চরম সংকটের মধ্যেও কয়েক বছর গুরুত্বহীনভাবে ফেলে রাখা হয় গ্যাস সমৃদ্ধ রশিদপুর-৯ নম্বর কূপ। কাজ শুরুর পর এখন চলছে বন বিভাগ ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডের মধ্যে রশি টানাটানি।
কূপটি থেকে দৈনিক ১৪-১৯ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। শুধুমাত্র বিদ্যমান পাইপলাইনের সঙ্গে হুকিং করে দিলেই গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। সেই কাজটি না করে ৫ বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে কূপটি। সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির যুক্তি হচ্ছে পাইপলাইন নেই, যার কারণে গ্যাস উত্তোলন করা যাচ্ছে না। রশিদপুর-৭ নম্বর কূপ পর্যন্ত পূর্বের যে লাইনটি রয়েছে সেটি ব্যবহার অনুপযোগী। যে কারণে ১৭ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
অনলাইন নিউজ পোর্টাল বার্তা২৪.কমে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশের পর ২০২২ সালের জুলাইয়ে হাইড্রো টেস্ট করে পাইপটি ব্যবহার উপযোগী বলে রিপোর্ট আসে। এরপর ৭ নম্বর কূপে বিদ্যমান লাইনে হুকিং করে দেওয়ার (রশিদপুর-৯) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারপরও কেটে গেছে আরও এক বছর, কিন্তু সুরাহা হয়নি।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, পাইপলাইন নির্মাণের জন্য বনের কিছু গাছ কাটতে হবে। গাছ কাটার অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে এক মাসের মধ্যেই কাজ শেষ করতে চাই। আমরা বন বিভাগের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছি।
চলতি বছরে ১২ ফেব্রুয়ারি গাছ কাটার জন্য বন বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে বন বিভাগ একটি কমিটি গঠন করে, তারা রিপোর্ট দিলেও এখন সুরাহা হয়নি বিষয়টি। কয়েকমাস ধরেই আরএডিপি সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিষয়টি তোলা হয়, সেখানে প্রতিবারেই সিদ্ধান্ত হয়, বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করার। কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। যে কারণে বিশাল মজুদ নিয়ে বসে রয়েছে কূপটি। সম্ভাবনাময় কূপটি নিয়ে সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি তথা জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের গাছাড়া ভাব লক্ষ্যণীয়। দেশে চরম সংকটের মধ্যেও কোন গুরুত্ব পাচ্ছে না। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে যখন উচ্চমূল্যের কারণে এলএনজি আমদানি বন্ধ, তখনও নজর পড়েনি পড়ে থাকা কূপটি।
বরং দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। গ্যাস সংকট দূর করার কথা বলে ভোলা থেকে সিএনজি আকারে ৫ মিলিয়ন (প্রথমধাপে) গ্যাস আনার বিশাল তোড়জোড় চলছে। সম্প্রতি ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করেছে পেট্রোবাংলা। কোম্পানিটি ভোলা থেকে গ্যাস পরিবহন করে ঢাকার পাশ্বর্বতী এলাকায় সরবরাহ করবে। প্রতি ঘনমিটার গ্যাস পরিবহনের জন্য ৩০.৬০ টাকা দিতে হবে ইন্ট্রাকোকে। শিল্প কারখানায় পাইপলাইনে পাওয়া গ্যাসের জন্য ১৮.০২ টাকা (বৃহৎ শিল্প) পাওয়া গেলেও, এই গ্যাসের মূল্য দিতে হবে ৪৭.৬০ টাকা। খানিকটা খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি প্রবাদের মতো।
অথচ সেই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান মঞ্চে দাঁড়িয়ে পেট্রোবাংলা, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা যেভাবে নিজেদের কৃতিত্ব নিয়েছেন, তাতে মনে হবে তারা নতুন কোনো গ্রহ আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আমি জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। আমরা কয়েক মাসের মধ্যেই ভোলার গ্যাস আনার বিষয়টি চূড়ান্ত করতে পেরেছি। এ জন্য আমি আমার সহকর্মীদের ধন্যবাদ দিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা বলেন, সমকালীন সমস্যাকে মিটিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাই সরকারের বড় লক্ষ্য। আমরা যদি যৌথভাবে কাজ করি তাহলে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবো।এটা যদি কনসালটেন্ট নিয়োগ করতাম, তারা অনেকদিন সময় লাগাতো। কিন্তু ইন্ট্রাকো দ্রুত সময়ের মধ্যে করতে পেরেছে। এতে শুধু সরবরাহ বাড়ল না, সংকটও দূর হবে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, গ্যাস সংকটের কথা বলে ভোলা থেকে গ্যাস আনার আগে রশিদপুরের গ্যাস আনা যেতো। এক দুই মাসের মধ্যেই যে কাজটি করা যেতো। ভোলা থেকে গ্যাস আনার মতো এখানে কোন ঝুঁকি নেই, এবং নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ দেওয়া সম্ভব। আবার সেই দামও হতো সাশ্রয়ী। সেই কাজটি কেনো এতোদিনে করা যাচ্ছে না সেটাই বড় বিষ্ময়ের।
ভোলা থেকে প্রথম দফায় আসবে মাত্র ৫ মিলিয়ন, পরে আরও ২০ মিলিয়ন আনার পরিকল্পনা রয়েছে। অথচ এর সিকিভাব প্রচেষ্টা নিলে ১ টাকারও কম মূল্যে রশিদপুর থেকে কয়েকগুণ বেশি গ্যাস আসতে পারতো। সেদিকে না পেট্রোবাংলা, না জ্বালানি বিভাগের কোন আগ্রহ দৃশ্যমান।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বলেছেন, দেশীয় গ্যাস তুললে যে লাভ তার চেয়ে না তুললে বেশি লাভ। আমদানি করলে কমিশনের বিষয় থাকতে পারে। এটা শুধু আজকে থেকে নয়, ঐতিহাসিকভাবেই অনুসন্ধানে স্থবিরতা বিদ্যমান। সরকার পরিবর্তন হলে একটা পরিবর্তন আশা করা হয়, কিন্তু সেভাবে পরিবর্তন হয়নি। বরং পূর্বের ধারার সঙ্গে নতুন ধারা আমদানি যুক্ত করা হয়েছে। এই অবস্থা থাকলে ৩০ সালে গ্যাস খাত পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হয়ে পড়বে।
দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে স্থবিরতার কারণেই আজকের এই সংকট বলে মনে করে ড. বদরুল ইমাম। তিনি বলেছেন, ইউএসজিএস তাদের এক সার্ভে রিপোর্টে বলেছে বাংলাদেশে আরও ৩২ টিসিএফ গ্যাস অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। বর্তমানে বছরে ১ টিসিএফ গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে সে হিসেবে আরও ৩২ বছরের মজুদ রয়েছে। দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম সঠিক গতিতে না হওয়ায় আজকের এই সংকট। অচলাবস্থার কারণেই আজকে চড়া দামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে।