জ্বালানি তেল বেচাকেনায় আন্তর্জাতিক দর কার্যকরের প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাস থেকেই কার্যকর করার জোর প্রচেষ্টা চলছে। কেউ কেউ বলছেন কাজ এখন গুছিয়ে আনতে পারেনি বিপিসি, যে কারণে কিছুটা পিছিয়ে যেতে পারে।
সেপ্টেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক দরে জ্বালানি তেল বেচাকেনার কথা অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ। তখন বলা হয়, জ্বালানি তেলে আর কোন ভর্তুকি দেবে না বাংলাদেশ। আমদানি নির্ভর, ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও জেট ফুয়েলসহ জ্বালানি তেলে স্বয়ক্রিয় দর পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজার বেড়ে গেলে দাম বাড়বে, কমলে কমে যাবে। পরীক্ষামুলকভাবে প্রথম ধাপে প্রতি ৩ মাস পর পর দর সমন্বয় করার কথা জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী। বর্তমানে নির্বাহী আদেশে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ পদ্ধতি কার্যকর রয়েছে। সরকার সময়ে সময়ে গেজেট প্রকাশ করে তেলের দাম পুনঃনির্ধারণ করে আসছে।
প্রকাশ্য কিছু বলা না হলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রেসক্রিপশনের বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দেয় আইএমএফ। এর চারদিনের মাথায় প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করা হয়। সেই ঋণে অন্যতম শর্ত ছিল জ্বালানি তেল থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা।
ওই ঘোষণার পর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে বিপিসিকে একটি ফর্মুলা প্রস্তুত করতে বলা হয়। তখন উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম ভারত সফর করে আসেন। অন্যদিকে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) অধীনে দেওয়ার বিষয়েও আলোচনা। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় (১৪ ডিসেম্বর ২০২২) সিদ্ধান্ত হয়েছিল তেলের দাম নির্ধারণ করবে বিইআরসি। ওই সভায় এক দশক ঝুলে থাকা বিইআরসির প্রবিধানমালা সংশোধন সাপেক্ষে দ্রুত অনুমোদন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে মোতাবেক প্রবিধানমালা সংশোধন করে ফের জমা দিয়েছে বিইআরসি।
অন্যদিকে বিপিসি বিষয়টি ধরে রাখতে প্রথম থেকেই তৎপর রয়েছে। সম্প্রতি এক রূদ্ধদ্বার বৈঠকে সেই বিপিসি তাদের প্রস্তাবিত ফর্মুলা উপস্থাপন করে। তাতে লিটার প্রতি প্রায় ১০ টাকা হারে বিপিসির প্রফিট প্রস্তাব করা হয়। ওই বৈঠকে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করেন। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, প্রতিমন্ত্রী বলেছেন আপনারা যে দরের ফর্মুলা রেডি করে এনেছেন পুরোটাই বিপিসির স্বার্থ রক্ষা করে। ভোক্তার স্বার্থও রক্ষা করতে হবে, শুধু বিপিসির স্বার্থ দেখলে চলবে না। বিপিসিকে ফর্মুলা রিভিউ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়।
জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারদরে ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাধারণ জনগণের বহুল ব্যবহৃত ডিজেল দাম নিয়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে সব সময়েই ডিজেলের দাম বেশি থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো করে রাখা হয়েছে। তুলনামূলক ধনিকশ্রেণির ব্যবহার পেট্রোল-অকটেনের দাম বেশি রাখা হয়। আর সেই টাকা দিয়ে ডিজেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়। যাতে সাধারণ জনগণ সাশ্রয়ীমূল্যে জ্বালানি পেতে পারে।
বিপিসি সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ ২০২২ সালের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। বর্তমানে লিটার প্রতি অকটেন ১৩৫ টাকা, আর পেট্রোল বিক্রি হচ্ছে পেট্রোল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা দরে। আন্তর্জাতিক দর কার্যকর হলে ১ ‘শ টাকার নিচে নেমে আসার কথা। আর ডিজেলের দাম ১১০ টাকার আশপাশে থাকার কথা। তবে কিছুটা হলেও অকটেনের দাম বেশি রাখার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা চলছে। বিষয়টি এমন হবে সামগ্রিক তেলের দামে কোন ভর্তুকি থাকবে না। হয়তো নির্দিষ্ট কোন পণ্যে তারতম্য থাকতে পারে। পাশাপাশি ভারতের বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা হবে। যাতে সীমান্ত এলাকা দিয়ে কোনভাবে ভারতে পাচার হতে না পারে।
তবে বাঁধ সেধেছে এনবিআরের নতুন ট্যাক্স পদ্ধতি। আমদানি পর্যায়ে কমার্শিয়াল এনভয়েজের ভিত্তিতে রাজস্ব পরিশোধ করার নির্দেশনা জারি করেছে। এতদিন বিপিসি তাদের ফর্মুলা অনুযায়ী রাজস্ব পরিশোধ করে আসছে। রাজস্ব বোর্ডের নতুন ফর্মুলায় ট্যাক্সের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। যা সামগ্রিক মূল্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছে বিপিসি।
আরেকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তেলের দামের সঙ্গে পরিবহন ভাড়াও জড়িত। তেলের দাম সমন্বয় হলে পরিবহন ভাড়া ঠিক মতো ওঠা-নামা করবে কিনা।
ক্যাবের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, বিপিসি নিজে একজন লাইসেন্সী, একজন লাইসেন্সী কখনও নিজে দাম ঠিক করার অধিকার রাখে না। এটি করতে হলে রেগুলেটরি কমিশনের মাধ্যমে করা উচিত। বিপিসি একটি লুণ্ঠনকারী প্রতিষ্ঠান, জনগণের গণশত্রুতে পরিণত হয়েছে এ কথা প্রমাণিত। তাদের অনেক গোপন চুরি রয়েছে, তাকে আরও সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তারা জনগণের স্বার্থ কখনও দেখেনি, বিপিসেকে দায়িত্ব দিয়ে তাদের শক্তি আরও বৃদ্ধি করা হচ্ছে। অটোমেশনের নামে বিপিসির মুনাফা আরও বাড়ানো রাষ্ট্র বা সরকারের দর্শন হতে পারে না। বিপিসি কি সর্বনিম্ন দামে তেল কেনা, ফেড ও জাহাজ ভাড় যৌক্তিক মূল্যে নিশ্চিত করতে পেরেছে?
তিনি বলেন, উন্মুক্ত দর পদ্ধতি মানে বাজারের দর ছেড়ে দেওয়া। আমাদের বাজার কি দর নির্ধারণ করে? বাজারের মনোপলি ভাঙার জন্য রেগুলেটরি আনা হলো। সঠিক দামে মানসম্মত পণ্য পাওয়া জনগণের মৌলিক অধিকার। শিল্প উৎপাদনের খরচ তেলের ওপর নির্ভরশীল, দাম বেড়ে গেলে উৎপাদন খরচ বাড়বে। এমন একটি পদ্ধতি থাকা উচিত যাতে ১০ শতাংশ কমবেশি হলে দর স্থির থাকবে। আমরা একটি তহবিল করার প্রস্তাব করেছিলাম, দাম বেড়ে গেলে ওই তহবিল থেকে সহায়তা দেওয়ার জন্য।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এখনও যাচাই-বাছাই চলছে। এনবিআর কর্মাশিয়াল এনভয়েজের ভিত্তিতে ডিউটি চায়। ডিউটি সমন্বয় হলে দাম বেড়ে যেতে পারে। সরকার এই মুহূর্তে জনগণের ওপর বাড়তি দামের বোঝা চাপাতে চায় না।
বিপিসির ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জ্বালানির মধ্যে ডিজেল ব্যবহৃত হয়েছে ৭০.১৫ শতাংশ। ওই বছরে ৪৮ লাখ ৫০ হাজার ৭’শ টন ডিজেল ব্যবহৃত হয়েছে। এর পরেই রয়েছে ফার্নেস অয়েল ৫ লাখ ৭১ হাজার ৫৮৬ টন। একই সময়ে পেট্রোল ব্যবহার হয়েছে ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৬৪৭ টন, অকটেন ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৬০২ টন, উড়োজাহাজের জ্বালানি জেট এ-১ ৪ লাখ ২৮ হাজার ২৪ টন, কেরোসিন বিক্রি হয়েছে ৮৬ হাজার ১১৭ টন।
২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিসি ১৪ লাখ ৬৬ হাজার ১১৭ মে. টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে। একই সময়ে পরিশোধিত তেল আনা হয়েছে ৪৮লাখ ৯ হাজার ১৩২ টন।পরিশোধিত তেলের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল ডিজেল, পাশাপাশি জেট এ-১ ও কেরোসিন ছিল। অপরিশোধিত তেল আনতে পারলে খরচ সাশ্রয় হয়, কিন্তু দেশের শোধণাগারের সক্ষমতা না থাকায় পরিশোধিত আনতে হয়। শোধনাগারের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ২০০৮ সালে প্রকল্প নেওয়া হলেও সেটি এখন অনেকটাই অংকুরেই রয়ে গেছে।