরা যদি বিক্রি না করো, তাহলে নতুন আইনে আমরা অধিগ্রহণ করতে বাধ্য হবো। ইরানে তখন অধিগ্রহণের ঘটনা ঘটেছিল।
ওই ঘটনাকে বলা হয়, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের টার্নিং পয়েন্ট। বঙ্গবন্ধু নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার মাত্র ৬দিন আগে বিদেশিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশকে নিরাপদ করেছিলেন। ফরাসউদ্দিন মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এ বিষয়টির কোনো যোগসূত্র কাজ করলে আমি খুবই দুঃখ পাবো।
একইসঙ্গে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিশন কোম্পানিতে থাকা শেল অয়েলের সব শেয়ার কিনে নেয় বাংলাদেশ। ১৮ বছরে মোট ৩৬টি কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য হিসেবে চুক্তি সম্পাদন করা হয। অনেকে এই মূল্যকে শান্তনা মূল্য হিসেবে মনে করেন। কারণ প্রকৃত মূল্য ছিলো অনেক অনেক গুণ বেশি। জাতির জনকের কৌশলী চালে সেদিন অনেকটা বোকা বনে গিয়েছিলো বহুজাতিক কোম্পানি শেল ওয়েল।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থায় চিন্তা করেছিলেন সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে শুধু কৃষি নির্ভর দিয়ে হবে না। শিল্পায়ন করতে হবে, শিল্পায়ন করতে হলে তেল-গ্যাস লাগবে। সে জন্য জ্বালানিটাকে নিশ্চিত করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু তখন শেলওয়েলকে গ্যাস নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করার নির্দেশ দেন। শেলওয়েল বললো আমাদের যেসব লাইন রয়েছে, সেখানেই গ্রাহক পাচ্ছি না। লাইন বাড়ানোর সম্ভব না। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, পনের দিনের মধ্যে পাইপলাইন স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে আসবা, না হলে বিক্রি করার প্রস্তাব নিয়ে আসো। এভাবে ৫টি গ্যাস ফিল্ডের মালিক হয়ে যায় বাংলাদেশ। আগে ছিল কনসেশন পদ্ধতি বঙ্গবন্ধু নিয়ে আসেন উৎপাদন বন্টন চুক্তি। ৯ মাস ৬টি চুক্তি করেছিলেন। পৃথিবীর আইডিয়াল চুক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এগুলোকে।
তিনি বলেন, আমরা এখন যেভাবে আমদানি নির্ভরতার দিকে যাচ্ছি ২০৩০ সালে ২৫-৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে জ্বালানি আমদানিতে। ফরেন রিজার্ভের সিংহভাগ যদি জ্বালানি ব্যয় করি তাহলে উন্নত দেশে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। দেশে গ্যাসের সম্ভাবনা নেই যাদের এই ফিলোসপিতে বিশ্বাস রয়েছে। তারা দয়া করে রাস্তাটা ছেড়ে দেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, বঙ্গবন্ধু ১/২ বছরে যেভাবে কাজ শুরু করেছিলেন, কিন্তু এতো বছরে যদি চলতে পারতাম তাহলে সিনারিও ভিন্ন হতো। যিনি এক-দুই বছরে পুরো সাগরকে অনুসন্ধানের আন্ডারে আনলেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর কক্ষচ্যুত হয়ে যায় জ্বালানি খাত। যে কারণে আজকের এই সংকট। তেল-গ্যাস অনুসন্ধ্যানের আইডিয়াল সিচুয়েশন আর দেখতে পেলাম না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে যারা দীক্ষিত, তাদের আরও ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত।
বঙ্গবন্ধুর সেই অসামান্য অবদানকে স্মরণ করতে ২০০৯ সাল থেকে ৯ আগস্টকে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে সরকার। এবারও নানান কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এ অসামান্য অবদান ধরে রাখার জন্য ওই ৫টি গ্যাস ক্ষেত্রে ‘জ্বালানি নিরাপত্তায় বঙ্গবন্ধুর অবদান’ বিষয়ক স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপণ করা হবে। পাশাপাশি ঢাকায় একটি ভার্চুয়াল সেমিনারের আয়োজন থাকছে বলে পেট্রোবাংলা সুত্র জানিয়েছে।